ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের আগুনে বদর আলী অঙ্গার

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 21 April 2012, 12:03 PM
Updated : 21 April 2012, 12:03 PM

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হবার খবর কিছুটা পুরনো হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে কথার খেলায় আর কাদা ছোঁড়াছুড়িতে মেতে উঠেছিলেন আমাদের দুই বড় দলেই দুই 'বড়' নেত্রী আর তাঁদের দলের অন্য নেতা নেত্রীরা। আমাদের এই ব্লগেও এসেছে নানা রকম পোষ্ট – সরকারের সম্পৃক্ততা/দায় নিয়ে, বিরোধীদলের হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে।

শুধু এই বিষয় নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করেনি। তবে সার্বিকভাবে একটা পোষ্ট লিখতে যাচ্ছিলাম জনগনকে দেয়া এই সরকারের 'নতুন' উপহার 'গুম' নিয়ে। কিন্তু বিডি নিউজ ২৪ এর এই খবরটি বাসে আগুন, একজন জীবন্ত দগ্ধ ওটা নিয়ে লিখার ইচ্ছেটাও আপাতত শেষ করে দিল। তবে আমরা জানি গুম আরো চলবে তাই গুম নিয়ে লিখার চিন্তাটা প্রাসঙ্গিক থাকবে আরো বেশ কিছুদিন।

ইলিয়াসের খোঁজ দেবার দাবীতে আমাদের 'দায়িত্বশীল' বিরোধী দল বিএনপি হরতাল ডেকেছে। ডাকতেই পারে তাদের কেন্দ্রীয় নেতা হারিয়েছে বলে কথা। সরকার বিরোধী আন্দোলন আর নির্বাচন ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে ইলিয়াস আলীর মত একটা রেসের ঘোড়া হারিয়ে যাওয়া দলের জন্য তো বিরাট ক্ষতি। তার ওপর তিনি ছিলেন 'চিকিৎসা সুত্রে' বর্তমানে বিলেত প্রবাসী রাজপুত্রের চরম আস্থাভাজন।

তো হরতাল ডাকার ক্ষেত্রে ইদানিং একটা প্রবণতা হল হরতালের আগেরদিন সন্ধ্যায় গাড়িতে আগুন দিয়ে, গাড়ি ভাংচুর করে আতংক তৈরী করা। যেন পরদিন মানুষ আতংকে বের না হয়; হরতাল যেন 'স্বতস্ফুর্ত' এবং 'সফল' হয়। পরে নেত্রী যেন এমন হরতাল পালনের জন্য জনগনকে ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন জানাতে পারেন। এটা জেনেই আমরা ইদানিং হরতালের আগের সন্ধ্যাটিতে কী করতে হবে আর কী করতে হবে না সেটা বুঝে নিয়েছিলাম। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত সন্ধ্যার সময়ই। তাই 'সেয়ানা' রাজনীতিবিদরা কিন্তু আজ ঘটনা ঘটিয়ে দিলেন দুপুরেই।

খবরে দেখলাম আজ ঢাকার চারটি জায়গায় বাসে আগুন দেয়া হয়েছে আর তাতে একটি বাসে একজন বাসচালক বদর আলী জীবন্ত দগ্ধ হয়ে অঙ্গার হয়েছেন, মারা গেছেন। বদর আলীর কাছে আমাদের দুই নেত্রী নিশ্চয়ই ঋণী থাকবেন। এই লাশ নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলের নৃশংসতার কথা বলবেন; আর বিরোধীদলীয় নেত্রী এটাকে সরকারী দলের চক্রান্ত বলে ওই নেত্রীকে তুলোধূনো করবেন। আবার কাদা ছোঁড়াছুড়ির একটা চমৎকার সুযোগ। তবে কাজটা যেই করুক না কেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী নিশ্চয়ই কিছুটা তৃপ্ত – যাক কালকের হরতালটা অন্তত স্বতস্ফুর্ত হবে।

আমি ঘটনাটি পড়ে মনে মনে ভাবছিলাম ইলিয়াস আলী আর বদর আলীর মধ্যে আমাদের জন্য কে বেশী মূল্যবান? আপাতদৃষ্টিতে একজন মূল্যবান রাজনীতিবিদের নিখোঁজ হওয়ার পরবর্তী ঘটনায় এই 'মূল্যহীন' সাধারন মানুষটি পুড়ে মারা গেলেন। কেউ কেউ হয়তো বলবেন 'জাতি উদ্ধার করা' একজন রাজনীতিবিদের জীবন রক্ষা করার জন্য, 'গনতন্ত্র'কে সুসংহত করার জন্য এমন কিছু সাধারন মানুষের জীবন যাওয়াটা আমাদেরকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু তাই কি?

