ভ্রমণঃ সিলেট টু শিলং- দুই

জহিরুল চৌধুরী
Published : 9 May 2012, 07:45 PM
Updated : 9 May 2012, 07:45 PM

২৬শে মার্চ, রোববার

শিলং-এ হোটেলের অভাব নেই, এবং প্রায় প্রতিটি হোটেলেরই কোন-না-কোন প্যাকেজ আছে। যেমন কোনটির ব্র্যাকফ্যাস্ট ফ্রি, কোনটির আবার নিজস্ব ট্যুর অপারেটিং প্যাকেজ। ক্যাবল টিভি'র সুব্যবস্থার কথাও বলছে কেউ-কেউ। এম্বেসী হোটেলের একটি ডাবল বেডের কামরায় আমরা উঠলাম। পানি যেন বরফ গলা! তবে আরেকটি টেপ ঘুরিয়ে গরম পানিও পাওয়া গেল। গরম পানিতে গোসল সেরে আমরা হোটেলের রেস্টুরেন্টেই দুপুরের আহার সারলাম। বিকেল চারটার পর বেরুলাম হোটেল থেকে।

পুলিশ বাজার মোড় থেকে সেদিনের দু'টি বাংলা ও ইংরেজী কাগজ কিনে আমাদের পথ চলা। মেঘালয় ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের অফিস এবং টার্মিনালের সামনে সরকারি ট্যুরিজমের অফিস। ততক্ষনে বন্ধ হয়ে গেছে। টার্মিনালের একেবারে সামনে একটি স্ন্যাকস ও পেস্ট্রি শপ। বি্ক্রেতাকে বাঙালী বলে মনে হলো। হিন্দি-ইংরেজী বাদ দিয়ে আমি কথা শুরু করলাম খাস সিলটি ভাষায়। আলাপ-পরিচয় হতে-হতে সমীর পাল নামের শ্মশ্র"মণ্ডিত ভদ্রলোকটি জানালেন তার পিতৃপুরুষের বাস সিলেটে। তিনি কখনো যাননি। তবে শুনেছেন তার বাবার বাড়ি মৌলভী বাজার জেলায়।

তিনি জানালেন- আজ রোববার। তার দোকানের ঠিক সামনেই রাস্তার উল্টোপাশে ট্যুরিজমের অফিসটি খুলবে আগামীকাল সকাল আটটায়। তার কাছে জানতে চাইলাম- আজ সন্ধ্যে সাতটার আগ পর্যন্ত আমরা আর কোথায় যেতে পারি। ভদ্রলোক খুব সুন্দর পরামর্শ দিলেন। বললেন, আজই সামার ফেয়ারের শেষ দিন। মেলা হচ্ছে ব্যাটালিয়ান ফিল্ডে। তিন দিন আগে শুরু হয়েছিল। একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে আমরা তৎক্ষণাৎ ছুটে চললাম। সন্ধ্যে পর্যন্ত কাটালাম মেলায়। অনন্যার জন্য কিছু কিনতেই হবে তার মায়ের। মেলা ঘুরে সবশেষে ১০ টাকা টিকিট কেটে আমরা ঢুকলাম মোটর সাইক্লিং দেখতে। প্রায় ৭০ ডিগ্রী ভার্টিক্যাল চক্করের ভেতর দুটি ছেলের মোটর সাইকেল এবং একটি মেয়ের মারুতি স্পোর্টস চালনার এ রোমাঞ্চকর শো আমার মনে থাকবে অনেকদিন। এ ধরনের স্পোর্টস অবশ্য বাংলাদেশেও প্রচলিত আছে, বিশেষত সার্কাস পার্টিগুলোর শো'তে। বুঝলাম এই ভারত বর্ষে সাহসী মানুষের সংখ্যাও একেবারে কম নয়।

সন্ধ্যার সাথে-সাথে যেন হাট ভাঙ্গা মানুষের ভীড়, রাস্তা জুড়ে। একমাত্র বাহন ট্যাক্সি ক্যাব, কিন্তু খালি পাওয়া প্রায় অসম্ভব মনে হলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে একটি পেলাম। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের করিৎ কর্মে কোন যানজট চোখে পড়লো না। কিন্তু সূর্য ডোবার সঙ্গে-সঙ্গে মানুষের এই ত্রস্ত-ব্যস্ত ভাব কিছুটা শংকিত করার মতোও। ইনসার্জেন্সির আশংকা নয়তো! তবু শিলং চলছে। উন্নতি ঘটছে ভারতের এই উত্তর-পূর্ব অংশের। এর পেছনে কি ত্যাগ আর বীরত্বের মহিমা রেখেছেন ভারতের রাজনীতিবিদেরা? বহু জাতি ও ভাষা ভিত্তিক নাগরিকদের মনে যে আশার আলো প্রজ্জলিত করেছেন তারা, তাতেই রাষ্ট্রটি চলছে। নৃতাত্ত্বিক জাতি গোষ্ঠীর স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্খা যদিও হারিয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে!

সারা উত্তর-পূর্ব ভারতে কাজ হচ্ছে মূলত সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত, দশ ঘন্টা। ভাবতে কষ্ট হয় যখন আমাদের দেশে কেবল গার্মেন্টস শ্রমিকরাই কাজ করেন সকাল আটটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চৌদ্দ ঘন্টা! আর কমবেশি সব শহরই জেগে থাকে রাত দশটা পর্যন্ত। তথাপি মানুষের এই কষ্ট ও শ্রমের ফসল চলে যায় দুর্নীতি পরায়ন আমলা, রাজনীতিবিদ আর সার্বিক অব্যস্থাপনার খেসারত দিতে। তবু বাংলাদেশের মানুষ এগুচ্ছে। রাজনীতিবিদ আর আমলাদের মাথা মুড়িয়ে জায়গা করে নিচ্ছে বাংলাদেশের মানুষও। যা কৃতিত্ব সব এদেশের মানুষেরই। ধান ভানতে শীবের গীতের মতো সর্বত্র এসে যায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।

রাতে ঘুমনোর পালা। টেলিভিশনে চ্যানেলগুলোর অবিরাম প্রচারণা। শিলংয়ের নিজস্ব কোন চ্যানেল নেই। যতটা ভেবেছিলাম ততটা ঠাণ্ডা পড়েনি। তবে সেন্টিগ্রেডে প্রায় আটের কাছাকাছি।

২৭শে মার্চ, সোমবার

আসার সময় ছোট্ট একটি টেবিল ঘড়ি নিয়ে এসেছিলাম। সকাল সাতটায় এরই ঘন্টা শুনে আমাদের ঘুম ভাঙ্গলো। তৈরি হতে আধা ঘন্টা, প্রাতঃ রাশে আরো আধা ঘন্টা। পাঁচ মিনিট হাটা পথে মেঘালয় ট্যুরিজমের অফিস। একটি কক্ষের কাউন্টার খুলে দুই মহিলাও সবেমাত্র বসলেন। আমাদের নাম তালিকাভূক্ত করলেন চার ও পাঁচ নম্বরে। এক এক করে আরো এলেন। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে সব মিলিয়ে উপস্থিত ১৬ জন। ট্যুরিস্টদের প্রায় সত্তুর ভাগই ভারতীয়। দু'জন পশ্চিমা, আর আমরা দু'জন। কুড়ি জন হলে বাস ছাড়ার কথা। ট্যুরিজমের কর্মকর্তা মহিলা ইংরেজীতে প্রস্তাব করলেন আপনারা ১৬ জনই চলে যান। বাড়তি ১০ টাকা, অর্থাৎ জনপ্রতি ১১০ টাকা (রুপি) লাগবে। আমরা সবাই তাতে রাজি হলাম।

ভদ্রমহিলা আমাদের গাইড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন মিস এ্যানিকে। ছিপ-ছিপে গড়নের এ্যানি কলেজে পড়ুয়া। ট্যুরিজমে কাজ করেন পার্ট টাইম। সহাস্যে অভিনন্দন জানিয়ে বাসে ওঠার আমন্ত্রন জানালো। স্পষ্ট আর সুন্দর বাচন ভঙ্গিতে শুভ সকাল বলে আমাদের আজকের ভ্রমণ কর্মসূচি জানিয়ে দিল। আমাদের প্রথম গন্তব্য চেরাপুঞ্জি। পথে অবশ্য যাত্রাবিরতি হবে আকর্ষণীয় এবং নির্ধারিত স্পটগুলোতে।

উ কুয়ান সিং ব্রীজ

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি ৫৬ কিলোমিটার। যাত্রাপথ প্রথমে চড়াই, তারপর ঢালু। শিলং থেকে এক হাজার ফুট নীচে, তবে সমুদ্র থেকে সাড়ে চার হাজার ফুট উঁচুতে। চেরাপুঞ্জির কথায় আবার আসবো। তবে মাঝামাঝিতে শিলং থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে আমাদের যাত্রা বিরতি হলো উ কুয়ান ব্রীজের পাশে। আসলে দুটো পাহাড়কে এক করেছে এই ব্রীজ। ব্রীজের নামকরণ হয়েছে চেরাপুঞ্জির এক প্রয়াত জনহিতৈষী রাজার নামে। ব্রীজ এবং তিনটি পাহাড়কে তিন দিকে রেখে তৈরি হয়েছে শ্যুটিং স্পট। এই সেদিনও শাহরুখ খানরা নাকি এখানে অভিনয় করে গেছেন। সর্বত্র সবুজ আর সবুজ। আকাশ আর পাহাড়ের মিতালী। পাহাড়ের গা ঘেঁষে ছুটে বেড়াচ্ছে পেঁজা-পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। অনেক নীচে কূল-কূল শব্দে বয়ে চলেছে ঝর্ণাধারা। এখানে একটি ছাপড়া রেস্টুরেন্টে আমরা চা পান করলাম আর ছবি তুললাম। শিলংয়ে যেমনটা দেখেছি, এখানেও দেখলাম পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সবাই তাম্বুল চর্চা করছে। এদের ভাষায় 'তাম্বুল' মানে পান আর কাঁচা সুপুরি। ভেতরটা ভালো করে না দেখে একটি তাম্বুল মুখে পুড়ে কি বিপদেই না পড়লাম। একটি আস্ত চুনের আঁকড় মুখের চারপাশে গলে ভেতর দিকটার ছাল উঠে গেল। কয়েক দিন পর্যন্ত ভাত চিবোতে আমার বেশ কষ্ট হলো। একেই বলে চুন খেয়ে মুখ পোড়া! (চলবে)

(ভ্রমণকাল ২০০০ সাল)