বিদ্যুৎমন্ত্রীর (পড়ুন প্রধানমন্ত্রী) পদত্যাগ চাইছে না কেন কেউ?

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 24 May 2012, 09:36 AM
Updated : 24 May 2012, 09:36 AM

বোরো ধান কাটা শেষ প্রায়। আমরা অনেকেই খবরও রাখি না যে অগণিত কৃষক পথে বসে যাচ্ছেন – ধানের দাম পাচ্ছে না মোটেও, লাভ দূরে থাকুক খরচও উঠে আসবে এবার তাদের। আজ অবশ্য তাঁদেরকে নিয়ে লিখছি না। আসলে বোরো ধানের কথা মনে পড়ে গেল বিদ্যুতের কথা লিখতে গিয়ে।

বোরো সেচের জন্য গ্রামের দিকে বেশী বিদ্যুৎ দিয়ে (যদিও অভিযোগ আছে তাঁরাও বিদ্যুৎ পাননি) শহরে বেশী লোডশেডিং দেয়ার সরকারী সিদ্ধান্ত মন থেকে মেনে নিয়েছিলাম আমাদের কৃষক ভাইদের কল্যানের কথা চিন্তা করে। কিন্তু সেচের মৌসুম শেষ হয়ে ধান কাটাও শেষ। কিন্তু এখনো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে আর এক ঘণ্টা থাকে না। এটা ঢাকার কথা – পত্রিকায় দেখেছি শহরের বাইরে পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎ থাকেই সাকুল্যে ৫/৬ ঘন্টা। অবশ্য 'কাজীর গরু কেতাবেই আছে' প্রবাদকে সত্য প্রমাণ করে আমাদেরকে হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের গল্প শোনানো হয়।

বিএনপি জোট সরকারের সময় বিদ্যুৎ সেক্টরে 'খাম্বা কাহিনী' ছাড়া তেমন কিছু না হওয়াতে গত নির্বাচনের ইস্তেহারে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিশ্রুতিগুলোর অনেক ওপরেই ছিল বিদ্যুতের কথা। কিন্তু আজ তিন বছর পরে বিদ্যুৎ সেক্টরে (অন্য সেক্টরগুলোতেও) আমরা যা দেখছি সেটার আলোকে ঐ ইস্তেহারকে একটা চমৎকার রূপকথা বলে মনে হয়।

এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম গরম মৌসুমটা বিদ্যুৎ নিয়ে তেমন কিছু করেনি, মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। মানুষ যে কোন ভাবেই হোক না কেন, বিদ্যুৎ চাইছিল। আমার মনে পড়ে ঐ পরিস্থিতির সময় ২/১ জন বিশ্লেষক বলছিলেন বিদ্যুৎ নিয়ে ওই পরিস্থিতিটা ইচ্ছে করে তৈরি করা হচ্ছে এবং বিদ্যুৎ খাতে ভবিষ্যতে কোন তুঘলকি কান্ড ঘটতে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হল সেই আশংকা সত্যি প্রমাণিত হয়ে গেছে।

প্রথম বছরের ঐ অবস্থার পর সরকার 'ইনডেমনিটি' দিয়ে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করার পদক্ষেপ নেয় – অর্থাৎ কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করার জন্য নেয়া যাবতীয় সব কর্মকান্ডকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এই পদক্ষেপই অনেকটা বলে দেয় কী হতে যাচ্ছে পরে।

কেউ কেউ ঢালাওভাবে বলতে চেষ্টা করছেন কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করাটাই ভুল হয়েছে। কথাটা ঠিক না। বিএনপি সরকার আর তারপরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিদ্যুৎ সেক্টরে অতি সামান্য উৎপাদন ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ঠ ছিল না মোটেও। তাই ডিজেল এবং ফার্নেস ওয়েল ভিত্তিক কিছু কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা একরকম অনিবার্যই ছিল। কারণ অন্য জ্বালানীভিত্তিক(কয়লা/গ্যাস) বিদ্যুতকেন্দ্র তৈরি করতে ২/৩ বছর সময় লাগে, এমনকি নতুন গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ায় যায়নি, আর বড় কিছু কয়লা খনি আবিষ্কার হলেও কয়লানীতি করে সেগুলো উত্তোলন করতে দেরী হত।

বিদ্যুৎ সেক্টরে কাজ করা একজন লেখকের একটি লিখায় পড়েছিলাম বর্তমানের গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনেকগুলোতে কিছু জরুরী সংস্কার করে এবং জরাজীর্ণ প্ল্যান্ট প্রতিস্থাপন করে বর্তমানে ব্যবহৃত গ্যাস দিয়েই প্রায় ১০০০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। কেউ বলবেন টাকার অভাব? ভুল কথা, তাহলে এই বিদ্যুৎ সেক্টরে আমরা এই সরকারের আমলেই এখন পর্যন্ত চল্লিশ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিলাম কোত্থেকে? ওই প্রসঙ্গে আসছি পরে।

তো ইনডেমনিটি দেয়া কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু হয়ে গেল খুব দ্রুতই। শুরু থেকেই এন্তার অভিযোগ ছিল এগুলোকে নিয়ে। প্রথম অভিযোগ হল প্ল্যান্টের যন্ত্রপাতির প্রকৃত মূল্যের চাইতে অনেক বেশী মূল্য দেখিয়ে (বানিজ্যের ভাষায় ওভার ইনভয়েসিং) বা রিকন্ডিশন্ড প্ল্যান্টকে নতুন দেখিয়ে বিদেশে অনেক ডলার পাচার করা হয়েছে। অনুমান করা হয় শেয়ার বাজার থেকে লুট করা টাকার একটা অংশ এভাবেই বিদেশে পাচার হয়।

কুইক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্র যেহেতু ডিজেল বা ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক, তাই এর পর সরকার বিরাট অংকের বৈদেশীক মূদ্রা খরচ করে ভর্তূকি দিয়ে সেই তেল সরবরাহ করতে থাকে ওই কেন্দ্রগুলোতে। ওদিকে আবার তাদের কাছ থেকে ১২-১৫ টাকায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনে জনগনের কাছে সেটা বিরাট ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করা হতে থাকে। এভাবে গত বছরটা মোটামুটি চালানো গেলেও এই বছর আর ভর্তূকির সংস্থান করা যাচ্ছে না। তাই এবছর প্রায় সব কুইক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ থাকছে।

মজার ব্যাপার হল কেন্দ্র বন্ধ থাকলেও চুক্তি অনুযায়ী বেশ মোটা একটা ভাড়া দিতে হচ্ছে ওই কেন্দ্রগুলোকে জনগনের ট্যাক্সের টাকা খরচ করেই। ওদিকে পত্রিকায় অভিযোগ এসেছে বিক্রি করা বিদ্যুতের হিসাবে গরমিল করে টাকা লুট হচ্ছে; বেশী বরাদ্ধ নিয়ে ভর্তুকির তেল বাইরে বিক্রি করে মোটা টাকা কামাচ্ছে তারা। এই কয়েকদিন আগে টিভিতে দেখাল পাচারের সময় র‍্যাব বেশ কয়েক ট্যাংকার ফার্নেস অয়েল আটক করেছে হাতেনাতে।

এভাবে কুইক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্র আর তার জ্বালানী তেল আমদানী করতে করতে দেশের বৈদেশিক মূদ্রা রিজার্ভে আশংকাজনকভাবে কমে গিয়ে এক হাজার কোটি ডলারের নীচেও নেমে যায় – যার অনিবার্য ফল ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমে যাওয়া – চোখের সামনে ৭০ টাকার ডলার অল্প কয়েকদিনে ৮৫ টাকায় ঠেকে। এর ফলে হু হু বাড়তে থাকে জিনিষপত্রের দাম (মূল্যস্ফীতি)। ওদিকে আবার রিজার্ভের অবস্থা একটু ভাল করার চেষ্টায় আইএমএফ এর কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋনের জন্য শর্ত হিসাবে ব্যাংকের সুদের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয় আর দফায় দফায় বাড়ানো হতে থাকে তেল আর বিদ্যুতের দাম। এটাও মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘি ঢালে।

আলোচনাটা খুব টেকনিক্যাল হয়ে যাবে তাই করছি না, কিন্তু এটা স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয়া যায় যে শেয়ার কেলেঙ্কারীতে দেশের অর্থনীতি বিরাট ধাক্কা খাওয়ার পর এই কুইক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে আক্ষরিকঅর্থেই। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আজ যে নাভিশ্বাস উঠে গেছে তার পেছনে বিরাট দায় ওই কেন্দ্রগুলোর।

আগেই বলেছিলাম এই কেন্দ্রগুলো বছর তিনেক চলার কথা, যেন এর মধ্যে গ্যাস বা কয়লাভিত্তিক নতুন কেন্দ্র চালু করে ওগুলো বন্ধ করে দেয়া যায়। কী দেখছি আমরা এখন? গত সাড়ে তিন বছরে কয়লা উত্তোলন করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র তৈরি করা দূরে থাকুক সরকার একটা কয়লানীতিই করে উঠতে পারল না, এবং ঘোষণা দিয়ে দেয়া হয়েছে এই সরকারের সময়ে আর সেটা হবে না। এখন আবার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে আমদানী করা কয়ালা দিয়ে কেন্দ্র নির্মান করা হবে। এর আমদানী, পরিবহণ সব কিছুর জন্য দেশের কয়লার তুলনায় খরচ কত গুন পড়বে সেটা বলা বাহুল্য। আর অবকাঠামো নির্মান করে সেসব করতে কত সময় লাগবে সেটা আমাদের মত 'বোকা পাবলিক'ও বোঝে।

কুইক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্রের পাশাপাশি যেহেতু কোন দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি এই সেক্টরে, আর যদি ইনডেমনিটি দেয়াকে মেলাই সাথে তবে কি এই কথা নির্দ্বিধায় বলে ফেলা যায় না যে মানুষের দুর্দশাকে পুঁজি করে এই বিদ্যুৎ সেক্টরে এই তুঘলকি কান্ড ঘটানো হয়েছে, সীমাহীন লুটপাট করা হয়েছে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পণা করেই? যার সাথে জড়িত হয়ে ভেঙে পড়তে বসেছে পুরো দেশের অর্থনীতি? নিশ্চিতভাবেই কি বলা যায় না বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় এই সরকারের সবচাইতে অদক্ষ, ব্যর্থ, দুর্নীতিপরায়ন মন্ত্রণালয়?

দুর্নীতি আর ব্যর্থতার দায়ে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী, নৌ পরিবহনমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই – সেটা যৌক্তিকও। তো এদের যে কারো চাইতে ঢের খারাপ পারফর্ম করা বিদ্যুৎমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইছে না কেন কেউ?

ভাল কথা, আমরা জানি তো বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী!