আমাদের ‘ক্রীতদাসী’রা আর বিজিএমইএ এর একটি চিঠি

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 9 April 2012, 10:19 AM
Updated : 9 April 2012, 10:19 AM

কয়েকদিন আগে একটা খবর পড়ে মনে পড়লো মাস ছয়েক আগে একজন 'ক্রীতদাসী'র সাথে কথোপকথনের কথা। ওর নাম জমিলা, বয়স ২৩/২৪ হবে। গ্রামে ভিটেমাটি আছে, একটা ঘরও আছে। টানাটানির সংসার। ওর বিয়ে হয়েছিল একবার, তারপর স্বামী যৌতুকের টাকা পেয়ে আর কিছুদিন মৌজ করে (ওর ভাষায়) চলে যায় ওকে ফেলে। দারুন আত্মসন্মানবোধসম্পন্ন মেয়ে ও, স্বামী নামের ওই বর্বরের পা ধরতে যায়নি। নিজে কিছু কাজ করতে শুরু করলো মানুষে বাসায়। পেত সামান্য কিছু টাকা। ওই টাকায় বাবার কিছু সাহায্য হয়, কিন্তু অনটন আর কমে না।

তারপর একদিন সিদ্ধান্ত নেয় শহরে গিয়ে কাজ করবে, নিজে কোন রকম করে চলে বাড়িতে টাকা পাঠাবে। চাকুরী নেয় গার্মেন্টসে – দুই বছর চাকুরীর পর বেতন পায় ৩৫০০ টাকা। বস্তির ঘর ভাড়া, আর তিন বেলা কোনরকমে পেট ভরাতে তার খরচ হয় ৩২০০ টাকা থেকে ৩২৫০ টাকার মধ্যে। প্রচন্ড জর নিয়ে হেঁটেই কাজে গেছে অনেক দিন; ওই দিনগুলোতেও রিকশা দূরে থাকুক বাসেও ওঠেনি সে। খায়নি গার্মেন্টসের কর্মীদের 'বিলাসী' খাবার শর্মা বানানোর জন্য ভাল মাংস তুলে নেয়ার পর বিক্রি করা মুরগীর সামান্য মাংসযুক্ত কঙ্কাল। যে মাসে ওর সাথে কথা হল, সেই মাসে ওর নিজের খরচ বাদ দিয়ে হাতে ছিল ২৮০ টাকা।

ভাবছেন ক্রীতদাসী কই? ক্রীতদাসী আমাদের জমিলা। কী পার্থক্য আছে জমিলার সাথে একজন ক্রীতদাসীর? ক্রীতদাসীর চাইতে তার কাজের চাপ বেশী, কাজের যায়গা দূরে। মজার কথা এদেরও অনেকের জীবনেই আছে ক্রীতদাসীদের জন্য 'ফ্রি' যৌন হয়রানীও। ভাবলাম একটা পার্থক্য আছে কমপক্ষে, সেটা হল এরা চাকুরিতা অন্তত ছেড়ে দিতে পারে নিজের ইচ্ছেমত, যেটা ক্রীতদাসী পারে না। কিন্তু আমার ভুল ভাঙল এটা শুনে যে সেই স্বাধীনতাও অনেক ক্ষেত্রেই নেই তাদের। চাকুরী ছেড়ে চলে গেলে ভীষণ রকম সমস্যা হবে বলে নানা রকম ভয়ভীতি দেখানো হয় তাদের। এছাড়াও এরা প্রায় প্রত্যেকেই আরেকজন কর্মীর রেফারেন্স নিয়ে চাকুরীতে ঢোকে; তাই চলে গেলে ওই রেফারেন্স দেয়া কর্মীর সমস্যা করে মালিকপক্ষ। এটাও তাদেরকে চাকুরী ছাড়তে দেয় না। ও আচ্ছা একটা পার্থক্য আছে এখনো, মালিক চাইলেই এদেরকে অন্য কারখানায় বিক্রী করে দিতে পারে না। ক্রীতদাসী শব্দটার কর্কশতাকে একটা স্নিগ্ধ পরশ দিয়েছেন আমাদের বিখ্যাত শিল্পী জেমস – আদর করে ওদের নাম দিয়েছেন 'সেলাই দিদিমনি'।

এবার আসি সেই খবরটার প্রসঙ্গে। গত বৃহস্পতিবার দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকার খবরটা হল, লিঙ্ক। এমন খবর পড়ে একসময় স্তম্ভিত হতাম, বিবমিষা হত; কিন্তু এখন আর হয় না, সেদিনও হয়নি। অবাক হই ভেবে, দেখে যে এই দেশের পুঁজিপতিদের নোংরামী, অমানবিকতা আর নির্মমতা এখন আমাকে ন্যুনতম অবাক করে না।

আসল কথায় আসা যাক। এদেশের শ্রম আইনে বলা আছে শিল্পকারখানার মালিকের লাভের শতকরা ৫ ভাগ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। ২০০৬ সাল থেকেই এই আইন ছিল, কিন্তু না মানলে শাস্তির বিধান ছিল না। এখন সরকার চাইছে এই আইন না মানলে শাস্তির বিধান সংযুক্ত করতে। এতেই আঁতে ঘা লেগে গেছে আমাদের অর্থনীতিকে 'উদ্ধার' করা গার্মেন্টস মালিকদের। তাই বিজিএমইএ এর প্রেসিডেন্ট পাট ও বস্ত্র মন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন গার্মেন্টস শিল্পের জন্য আলাদা আইন করার জন্য যেখানে ৫% শ্রমিকদের জন্য রাখার বাধ্যবাদকতা থাকবে না।

