কনকো-ফিলিপস এর সাথে চুক্তি আত্মঘাতি নয় তো?

আমিন আহম্মদ
Published : 16 June 2011, 05:36 AM
Updated : 16 June 2011, 05:36 AM

গত ২০০৮ সালের ১৫ আগস্ট পেট্রোবাংলা গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। সাতটি আন্তার্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি ১৫টি ব্লকের জন্য দরপত্র দাখিল করে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি চারটি ব্লকের জন্য পিএসসি স্বাক্ষরের সুপারিশ করে। কিন্তু সর্বশেষ দু'টি ব্লকের বিরোধপূর্ণ এলাকা বাদ দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত ২৭ মার্চ আইন মন্ত্রণালয় পিএসসির বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত দেয়। আর ২৩ মে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি চুক্তির বিষয়টি অনুমোদন করে। মূলত কনোকোর দাবি অনুযায়ী পিএসসিতে কিছু শব্দের পরিবর্তনের জন্য অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নেয়া হয়। গত সাত জুন ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কনোকোর সঙ্গে পিএসসি স্বাক্ষরের অনুমোদন দেয়।

সেই মতে; গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে আজ প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা। তথ্যমতে, আগামী শীত মৌসুম থেকে কনোকো বঙ্গোপসাগরের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করবে। গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাওয়া গেলে আগামী তিন থেকে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন করা যাবে।

কনকো ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি হলে মডেল পিএসসি অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০ শতাংশ গ্যাস পাবে। বাকি ৮০ শতাংশ গ্যাস নির্দিষ্ট দরে কিনে নিতে হবে। বাংলাদেশ ওই গ্যাস কিনতে না পারলে কনকো-ফিলিপস তা রপ্তানি করতে পারবে।

চুক্তি সম্পর্কে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেছেন, "উৎপাদিত গ্যাস প্রথমে তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিক্রি করবে। যদি সরকার কিনতে না পারে তবে দেশেরই কোনো বেসরকারি কোম্পানির কাছে বিক্রি করবে তারা।" তিন আরও বলেন, "বেসরকারি কোনো কোম্পানি কিনতে রাজি না হলে তখনই কনকো-ফিলিপস তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) হিসেবে তা বিদেশে রপ্তানি করতে পারবে," তিনি আরও বলেন, "তিনি বলেন, "এই চুক্তি নিয়ে কিছু ব্যক্তি ভুল ব্যাখ্যা করছে। পিএসসিতে দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো ধারা নেই।"

আবার এর বিপক্ষে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম নুরুল ইসলাম বলেছেন, "রপ্তানিমুখী মডেল উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট-পিএসসি ২০০৮) আওতায় এ চুক্তি দেশের জন্য আত্মঘাতী।"

সোমবার জাতীয় সংসদে সাংসদ রাশেদ খান মেনন এর বিরোধীতা করে বলেছেন, "এটি একটি পরিহাস যে, সরকার যখন এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করছে, ঠিক তখনই গ্যাস রপ্তানির শর্তে একটি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে।"

এ প্রসঙ্গে আনু মোহাম্মদ তার এক মতামতে বলেছেন, "সবমিলিয়ে কনোকোফিলিপস-এর সঙ্গে পিএসসি ২০০৮ এর অধীনে সমুদ্রের গ্যাস ব্লক নিয়ে যে চুক্তি করতে যাচ্ছে সরকার, তার কারণে ভয়াবহ একটি পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চুক্তির দলিলেই বলা হচ্ছে বাংলাদেশ কোনভাবেই ২০ ভাগের বেশি পাবে না। সেটাও সমুদ্র বক্ষ থেকে ভূ-সীমায় আনতে গেলে বাংলাদেশকে ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। তরলায়িত করে(এলএনজি) কনোকোফিলিপস এই গ্যাস রফতানি করতে পারবে। এর পরিণতি হল গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সত্ত্বেও বাংলাদেশের শতভাগ গ্যাসই পাচার হবে বিদেশে। সমুদ্রের বিশাল সম্পদসহ অন্যান্য ব্লকগুলোও ক্রমে এ ধরনের চুক্তির অধীনে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যাবে। সমুদ্রসীমা এখনও নির্ধারিত হয়নি। ভারত আমাদের সীমার একাংশ দাবি করে রেখেছে, বাকি অংশ যাচ্ছে মার্কিনীদের হাতে। মার্কিন কোম্পানির নিরাপত্তার অজুহাতে মার্কিনি নৌ-বাহিনীর কর্তৃত্ব স্থাপিত হবে বঙ্গোপসাগরে। জ্বালানি ও জাতীয় নিরাপত্তা দুটোই বিপর্যস্ত হবে।"

উপরোক্ত আলোচনা ও পর্যালোচনা হতে আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হল, আমরা কি আমাদের গ্যাস তথা প্রাকৃতিক খনিজকে বিদেশীদের হাতে তুলে দিচ্ছি না তো ? এখানে আমাদের জাতীয় ভাবে উত্তোলন না করে বিদেশীদের দিয়ে কেন উত্তোলন করার মত সিদ্ধান্ত নিতে হল?

যেখানে অনেক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক নেতারা এর বিভিন্ন কুফল বর্ণনা করেছেন, সেখানে সরকারের কি উচিত ছিলনা বিষয়টি সংসদ ও জাতীর কাছে পরিস্কার করে তারপর কোন সিদ্ধান্ত নেয়া? কেন এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত?

সরকারের মধ্যে কারা এসব কলকাঠি নাড়ে? শেখ হাসিনা কি জানেন যে এটা তার ও দেশের স্বার্থের পরিপন্থী কি না ? আমরা অবশ্যই চাই আমাদের অব্যবহৃত খনিজ অবশ্যই আমাদের ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। তার মানে কি আমাদের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি অবশ্যই জানেন যে, আমলারা বা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান সাহেব কোন দিন জনগনের কাছে দায়বদ্ধ নয়, আপনি দায়বদ্ধ তাই ভবিষ্যতে যে কোন প্রশ্নের উত্তর আপনাকেই দিতে হবে।

এটা আর যাই হোক জাতীয় স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক এতে কোন দ্বিমত করার উপায় নেই। তবে এটাকে ইস্যু করে কেউ রাজনীতির মাঠ গরম করুক তাও আমি চাই না। কারন এটাতে রাজনীতির রং লাগলে তা আরও আত্মঘাতী হবে এবং এর প্রকৃত সমাধান কোনদিনই জাতী দেখতে পারবে না।

তাই প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন, প্লিজ এ চুক্তি সম্পাদন করার আগে একটু ভালভাবে নিজে চুক্তিটির পুরোটা দেখুন, তারপর ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন।