পাক-ভারত সংঘাত: শিখলাম, এটম বোমা লাগবে আমাদেরও

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 25 Sept 2016, 08:28 PM
Updated : 25 Sept 2016, 08:28 PM

কাল নরেন্দ্র মোদি পানি ঢেলে দিলেন ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার আগুনে। আক্ষরিক অর্থেই রণপ্রস্তুতির হাঁকডাক এর পর কাল তিনি যুদ্ধকে পরিণত করলেন একটা মেটাফোর এ – তিনি পাকিস্তানকে যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছেন, যে যুদ্ধ হবে দারিদ্র্য আর বেকারত্ব দূরীকরণের। (বিস্তারিত পড়ুন)

যুদ্ধ লাগলে একটা দারুণ গরম খবর হয়তো আমরা পেতাম যেটা নিয়ে বেশ কিছুদিন মেতে থাকতে পারতাম। কিন্তু এই উত্তেজনায় পানি পড়লেও, এই উপমহাদেশ এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয় থেকে বেঁচে গেল, এটার জন্য আমাদের সবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা উচিৎ। একটা পাক-ভারত যুদ্ধ এই গোটা উপমহাদেশকে একটা মৃত্যুকূপে পরিণত করতো, এতে কোন সন্দেহ নেই।

মজার ব্যাপার দুই পক্ষ থেকেই যখন নানা রকম আক্রমণাত্মক কথা বলা হচ্ছিল তখনও কিন্তু অনেক বিশ্লেষক বলছিলেন, এই দুই দেশ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জড়াবে না। কারণটা আমরা সবাই জানি – দুই দেশই এটম বোমার অধিকারী। প্রথাগত অস্ত্রের শক্তিতে ভারত পাকিস্তানের চাইতে অনেকটা এগিয়ে আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু এমন অসম যুদ্ধই এটম বোমা ব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে বহুগুনে – দুর্বল দেশটি চায় ওই অস্ত্র ব্যবহার করে ফলাফল তার পক্ষে নিয়ে আসতে; প্রথাগত অস্ত্রের লড়াইয়ে সে পেরে উঠবে না।

এই পর্যায়ে বলে নেয়া ভালো, ভারত-পাকিস্তান সংকটে কাশ্মীরের উরি তে যা ঘটেছিল, সেটার পেছনে পাকিস্তানের কোন দায় আছে কিনা, কিংবা পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদকে কতোটা মদদ দেয়, অথবা ভারতীয় বাহিনীর কাশ্মীরে বর্বরতা – এসব কোন বিষয়ে আলোচনা এই পোস্টের চৌহদ্দির মধ্যে নেই, সেই আলোচনা করছি না। শিরোনামেই সম্ভবত স্পষ্ট, এই পোস্টের আলোচনার বিষয় ভীন্ন।

ফিরে যাই বেশ কিছুটা আগে, আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধের সময়টায়। ওই সময় পুঁজিবাদী আর সমাজতান্ত্রিক বলয়ের দুই মোড়লের মধ্যকার যুদ্ধটা স্রেফ স্নায়ুতেই সীমাবদ্ধ ছিলো কেন? কারণ দুই দেশেরই অধিকারে থাকা বিপুল সংখ্যার এটম বোমা – যার ছিল অবিশ্বাস্য ধ্বংস ক্ষমতা। যে কোন দেশ চাইলে ঘরে বসেই আরেক দেশকে স্রেফ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ক্ষমতা রাখতো। তাই 'কিউবা মিসাইল ক্রাইসিস' এর মতো অতি উত্তেজনাকর ঘটনা ঘটার পরও আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করেনি, আবার সোভিয়েত ইউনিয়নও উত্তেজনা প্রশমন করার পদক্ষেপ নিয়েছিল।

এটম বোমা পৃথিবীর প্রতি একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবার হুমকি তৈরি করেছে, কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু এটম বোমা পৃথিবীকে অনেক দিক থেকে নিরাপদ করেছে, অনেক যুদ্ধ বিগ্রহ ঠেকিয়েছে এটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা।

