আমার প্রিয় নজরুল

জহিরুল চৌধুরী
Published : 23 May 2012, 06:52 PM
Updated : 23 May 2012, 06:52 PM

বাংলার বিদ্রোহী কবি নজরুলকে আমি সেভাবেই জানি, যেভাবে এ দেশের মানুষ জানেন। তবে নজরুল সম্পর্কে বিশেষ অনুরাগ সৃষ্টির পেছনে আমার সবার বড় বোনের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল, যা না বললে তার প্রতি অবিচার হবে। সেই ১৯৭৬ সালের কথা। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। আমার সবার বড় বোনটির বিয়েও সে বছর। হঠাত এক বিকেলে আমাদের ছোট্ট শহরে মাইকে একটি ঘোষণা শুনি, সেটি হবিগঞ্জ শিশু একাডেমির। 'আগামী কাল শহরের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মিলনায়তনে একটি উপস্থিত রচনা প্রতিযোগিতা হবে- যার বিষয় বস্তু "আমার প্রিয়জন"। শিশুদের জন্য এ রচনার কলেবর কত বড়ো হবে এ সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তিতে কিছুই বলা হলো না। যাই হউক, আমার বড় আপা পুরো বিকেল জুড়ে লিখে দিলেন একটি প্রবন্ধ, এক পৃষ্ঠার। আর বললেন সেটি মুখস্থ করতে। আমি রাত জেগে পুরো পৃষ্ঠাটি মুখস্থ করলাম। আর পরদিন সকালে হাজির হলাম রচনা প্রতিযোগিতায়। সকাল নটায় প্রতিযোগিতা শুরুর মুহূর্তে জানিয়ে দেয়া হলো- লিগাল সাইজের (ফুলস্কেপ কাগজের) পুরো তিন পৃষ্ঠা জুড়ে লিখতে হবে প্রবন্ধটি। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমার কি হবে- আমি যে মাত্র এক পৃষ্ঠা মুখস্থ করে এসেছি! এই এক পৃষ্ঠার বেশি এক অক্ষর আমি জীবনে বানিয়ে লিখতে পারবো না, কারন আমি জীবনে কোনদিন বানিয়ে লিখি নি! তথাপি এই চ্যালেঞ্জ আমাকে নিতে হবে এবং দুই ঘন্টায় পূর্ণ করতে হবে তিন পৃষ্ঠা। ভাবতেও সময় লাগে, কিন্তু এখানে ভাবাভাবি'র সুযোগও নেই!

অদ্ভুত সুন্দর, নাটকীয়ভাবে শুরু হলো 'আমার প্রিয়জন' লেখা। "যখন আমি খেয়ালের বশে চিন্তা করি এই পৃথিবীতে আমার এমন কেউ কি আপন আছে, যাকে নিয়ে আমি ভাবি, যার শুভাশুভ কামনা করি। যাকে শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি। যতই ভাবি, ততই চোখের সামনে সিনেমার পর্দার মতো ভেসে আসে একটি নাম। নাম বললে, পরিচয় দিলে আপনারাও হয়তো এঁকে চিনতে পারেন। তিনি আমার প্রিয় ঝিঙ্গে ফুল রচয়িতা নজরুল। নজরুলকে আমি ভালবাসি শুধু কবি হিসেবে নয়, কেবল বিদ্রোহী হিসেবে নয়, একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তি মানুষ হিসেবে।" বন্ধনীর ভেতরই রাখলাম এ কথাগুলো, কারন এগুলো ছিল আমার বড় আপার শেখানো। এক পৃষ্ঠা লিখে ফেলেছি আধা ঘন্টায়। এরপর ভাবনার রাজ্যে বিচরণ করে বাকি দেড় পৃষ্ঠা পূর্ণ করলাম দেড় ঘন্টায়। তিন পৃষ্ঠা পূর্ণ করতে পারিনি। তথাপি হবিগঞ্জে হলাম প্রথম, আর প্রথম হিসেবে লেখাটি চলে গেল ঢাকায় জাতীয় প্রতিযোগিতায়। আমার সঙ্গে আমার বয়সী আরো অন্তত পচিশ-ত্রিশ জন অংশ নিয়েছিল জেলা প্রতিযোগিতায়, যাদের অধিকাংশই প্রিয় মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেছিল হযরত মুহাম্মদের নাম। আজ ছয়ত্রিশ বছর পর ভাবি- আমার অন্তরে এই সাম্যবাদী, বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিটির নাম প্রোথিত করে আমার বড় বোনটি কি দুঃসাহসিক কাজই না করেছিল সেদিন! ঘটনার মাস খানেক পর হঠাত একদিন একটি চিঠি আসে ঢাকার শিশু একাডেমী থেকে, এর মহা পরিচালিকা ফিরোজা বারীর স্বাক্ষরে। ঢাকার জাতীয় পর্যায়েও আমি দ্বিতীয় হয়েছি। এখন পুরস্কার আনার জন্য নিজে যেতে হবে, অথবা কাউকে অনুমতি পত্র দিয়ে পাঠাতে হবে। ঢাকায় পাঠানোর মতো আর্থিক সামর্থ আমাদের পরিবারের ছিল না। আমার বড় আরো চারটি ভাই আছেন, এদের অন্তত তিনজন আমাকে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু নয় ভাই বোনের সর্ব কনিষ্ঠটির জন্য কারো এতোটা সময় নেই- তা সে অবহেলা কিংবা অর্থ সংকট যাই হউক না কেন! এরও মাস খানেক পর আমাদের এক প্রতিবেশি ঢাকা যাচ্ছিলেন, তার হাতেই অনুমতি পত্র দিয়ে সার্টিফিকেট, পুরস্কারের একটি সোনালী ফাউন্টেন পেন আর একটি সোনালি টিফিন বক্স আনিয়েছিলাম। অতদিনে আমার বড় আপুর বিয়ে হয়ে গেছে, স্বামীর সঙ্গে চলে গেছে দেশের কোন প্রান্তে। কিন্তু পুরষ্কারটি আমি হাতে নিয়ে স্কুলের সবগুলো শ্রেণী কক্ষে উপস্থিত হয়েছিলাম প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে। সেই থেকে আমি লেখক বনে গেলাম! মাঝখানে বিজ্ঞান-অংকশাস্ত্র লণ্ডভণ্ড করে আবার একই কড়াইয়ে খই ভাজছি!

আজ এই লেখার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগম। গতকাল ঢাকার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন- "বাঙালি মুসলমানকে সংগীত-সংস্কৃতিতে শামিল করতে নজরুল বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছেন। দেশ বিভাগ ও নজরুলের আকস্মিক অসুস্থতার কারণে তাঁর সাথে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও তাঁর বিশাল জগতে পরিব্রাজন ব্যাহত হয়নি। কারণ নজরুল সংগীত আমাকে দিয়েছে নতুন জগতের সন্ধান। যে জগত মানবিক সৌন্দর্যে ভরপুর।" কথা ক'টি ধ্রুব সত্য। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে বিষয়টি অনুধাবনের জন্য যে মানবিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ দরকার, তার অনুপস্থিতি প্রকট। উপমহাদেশে বাঙালী মুসলমানকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন নজরুল। ধ্যানে-জ্ঞানে মুসলমানের মহিমা ভাস্বর করেছেন। সাম্য-মৈত্রি আর অসাম্প্রদায়িকতার পতাকা উড়িয়ে বাঙালী মুসলমানকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন অন্তত কয়েক'শ বছর।

সাম্প্রতিক একটি ঘটনার কথা বলে এই লেখার ইতি টানবো। সেদিন হঠাত করে নজরুলের গজল- "মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেবো খোপায় তারার ফুল" শোনার ইচ্ছে হলো। ইউ টিঊবে গজলের প্রথম লাইনটি লেখা মাত্র এলো এক ভারতীয় গায়কের নাম। বিপুল নামের যুবকটি হারমোনিয়াম বাজিয়ে সাদামাটা ভাবে গজলটি পরিবেশন করে ইঊটিঊবে দিয়েছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকে কমেন্ট লিখলাম। ফেইস বুকেও বন্ধু করে নিলাম একমাত্র একটি কারনে- সেও নজরুলের প্রেমিক। সে আমাকে জানালো মুম্বাই শহরে সে অবস্থান করে, এবং সেখানকার বাঙালীদের নিয়ে প্রতিবছর নজরুল জন্ম জয়ন্তি উদযাপন করে। আমার মনে হয় এই একমাত্র বাঙালি মুসলমান যাকে এই উপমহাদেশের সব ধর্মের, সব জাতের মানুষ আপন করে নিয়েছে। কারন নজরুল ছিলেন মানুষের কবি! ২৫শে মে ২০১২ নজরুলের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী। এ বছর একই সঙ্গে পালিত হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা লেখার ৯০তম বার্ষিকী। কবির এই একটি কথা দিয়েই আজ লেখাটির ইতি টানছি- "গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান"। এই বাণী ছড়িয়ে পড়ুক সারা বিশ্বের প্রতিটি ঘরে-ঘরে!!

নিউইয়র্ক, ২৩ মে ২০১২