পূজায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা: গরু মেরে জুতা দান

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 9 Oct 2016, 09:41 PM
Updated : 9 Oct 2016, 09:41 PM

এটা এক নতুন প্রপঞ্চ – পূজা আসলেই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান, এরপর আসেন সংবাদ সম্মেলনে। সেই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বুক ফুলিয়ে আমাদের জানান পূজায় কতো স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, কতোটা নিশ্ছিদ্র হয়েছে পূজার নিরাপত্তাব্যবস্থা (বিস্তারিত পড়ুন)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীরাও শোনান এসব কথা। অবশ্য শুধু পূজার কথা বলছি কেন, ঈদও যুক্ত হয়েছে এখন 'নিরাপত্তার চাদরে' ঢাকা পড়া উৎসবের তালিকায়। এমনকি আশুরায় শিয়া সম্প্রদায় তাজিয়া মিছিলে তাদের নিজকে ক্ষতবিক্ষত করে আহাজারি করার রিচুয়ালটিও আপাতত পালন করতে পারবে না, কারণ এবার মিছিলে যে কোন ধারালো অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ।

জানি, যে কেউ বলবে দেশের এই পরিস্থিতিতে পূজামণ্ডপে এই দারুণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া ভীষণ জরুরী। এর সাথে আমারও দ্বিমত নেই একেবারেই। বিশেষ করে যখন দেশে হিন্দু ধর্মের বেশ কিছু মানুষ (এদের মধ্যে মন্দিরের পুরোহিত-সেবায়েত আছে) গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন গত দেড় বছরে। কিন্তু আজ এই পূজাসহ ধর্মীয় উৎসবগুলোতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলো নিয়ে জনগণকে জানিয়ে দারুণ কৃতিত্ব নেয়ার চেষ্টাটা দেখলে ভীষণ ক্ষুদ্ধতা তৈরি হয়।

ফিরে যাই আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগে। দুর্গাপূজার সময় মণ্ডপের বাইরে দেখা যেতো অলস ভঙ্গিতে দুই/তিন জন পুলিশ থাকতেন; বোঝাই যেতো ওটা একরকম নিয়ম রক্ষার জন্যই। কিন্তু মানুষ এর মধ্যেই নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে পূজা পালন করতেন। অথচ আজ সেটা আমাদের কল্পনাতীত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে!

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে (বিশেষ করে বিএনপি'র গত সরকারটি ক্ষমতায় আসার পর থেকে) এই দেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের দারুণ প্রসার ঘটছে। ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন, জামাতের মতো ধর্মভিত্তিক দলকে নিয়ে বিএনপি, কিংবা এই দেশে সেক্যুলারিজম এর কথিত ধারক ও বাহক আওয়ামী লীগ – "
ফলাফল "যেই লাউ, সেই কদু"। এই দেশে "ধর্ম কার্ড" খেলেছে দুই দলই, আর সাথে সুশাসনের অভাব তো ছিলোই সরকারের সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে একেবারে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত – এসব বিষয় দিনে দিনে এই দেশকে করে তুলেছে জঙ্গিবাদ তৈরি হবার উর্বর ভূমিতে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর এটাই বলতে চেয়েছিলাম এই ব্লগেও (ঢাকায় জঙ্গি হামলাঃ মর্মাহত, শঙ্কিত কিন্তু অবাক নই)।

আর এই 'ধর্ম কার্ড' খেলতে খেলতে সমাজের বেশ কিছু মানুষের মধ্যে এক বিভৎস সাম্প্রদায়িক মানসিকতা তৈরি হয়েছে। এমনকি তথাকথিত সেক্যুলার দলটির 'রাজত্ব' এর সময় আমরা এক টাউট এরশাদের করা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম'কে রক্ষা করতে দেখি; দেখি কখনও খেলাফত মজলিশ এর সাথে চুক্তি, কখনও বা হেফাজতের সাথে খাতির। আমরা এটাও শুনি এই দেশ চলবে 'মদীনা সনদ' অনুযায়ী। আর আওয়ামী ওলামা লীগ তো যা বলছে, সেটা শুনে হেফাজতে ইসলামও লজ্জা পায়। সাথে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত ভোটব্যাংক হিন্দু মানুষরা এই দলের সরকারের সময়ই সম্পত্তি বেদখল হবার মতো ঘটনার শিকার হয়েছে দফায় দফায়। আমরা ভুলে যাইনি নিশ্চয়ই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই এর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আছে।

সাথে যুক্ত হয়েছে বরাবরের মতো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। রামুতে ঘটে যাওয়া অত্যন্ত বর্বর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার বিচারের কোন অগ্রগতি নেই। এটা নিয়ে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার এর সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু'র হতাশা পরে দেখতে পারেন এই লিখায় (রামু সহিংসতার চার বছর: একটি অপ্রিয় সত্যপাঠ)। অতি নিকট অতীতে দেখতে পাই নারায়ণগঞ্জের অতি প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান সেলিম ওসমান একজন হিন্দু শিক্ষক শ্যামলকান্তি'র বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ দিয়ে প্রকাশ্যে হাজার হাজার লোকের সামনে কান ধরে উঠবস করান। অথচ কিছুদিন আগে দেয়া রিপোর্টে পুলিশ বলে ওই ঘটনায় সেলিম ওসমান এর কোন দায় নেই! (বিস্তারিত পড়ুন)।

আমি দৃঢ়ভাবেই মনে করি দেশটাকে লুট করে অসীম সম্পত্তি বানানোর জন্য স্রেফ যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া আর যে কোন মূল্যে সেটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই দেশের দলগুলো যা করেছে, তাতে কিছু মানুষের মধ্যে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি ভয়ঙ্কর বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে। অথচ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক চমৎকার উদাহরণ ছিল এই দেশ! আর আজ ধর্মীয় উৎসবগুলো পালন করতে হয় 'নিরাপত্তার চাদরে' ঢাকা থাকা অবস্থায়। এসব কথা আবার বলা হয়, গলা চড়িয়ে, বুক ফুলিয়ে, গর্বের ভঙ্গিতে। এসব কথা বলার সময় মনে মনে বলি তাদের – গলার স্বর নীচু করুন; এসব লজ্জার কথা, ব্যর্থতার কথা নিচুস্বরে বলতে হয়। অবশ্য আমাদের দলগুলোর লজ্জা, ব্যর্থতার বোধ আছে, এটা মনে করার মতো আহাম্মক নই আমি।

একটা অসাধারণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমাজকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়ে আমাদের দলগুলো আমাদের শোনায় "নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা" গ্রহণ করার কথা! "গরু মেরে জুতা দান" প্রবচনটি বাংলায় কেন আছে, বুঝলাম আরেকবার।
Facebook: https://www.facebook.com/zahed.urrahman.77