এই মুহূর্তেই পাক-ভারত উত্তেজনাও প্রশমিত করলো এটম বোমা দ্বারা আক্রান্ত হবার ভীতি। একইভাবে দীর্ঘদিনের বৈরি দুই দেশ চীন-ভারতও তাদের মধ্যে ভয়ঙ্কর উত্তেজনার ঘটনা ঘটার পরও যুদ্ধে জড়ায়নি ঠিক একই কারণে।

এটম বোমার অধিকারী পাশের অন্য দেশগুলোর কী অবস্থা হচ্ছে সেটা চীন আর ভারতের আশপাশের দেশগুলোর অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। দক্ষিণ চীন সাগরে অন্য কোনো দেশের ন্যায়সঙ্গত দাবী মেনে না নিয়ে চীন তার একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে সেখানে। ভারত নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একচ্ছত্র আধিপত্য হারানোর ভয়ে তরাই অঞ্চলের মানুষদেরকে দিয়ে অবরোধ এর নাটক সাজিয়ে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। ঘটনাটা ঘটিয়েছিল নেপালে ঘটে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের পর পরই। অথচ ভূমি পরিবেষ্টিত দেশ হিসাবে নেপালের ন্যায়ানুগ অধিকার ছিল যে কোন পরিস্থিতিতে সব রকমের সরবরাহ পাবার।

আসি আমাদের দেশের প্রসঙ্গে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত আমাদের সাথে কোনোদিন একটা ন্যায়ানুগ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করতে চেষ্টা করেনি। এখানে এতো বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ কম, কিন্তু এটা স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে যায়, আমাদের দেশকে স্রেফ একটা অলিখিত উপনিবেশ বানিয়ে ফেলার খায়েশ ভারতের। দু'টো বিষয় নিয়ে কথা বলছি। তুচ্ছ অজুহাতে সীমান্তে বছরে গড়ে ৪০ জনকে খুন করা চলছেই (আজও খুন হয়েছে একজন)। অথচ এটাই নাকি ভারতের সাথে আমাদের 'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ' বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। প্রাসঙ্গিক একটা তথ্য, পাকিস্তানের সাথে পাঞ্জাব সীমান্ত দিয়ে ভারতে টন টন হেরোইন চোরাচালান হয় (দেখুন – প্রথম লিঙ্ক, দ্বিতীয় লিঙ্ক ), কিন্তু গুগলে সার্চ করে ওই সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে হাতে গোনা মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়।

ভারতের সাথে আমাদের মূল সমস্যা পানি নিয়ে হবে। অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে ন্যূনতম কোন আন্তরিকতা নেই। এর জেরে এই দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যে ঘটছে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। সাথে যুক্ত হচ্ছে তাদের আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্প। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে, ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়।

গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে নামকাওয়াস্তে একটা চুক্তি আছে, কিন্তু প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে আমরা পত্রিকায় দেখি, পদ্মার বুকে গরুর গাড়ি চলে। অথচ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন চুক্তি 'ইন্দাজ ওয়াটারস ট্রিটি' চলছে কোন সমস্যা ছাড়াই (বিস্তারিত পড়ুন)। ভারত পাকিস্তান বড়/ছোট নানা যুদ্ধে জড়ালেও ভারত কোনোদিন চুক্তি অনুযায়ী পানির হিস্যা না দেয়ার হিম্মত দেখায়নি। কারণটা স্পষ্ট।

সামনেই পানিকে কেন্দ্র করে পৃথিবীব্যাপী অনেক যুদ্ধ হবে, যার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে আছে এই উপমহাদেশ; আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন – এই লিঙ্কে। আমরা কি প্রস্তুত?

