পুলিশের সাম্প্রতিক ‘আবদার’ এবং ক্ষমতার বহুল চর্চিত উক্তি

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 25 Jan 2017, 09:13 PM
Updated : 25 Jan 2017, 09:13 PM

'পুলিশি রাষ্ট্র' শব্দযুগলের আদিতম ব্যবহার প্রায় পৌনে দুইশ বছর আগে দেখা যায়, তখন এর মানে ভালোই ছিল – একটা রাষ্ট্রে পুলিশি শক্তি ব্যবহার করে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই শব্দযুগলের অর্থ derogatory হয়ে ওঠে; এখন 'পুলিশি রাষ্ট্র' বলতে আমরা এমন এক রাষ্ট্রকে বুঝি, যেখানে সরকার পুলিশের মাধ্যমে স্বেচ্ছাচারী, জবাবদিহিতাহীন বল প্রয়োগ করে তার কর্তৃত্বপরায়ণ ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। একটা পুলিশি রাষ্ট্রের নাগরিকগণ তাদের ভিন্নমত (বিশেষ করে রাজনৈতিক) প্রকাশের ক্ষেত্রে, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের মুক্ত চলাচলের ক্ষেত্রেও বাধা অনুভব করেন। পুলিশি রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনায় ফিরে এসেছি আবার, তার আগে দুইদিন আগে মিডিয়ায় আসা একটা খবর নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

প্রতি বছরের মতো ঘটা করে পুলিশ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে, যার উদ্বোধন বরাবরের মতো করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এখন আরেকটা প্রাসঙ্গিক তথ্য সম্ভবতঃ আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝাতে সাহায্য করবে। পুলিশ সপ্তাহ হোক, কিংবা জেলা প্রশাসক সম্মেলন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি একেবারেই নিশ্চিত, কিন্তু কিছুদিন আগেই বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকার লিখিত সম্মতি দিয়েও যাননি সেখানে। এখানে আরেকটা তথ্যও যুক্ত করে রাখি, বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতি সত্যিকার স্বাধীন বিচার বিভাগ গঠনে বাধা হিসাবে বিচার প্রশাসনে দ্বৈত শাসন এবং এই সংক্রান্ত সংবিধানের একটা ধারা নিয়ে বেশ প্রতিবাদী। কিছুটা কান্ডজ্ঞানই আমাদের এর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেবে বলে আশা করা যায়।

এবার আসি সেই প্রসঙ্গে যেটা আজকের এই লিখাটা লিখতে আমাকে আগ্রহী করেছে। এবারের পুলিশ সপ্তাহে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে পুলিশের নানা পর্যায়ের সদস্যরা তাদের নানা দাবিদাওয়া পেশ করেছেন। এর মধ্যে একটা দাবি হলো ('দাবি' না বলে এটাকে 'আব্দার' বলাই ভালো) – 'নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন- ২০১৩' বাতিল করা। (বিস্তারিত পড়ুন)

নানা বিষয়ে পড়াশোনা করার এক ধরণের অভ্যাস (কিংবা বাতিক) আছে আমার। কিন্তু সংবিধান এর বাইরে সিরিয়াসলি কোনোদিন আইন পড়ার চেষ্টা করিনি। তবে পরশু পুলিশের এই দাবির পর এই আইনটা পড়লাম মন দিয়ে (আগ্রহী যে কেউ পড়ে নিতে পারেন এখানে)। পড়লে সবাই অবাক হবেন, এই চমৎকার মানবিক, মানবাধিকারকে সুরক্ষাদানকারী আইনটি বাতিল করার প্রশ্ন কেন আসছে?

এই প্রশ্নের জবাব আছে বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার কৌশলের মধ্যে। ২০১৪ সালের 'নির্বাচন' এর পর নৈতিকভাবে অবৈধ সরকারটি টিকে আছে দেশে বিদেশে ক্ষমতার নানা বলয়কে সন্তুষ্ট করে। এর প্রমাণ হিসেবে আমরা দেখি আমাদের দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নানাভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে তুষ্ট করা হচ্ছে। আবার ওদিকে দেশের ভেতরে ক্ষমতার বলয়, সামরিক, বেসামরিক প্রশাসনকে যে কোন মূল্যে তুষ্ট করে যাবার চেষ্টাও দেখছি আমরা। আর বলাই বাহুল্য এই মুহূর্তে এই সরকারটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য দেশের অভ্যন্তরে পুলিশ বাহিনীই সবচাইতে বড় ভূমিকা পালন করছে। তাই পুলিশ বাহিনী এখন চাইবেই সব ক্ষেত্রেই তার সুবিধা বাগিয়ে নিতে।

নিকট অতীতে আমরা দেখেছি পুলিশ নানা ব্যবসায় করতে চাইছে। কিছুদিন আগেই তাদের ব্যাংক চাওয়ার পরও আমরা কেউ উচ্চবাচ্চ করিনি। মাত্রই বিজিবি কে সীমান্ত ব্যাংক নামের ব্যাংক এর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অনুমান করি পুলিশও পেয়ে যাবে সহসাই। ওদিকে আমাদের সেনাবাহিনী তো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো দেশের সর্ববৃহৎ কর্পোরেট হাউজ হবার পথে অনেকটা এগিয়েই গেছে। নানা ক্রাইসিসে কথা বলতে বলতে আমরা দেশের আইন শৃংখলা বাহিনীগুলোর এই ব্যবসায়িক কর্মকান্ড নিয়ে প্রশ্ন করতে ভুলেই যাই। যাক থাকুক এই আলোচনা আপাতত।

