প্রিয় দেশবাসী, আসুন গার্মেন্ট মালিকদের দেই আমাদের প্রদেয় যাকাত

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 14 June 2017, 07:56 PM
Updated : 14 June 2017, 07:56 PM

এই দেশের গার্মেন্ট মালিকরা ভালো আছেন, এটা কি কেউ শুনেছেন কখনও? যখনই কর্মীদের মজুরি বৃদ্ধির কথা আসে তখন তারা সমস্বরে বলে ওঠেন তারা নাকি কোনোরকমে টিকে আছেন, মজুরি ন্যূনতম বাড়ালে তারা আর টিকে থাকতে পারবেন না। ওদিকে প্রতি বছর বাজেট ঘোষণার সময় হলে তারা যা যা দাবি (এগুলোকে আবদার বলাই ভালো) করেন, সেগুলো দেখলে তো মনে হয়, কেন যে তারা ব্যবসা করছেন এতো লস দিয়ে!

কিন্তু বাস্তবতাটা ভিন্ন, ক্রমাগত বাড়ছে এদের ব্যবসা; বাড়ছে এতোটাই যে দেশে রাজকীয় জীবনযাপনের সাথে সাথে ওভার/আন্ডার ইনভয়েসিং আর হুন্ডি করে পাচার করার মতো হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের হাতে থেকে যাচ্ছে। হ্যাঁ, এই দেশ থেকে যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে এর বিরাট একটা অংশ করছেন গার্মেন্ট মালিকরাই।

কথাগুলো মনে পড়ার একটা উপলক্ষ্য আছে। সদ্য প্রস্তাবিত বাজেটকে মাথায় রেখে বিজিএমইএ বরাবরের মতো কিছু আবদার করেছে সরকারের কাছে। সেগুলো হলো – ১. আগামী দুই বছরের জন্য ৫ শতাংশ নগদ সহায়তা প্রদান ২. রফতানিতে উৎস কর শূন্য শতাংশ করা ৩. পোশাক শিল্পের কর্পোরেট কর হার ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। (বিস্তারিত পড়ুন)

ফিরে যাই, ২০১৩ সালে, যখন গার্মেন্ট শ্রমিকদের সর্বশেষ মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছিলো। মনে আছে মালিকপক্ষ এই বৃদ্ধির প্রচন্ড বিরোধিতা করেছিলেন এই বলে যে এটা করা হলে তাদের ব্যবসা লাটে উঠবে। বলা বাহুল্য এর পর তাদের ব্যবসা লাটে না উঠে উঠেছে আকাশে; ক্রমাগত বেড়েছে তাদের ব্যবসা। মানে, এটা প্রমাণিত, শ্রমিকদের বিদ্যমান মজুরির চাইতে বেশি টাকা দিয়েও এই ব্যবসায় টিকে থাকা যায়, উন্নতি করা যায়। যদিও এটা স্পষ্টভাবেই জানি, সামনে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির কথা তোলা হলেই মালিকরা তাদের ব্যবসা লাটে ওঠার অজুহাত দিয়ে সেটা ঠেকানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু এটাও নিশ্চিত, মজুরি এখনকার চাইতে বাড়ালেও গার্মেন্ট মালিকরা দিব্যি ব্যবসা করে যেতে পারবেন বেশ ভালোভাবেই।

এর প্রমাণ হতে পারে ভিয়েতনাম, যেটা আর্থসামাজিক নানা সূচকে আমাদের দেশের সাথে তুলনীয়। এই সেক্টর নিয়ে যারা কিছুটা খোঁজখবর রাখি, তারা জানি, ভিয়েতনাম এই খাতে আমাদের সবচাইতে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আবির্ভুত হয়েছে, যারা এক সময় আমাদের চাইতে অনেক পেছনে ছিলো। এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ভিয়েতনাম তাদের ইন্ডাস্ট্রি এতো দ্রুত এতোটা এগিয়ে নিতে পেরেছে তাদের শ্রমিকদের আমাদের দেশের তুলনায় কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ বেশি মজুরি দিয়ে! ভিয়েতনাম তাহলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকছে, এবং এতো উন্নতি করছে কী করে?

বাংলাদেশে কর্পোরেট কর হার খাতভেদে ৩৭.৫ থেকে ৪২.৫ শতাংশ। কিন্তু গার্মেন্টে এটা অর্ধেক, মাত্র ২০ শতাংশ, যা এক বিরাট প্রণোদনা। কিন্তু এতেও তাদের পোষাচ্ছে না, এটাকে ১০ শতাংশ করার আবদার করা হয়েছে, এবং এই বাজেটে তাদের আবদারের অর্ধেক পূরণ করে কর্পোরেট কর হার ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। একটা সংসদের সদস্যদের বেশিরভাগ যখন কোনো না কোনোভাবে গার্মেন্ট ব্যবসায়ের সাথে জড়িত থাকে তখন মালিকদের অন্যায় আবদার পূরণ করারই কথা। তীব্র প্রতিবাদ জানাই এই কর হ্রাসের।