খেয়াল করার ব্যাপার হল দেয়ার কথা মুনাফার অংশ, বিক্রির না। আর ন্যুনতম খোঁজ-খবর রাখা মানুষজন ভালভাবে জানেন, এই দেশের কোম্পানীগুলো কীভাবে অডিট ফার্মগুলোর সহায়তায় মূল মুনাফার অতি সামান্য অংশ মুনাফা হিসাবে দেখায় – আয়কর ফাঁকি দেবার জন্য। সেই দেখানো সামান্য মুনাফার ৫% ও তারা শ্রমিক কল্যান ফান্ডে দিতে প্রস্তুত না! আমরা এই সমাজের কিছু পেশার মানুষের দুর্নীতি নিয়ে খুব কথা বলে থাকি, কিন্তু আমরা, অনেক শিক্ষিত মানুষই জানি না বেশীরভাগ অডিটরদের দুর্নীতির কথা, যার মাশুল আমাদের পুরো জাতি, রাষ্ট্র দেয়। কীভাবে দেয় সেটা অন্য আলোচনা, আজ থাক – আরেকদিন করা যাবে।

গত ২০ বছরে বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের 'ঠ্যাক' দিয়ে গার্মেন্টস শিল্প মালিকরা যা যা সুবিধা নিয়েছেন তার একটা ছোট ফিরিস্তি এরকম – সাত হাজার ৪২৪ কোটি টাকার নগদ সহায়তা, একলক্ষ কোটি টাকার বেশী শুল্কমুক্ত আমদানী সুবিধা, বিদুৎ বিলে ভর্তূকি, বীমা রেটে ভর্তুকি, মাত্র ৭ শতাংশ সুদে ঋন, মন্দার সময় দুই হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা, ডাউন পেমেট ছাড়াই খেলাপী ঋন পুনঃতফসিল করা, ২৭০ টি রুগ্ন ও বন্ধ কারখানার ব্যাংক ঋনের সম্পূর্ণ সুদ মওকুফ। এগুলো হল সরকারের কাছ থেকে 'আদায়' করা বড় সুবিধাগুলো; ছোটগুলো আর অবৈধগুলোর কথা নাই বা বলা হল। ক্রীতদাসীগুলো যেন যখন তখন ফুঁসে উঠতে না পারে সেজন্য তাদেরকে 'ডান্ডা মেরে ঠান্ডা' করার জন্য এখন আবার দাবী উঠেছে তাদের জন্য বিশেষ পুলিশ বাহিনী 'ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পুলিশ' গঠন করার। ওটাও হয়ে যাবে নির্ঘাৎ।

মনে পড়ে বেশ কিছুদিন আগে সরকার যখন গার্মেন্টস কর্মীদের ন্যুনতম মজুরি বাড়ানোর চেষ্টা করছিল তখন মালিকরা মজুরী না বাড়ানোর জন্য মিটিংয়ে এসেছিলেন। তখন কোন এক পত্রিকার রিপোর্ট করে দেখিয়েছিল মিটিংস্থলের বাইরে, পাজেরো, প্রাদো, লেক্সাস, আর বিএমডব্লিউ এর মেলা বসে গিয়েছিল। অথচ ন্যুনতম ব্যয় বাড়লে নাকি এই শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে! আর এদের ভাব দেখলে মনে হয় এরা এমনিতেই এসব করছে; এটা তাদের জনসেবা, ব্যবসা না।

আসি আবার আমাদের ক্রীতদাসিদের কথায়। বিদেশে কর্মরত কর্মী আর লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাসীর জীবন দিয়ে দেয়া শ্রমে-ঘামে আমরা আমাদের মার্কেটগুলো ভরিয়ে ফেলেছি। বিলাসী পণ্য খেয়ে পরে আমাদের সে কী ফুটানী! আমাদের নিজেদের ওপর ঘেন্না হওয়া উচিৎ আমাদের শরীর বেড়ে ওঠে, পুষ্ট হয় ওই ক্রীতদাসীগুলোর রক্ত খেয়ে। না আমদের সেটা হয় না – আমরা আমাদের উপার্জন করা টাকা দিয়ে এসব কিনি না?

এদের জন্য জীবনযাত্রার ন্যুনতম প্রয়োজনের সংস্থানের জন্য সরকারের চাপ নেই, সুশীলদের চাপ নেই, চাপ নেই আমাদের তথাকথিত কমিউনিষ্টদের। কয়েকদিন আগে কড়াইল বস্তি (ওদের অনেকের আবাসস্থল) উচ্ছেদের পর কমিউনিষ্টরা বিবৃতি দিয়েছেন। হাহ হা। আর আমরা নাগরিকরাই বা কী করি? খোঁজ নিতে যাই কখনো ওরা 'কী রকমভাবে বেঁচে আছে?'। পত্রিকায় কালেভদ্রে ওদের খবর আসলেও কি পড়ি সেটা? পড়লেও কী করি? ওদেরকে আদরের ডাক 'সেলাই দিদিমনি' দিয়েছি না আমরা! আমাদের তো কর্তব্য শেষ। আর আমি তো রীতিমত মহৎ – আস্ত একটা পোষ্টই লিখে ফেললাম ওদের জন্য!