এই দেশের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সত্যিকারভাবে মানুষের কল্যাণ করতে চেয়ে 'নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো' রাজনীতিবিদের সংখ্যা শতকরা ৫ ভাগও হবে কিনা সন্দেহ। ইলিয়াস আলী নিশ্চয়ই ওই শতকরা ৫ ভাগে পড়া রাজনীতিবিদ নন। তিনি বাঁকী শতকরা ৯৫ জনের মত অতি অল্প সময়ে নিজের আখের গুছাতেই রাজনীতিতে এসেছেন। এই শতকরা ৯৫ জন রাজনীতিবিদ আমাদের জন্য কি আদৌ মূল্যবান? কী মূল্য যুক্ত করেছে তাঁরা এই রাষ্ট্রের জন্য? রাষ্ট্র আর জনগনকে শোষণ করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়া এই মানুষগুলো কি রাষ্ট্র আর জনগনের বিরাট দায় নয়?

আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি আমাদের দেশের একজন দরিদ্র, 'সাধারণ' রিক্সাচালক, গার্মেন্টসকর্মী, ফুটপাথের দোকানী, দিনমজুর এই দেশের জন্য ভীষণ মুল্যবান। না খেয়ে না পরে এই মহৎ মানুষগুলো আমাদের সেবা দিয়ে যান। এদের রক্তে-ঘামে গড়ে ওঠে আমাদের উন্নয়নের সব কাঠামো। আর কিছু করুন না করুন তাঁরা শতকরা ৯৫ ভাগ টাউট রাজনীতিবিদের মত এই দেশের ক্ষতি করছেন না, দেশকে লুটপাট করছেন না। তাই যেকোন বিচারেই এই মানুষগুলো ওই রাজনীতিবিদদের তুলনায় অনেক বেশী মহৎ এবং দেশের জন্য অনেক বেশী মূল্যবান। আজকে বাসে আগুনে পুড়ে মরা বদর আলীর মৃত্যু আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে এজন্যই।

ইলিয়াস আলী আর কোনদিন ফিরে না আসলে তাঁর পরিবার পথে বসবে না। বনানীতে বাড়ি, দু'টো গাড়ির তথ্য তো আমরা পেলামই – এটা নিশ্চয়ই 'টিপ অব দ্য আইসবার্গ'। কিন্তু পুড়ে মরে যাওয়া বদর আলীর পরিবারের কি হবে? তাঁর কি সন্তান ছিল যারা এখনো আয় করছে না? তারা কি কোনরকমে খেয়ে পরে পড়াশোনা করছিল? কী হবে তাদের এখন? তাঁর কিশোর ছেলেটিকে বা মেয়েটিকে কি এখন পড়াশোনা ছেড়ে আয়ের সংস্থানে বেরোতে হবে? পথে বসে যাওয়াই কি এখন তাদের নিয়তি? এর দায় কার?

আপনারা যারা এতোক্ষন ভাবছেন আমি শতকরা ৯৫ ভাগ রাজনীতিবিদের একজন ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হবার খবরে খুশি হয়েছি তারা ভুল বুঝছেন। আমি আর সবার মতোই এই ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। কারন সমাজের সবচাইতে ভয়ঙ্কর অপরাধীরও মানবাধিকারে আমি বিশ্বাস করি। আর এখনকার সময়ে মানুষের এমন নিখোঁজ/গুম হয়ে যাওয়া নানা কারনে সব সচেতন মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলবেই।

লিখাটি পড়ে 'অন্ধ' আওয়ামী সমর্থকরা খুশী হচ্ছেন? তবে বলি, আমরা শাহবাগের বাসের আগুনের কথা ভুলে যাইনি। সব শেয়ালেরই একই রা।