যাবতীয় আবদার করার সময় নিয়মিত দুইটি কমন রেকর্ড বাজান গার্মেন্ট মালিকরা – ১) রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন ২) কর্মসংস্থান করেছেন। প্রতি বছর খুব ঘটা করে আমাদের জানান কতো বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছেন তারা। কিন্তু আমাদের দেশের খুব বেশি সংস্থা আমাদের এটা জানায় না, কতো বৈদেশিক মুদ্রা আবার নানা জিনিস আমদানিতে খরচ করছেন। সব বাদ দিলে গার্মেন্টে নিট মূল্য সংযোজন ২০-২৫ শতাংশের বেশি নয়, এটা কিছু অর্থনীতিবিদ হিসাব করে দেখিয়েছেন। তাই তাদের রপ্তানি আয়কে ৪/৫ দিয়ে ভাগ করে প্রকৃত অংকটা দেখিয়ে দিলেই তাদের গলার চড়া স্বর নিচু হয়ে আসতে বাধ্য। এই দেশের বৈদিশেক মুদ্রার রিজার্ভের যে ফুটানি আমরা দেখাই, সেটা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স দিয়ে। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত আর দরিদ্র পরিবারের ওই সন্তানরা গার্মেন্ট মালিকদের তুলনায় নেহায়েতই 'নিচুজাত' তাই তাদের কথা কেউ বলে না। প্রাসঙ্গিকভাবে যখন এঁদের কথা এলোই, এই সুযোগে দেশের জন্য অসাধারণ অবদান রাখা এই মানুষগুলোকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই।

আসা যাক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার কথায়। এই দেশের অসংখ্য মানুষের কর্মহীনতাকে পুঁজি করে তাদের শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য শুষে নিজেরা ফুলেফেঁপে ওঠার মানে আর যাই হোক, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা নয়। যদি এগুলো কর্মসংস্থানই হতো তবে এই মানুষগুলো তো খেয়ে পরে একটু ভালো জীবনযাপন করতে পারতো। ২০১৩ সালে মজুরি বৃদ্ধির পরও কি শ্রমিকরা আদৌ ভালো আছেন? এতো ভয়ঙ্কর পরিশ্রমের পর তারা অন্তত দারিদ্র্যসীমার উপরে জীবনযাপন করবে, এটা কি আমাদের প্রত্যাশা হতে পারতো না? কিন্তু সেটা কি তারা করতে পারছে?

আসুন দেখি 'লিভিং ওয়েজ রিপোর্ট ঢাকা, বাংলাদেশ অ্যান্ড স্যাটেলাইট সিটিজ; কনটেক্সট: দ্য গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি' শীর্ষক প্রতিবেদনটি কী বলছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সোস্যাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অ্যাক্রেডিটেশন অ্যান্ড লেবেলিং (আইএসইএএল)-এর আওতায় গ্লোবাল লিভিং ওয়েজ কোয়ালিশনের জন্য তৈরি করা হয়েছে এটি। ওই রিপোর্টে দেখা যায়, শিক্ষানবিশ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই আসে না, মোট সাতটি গ্রেডের মধ্যে সর্বোচ্চ দুইটি গ্রেড ছাড়া বাঁকি পাঁচটি গ্রেডের শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো ঢাকার দারিদ্র্যসীমার নীচে। ওই রিপোর্টেই লক্ষণীয় ব্যাপার হলো আমাদের দেশের উৎপাদন, নির্মাণ, কৃষি ও মৎস্য খাতের শ্রমিকদের মজুরি গার্মেন্ট শ্রমিকদের চাইতে বেশি এবং তাঁদের মজুরির হার দারিদ্র্য সীমার ওপরে।

এটা আমরা আগেও দেখেছি, এই সেক্টরের শ্রমিকরা যতোই বলুক না কেন, তাদের মজুরি বাড়াতে মালিকরা রাজি হয় না। দেশের নাগরিক সমাজ প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করলেও সেটায় কাজ হয় না। আমরা মনে করতে পারি নিশ্চয়ই, অনেক গার্মেন্টে অগ্নিকান্ডের পর যখনই কারখানার নিরাপত্তার মানের উন্নয়ন নিয়ে কথা হয়েছে, তখন তাতে গার্মেন্ট মালিকরা কর্ণপাত করেনি। কিন্তু রাজা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গার্মেন্ট ক্রেতাদের সংগঠন অ্যাকর্ড আর এলায়েন্স এর চাপে মালিকরা অনেক কিছুই করেছিলেন। এবার তো ই ইউ চাপ দিচ্ছে গার্মেন্টের শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে (বিস্তারিত পড়ুন)। এবার কী বলবেন মালিকপক্ষ?

গার্মেন্ট মালিকরা ভালো নেই, এমন কথা নানা পরিস্থিতিতে তারা ক্রমাগত বলে যাবার পেছনে উদ্দেশ্য দু'টো – সরকারকে যতোটা সম্ভব কম কর দেয়া আরা নানা সুবিধা বাগিয়ে নেয়া, এবং যতদিন সম্ভব শ্রমিকদের ওপর শোষণ জারি রেখে ব্যবসার নামে এক ধরণের লুটপাট চালিয়ে যাওয়া। আসলে তারা ভীষণ ভাল আছেন, প্রাসাদোপম গার্মেন্ট কারখানাগুলো তাদের সম্পদের ঘোষণা দেয় উচ্চস্বরে। আগেই বলেছি তাদের সম্পদ এতোটাই যে, বিদেশে টাকা পাচার করার তালিকায় তাদের অবস্থান সবার ওপরে। জানি তবুও তারা তাদের খারাপ থাকার কথা বলতেই থাকবেন। তাহলে উপায়?

একটা উপায় বাতলাতে পারি আমি। রমজান মাস চলছে। এই মাসে যাবতীয় সব ইবাদতের সওয়াব বেশি পাওয়া যায় বলে মুসলিমরা এই সময় বেশি ইবাদত করেন। এই কারণেই বিশেষত রমজান মাসে মানুষের যাকাত দেবার প্রবণতা বেশি থাকে। তাই আসুন দেশবাসী, এই মাসে দেশের 'সেবা' করতে গিয়ে দুঃস্থ হয়ে পড়া গার্মেন্ট মালিকদের আপনাদের প্রদেয় যাকাত দেই। তাদের বাঁচাই।