২০১৪ সালের পর জনগণের ম্যান্ডেটহীন সরকারটি বিরুদ্ধ মত দমন করার জন্য যাচ্ছেতাইভাবে পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করছে। বিএনপি'র কথা বাদই দেই, স্বপ্নেও সরকারের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে না এমন সব সংগঠনের কর্মকান্ডকে চরমভাবে বাধা দেয়া হয়েছে। ওদিকে গুম আর বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাবের সাথে নিয়মিত পুলিশ বাহিনীর নাম যুক্ত হয়েছে বেশ ভালোভাবেই। আর মানুষকে নানাভাবে বিপদে ফেলে, নির্যাতন করে অর্থ দাবি করার আদি অভিযোগ তো রয়েছেই।

এই দেশে একটা আইনের অস্তিত্ব থাকা মানেই কি অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হওয়া? এই দেশে বসবাসকারী মানুষ হিসাবে আমরা তো ভালোভাবেই জানি আইনের 'লম্বা হাত' যাচ্ছেতাই রকমের ছোট হয়ে যায়, যখন সেটা একজন ক্ষমতাবানকে ছুঁতে যায়। পুলিশের হেফাজতে নির্যাতন আর মৃত্যু নিরোধে এই থাকলেও কয়জন মানুষের এমন 'বুকের পাটা' আছে যে তারা পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করে লড়ে যাবে ন্যায়বিচারের আশায়? আমরা কি এই দেশেই দেখিনি র‍্যাবের গুলিতে পঙ্গু লিমনকে র‍্যাবের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে প্রকাশ্যে পরামর্শ দিয়েছিলেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারপার্সন, ওই ব্যক্তিই দীর্ঘদিন লিমনের পক্ষে লড়াই করেছিলেন, সাথে সারা দেশের সব মিডিয়ার দুর্দান্ত সমর্থন তো ছিলোই। না, লিমন তার পা হারানোর বিচার পায়নি।

পুলিশকে সম্ভবত কিছুটা টেনশনে ফেলেছে হাইকোর্টের আপিল বিভাগের একটা রায়। তাঁদের বয়ানেই শোনা যাক – "সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক রায়ে পুলিশের বিরুদ্ধে এ আইনের অধীনে তদন্তকারী কর্মকর্তা, অফিসার ইনচার্জ বা কমান্ডিং অফিসারের বিরুদ্ধে সুয়োমোটো মামলা নেওয়ার জন্য বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ আইনে একাধিক থানার ওসিসহ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা রুজু হয়েছে।"

বিষয়টা এবার স্পষ্ট হলো – এই দেশের জনগণের ঘাড়ে দুইটা মাথা নেই, তাই পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস হবে না কারো, কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পরামর্শমত বিচারিক আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করতে শুরু করলে তো পুলিশের কিছুটা হলেও 'খবর আছে'। ওই পুলিশ কর্তার বয়ান মতো সেরকম মামলা শুরুও হয়ে গেছে। এই দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়কে জনগণের অধিকার রক্ষার একটা বিজয় বলে মনে করি আমি, এজন্য আপিল বিভাগকে ধন্যবাদ জানাই।

খবরে জানা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপাতত এই আইন বাতিল করার 'আব্দার' নাকচ করেছেন। আইনটি বাতিল হোক বা না হোক এই আইন বাতিল করার দাবি এটা প্রমাণ করে পুলিশ বাহিনী সকল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকতে চায় (নিজস্ব কিছু বিভাগীয় ব্যবস্থা ছাড়া)।

ফিরে আসি পুলিশি রাষ্ট্রের কথায়। শুরুর অনুচ্ছেদে আলোচিত পুলিশি রাষ্ট্রের সংজ্ঞা এবং বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলিয়ে দেখলে আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার সাথে কি খুব আলাদা কিছু দেখা যায়? সাথে যুক্ত করি – ওই রিপোর্টেই দেখা যায় জনৈক নারী পুলিশ সদস্যের এক দাবির জবাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন "আমিও চাই আমার পুলিশ যখন ডিউটি করবে, স্মার্টলি দায়িত্ব পালন করবে"। কেউ কেউ বলতে পারেন 'আমার পুলিশ' বলাটা এক ধরণের আন্তরিকতার প্রকাশ; আমি মানি না, আমার বিচারে এটা অসতর্কতাবশতঃ অবচেতনের বহিঃপ্রকাশ। এর মানে…..

'পুলিশি রাষ্ট্রে', হোক সেটা সম্পূর্ণ কিংবা প্রায়, পুলিশ বাহিনী অসীম ক্ষমতাভোগী হয়; থাকতে চায় জবাবদিহিতার উর্দ্ধে। তাদের সাম্প্রতিক 'অব্দারে' সেটাই প্রমাণিত হলো। এটাই হবার কথা ছিলো কারণ ক্ষমতা নিয়ে বহুল চর্চিত Lord Acton এর উক্তিটা জানি আমরা – "Power tends to corrupt and absolute power corrupts absolutely."