শুধু ভারত কেন, আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারের সাথেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের সমস্যা চলছে দীর্ঘকাল থেকেই। এটা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থাও হয়েছিল দুই বার। অনেকেরই হয়তো মনে নেই কয়েক বছর আগেই খবর বেরিয়েছিল মিয়ানমার এটম বোমা বানাতে প্রকল্প হাতে নিয়েছে – দেখুন বিবিসি'র এই রিপোর্ট

এতে সবাই নির্দ্বিধায় একমত হবেনই, এই পৃথিবী যদি একেবারেই পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত থাকতো, সেটাই হতো শ্রেষ্ঠতম অবস্থা। নানা রকম পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস চুক্তির কথা শোনা গেলেও স্বভাবিক কান্ডজ্ঞান বলে এই পৃথিবী এই অস্ত্রমুক্ত হবে না। তাই আমি মনে করি, আরো বেশি দেশের হাতে এটম বোমা থাকে সেটা পৃথিবীকে আরও নিরাপদ করতো, দুর্বল জাতিগুলোকে সবল জাতিগুলোর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতো।

একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বুঝে নেয়া যাক। 'Weapon of mass destruction' আছে এই অজুহাত তুলে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো ইরাক নামের দেশটাকে ছারখার করে দিয়ে কিছুদিন আগে কি স্বীকার করেনি ইরাকের বিরুদ্ধে তাদের ওই অভিযোগ ভুল ছিল? ইরাকের যদি সত্যি সত্যি এটম বোমা থাকতো, আর সেটা দিয়ে আমেরিকার মাটিতে আক্রমণ করার মতো বিমান/মিসাইল থাকত, তাহলে কি আমেরিকা-ইংল্যান্ড এই বর্বরতা চালাতে পারতো এই দেশটার ওপর?

আমি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি, আমাদের এটম বোমা দরকার আছে। জানি, সেই পথে হাঁটা খুব জটিল, কারণ আমরা NPT (Treaty on the Non-Proliferation of Nuclear Weapons) তে অনুস্বাক্ষরকারী একটা দেশ। তাই এই ধরণের কোন অস্ত্র তৈরি করার চেষ্টা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। ওপরে ওপরে এটাকে পারমাণবিক অস্ত্র প্রসার রোধ করার চুক্তি বলা হলেও এই চুক্তি দিয়ে বাঁকি সব দেশকে এই অস্ত্র থেকে দূরে রেখে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারীদের খবরদারি নিশ্চিত করার অভিযোগ ছিল গোড়া থেকেই। ভারত, পাকিস্তান, আর ইজরাইল এই চুক্তিতে কখনও স্বাক্ষরই করে নি। আর উত্তর কোরিয়া স্বাক্ষর করেও এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে।

জানি না, ঠিক কীভাবে আমরা এই পথে এগোতে শুরু করবো, তবে এটা আমি বিশ্বাস করি এটা করতেই হবে। ভারতের পক্ষ থেকে চরম বাধা আসবে জানি – নিজের টাকায় আমরা সাবমেরিন কিনছি, সেটা নিয়ে পর্যন্ত প্রশ্ন তুলছে তারা! (বিস্তারিত পড়ুন)। আমাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে তারা কীভাবে দেখে তার একটা উজ্জ্বল নমুনা এটা। প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক অবশ্যই চাই আমরা, কিন্তু সেটা হতে হবে মর্যাদার ভিত্তিতে, ন্যায্য অধিকার ছেড়ে দিয়ে নয়।

ভারতের মতো ভয়ঙ্কর আধিপত্যবাদী একটা রাষ্টের পাশে থেকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হলে, ন্যায্য বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পেতে হলে আমাদের ওই বোমাটা লাগবেই, এই ব্যাপারে আমার আর কোন সংশয় নেই। ওই বোমাটাকে আমি মোটেও যুদ্ধাস্ত্র হিসাবে দেখি না, দেখি শান্তি রক্ষাকারী হিসাবে। এজন্যই স্নায়ুযুদ্ধকালীন আমেরিকা পারমাণবিক ওয়ারহেডবাহী তাদের সবচাইতে শক্তিশালী আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর নাম যখন দেয় 'Peacekeeper', তখন সেটা আমার কাছে দারুন যৌক্তিক বলে মনে হয়।