মাননীয় রাষ্ট্রপতি, ক্ষমাটি কি খুবই প্রয়োজন ছিল?

আমিন আহম্মদ
Published : 25 July 2011, 03:21 PM
Updated : 25 July 2011, 03:21 PM

আমাদের দেশ বাংলাদেশ। যেন খুনের আসামীদের ক্ষমার দেশ। আইনজীবি, বাদী-বিবাদীর দীর্ঘ পথ পরিক্রমার সমাপ্তিতে রায় আসে। আর সে রায় যদি মৃত্যুদণ্ড, তো কোন সমস্যা নেই। কারন যাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড বা প্রটেকশন আছে তাদের জন্য এটা কোন ব্যপার নয়। কারন রাষ্ট্রপতি আছেন না ?

অথচ দেখুন এই জাতীয় একটি মামলায় কোন কোন সময় লেগে যায় বছরের বছর আর বাদী ও বিবাদী পক্ষের পকেট হয় উজাড়। যার পুরোটাই যায় আমাদের দেশের তথাকথিত পেশাজীবি বা বুদ্ধিজীবী বলে গলা চেঁচিয়ে যারা কথায় কথায় নীতির কথা বলেন সেই আইনজীবীদের পকেটে। মাঝখানে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হন বাদী। ক্ষতির স্বীকার হন বিবাদীও।

স্বাধীনতার পর এ ক্ষমা করার ট্রাডিশন প্রথম চালু করেন আমাদের দেশের তথাকথিত সেই মহানায়ক, সাবেক সামরিক শাসক মে: জে: জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেভেন মার্ডার সংগঠিত হয়। এই সেভেন মার্ডারের অন্যতম ফাঁসির আসামি ছিলেন তখনকার ছাত্রলীগ নেতা বর্তমানে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান। জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতি হয়ে শফিউল আলম প্রধানসহ অন্যদের ফাঁসির দণ্ডাদেশ মওকুফ করে দেন। যার কারনে আজ অব্দি সেই শফিউল তার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছেন। কারন মনিবের আদর্শের বাইরে কি কোন পালিত কুকুর যেতে পারে !!! আবার অন্য দিকে জিয়ার ক্ষমতার আমলে তিনশত (৩০০) সেনা অফিসারকে আবার ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে হত্যাও করেছিলেন। আজ বিএনপি সেনা অফিসারদের জন্য কান্না করেন !!!

সূত্রাপুরের ব্যবসায়ী আবদুল খালেক রানা ও ফিরোজ আল মামুন-এর জোড়া খুনের মামলায় নয় নম্বর বিশেষ সামরিক আইন আদালতে তাদের ফাঁসির আদেশ হয় আবুল হাসনাত ওরফে গালকাটা কামাল, মহিউদ্দিন আহমেদ ঝিন্টু, আবুল কাসেম মানিক ও শহীদ হোসেনের। জেলে থাকা অবস্থায় ১৯৮২ সালে গালকাটা কামালের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আবার একই মামলার আসামী ১৯৮৭ সালের ৫ ডিসেম্বর পলাতক অবস্থা থেকে আত্মসমর্পণ করে জেলখানায় যায় মানিক। রাষ্ট্রপতি এরশাদের অনুকম্পায় মানিক মুক্তি পায়।

এরপর মহিউদ্দিন আহমেদ ঝিন্টু ২২ বছর বিদেশে পলাতক থাকার পর ২০০৫ সালের ৩ জানুয়ারি দেশে এসে আত্মসমর্পণ করে জেলে যায়। মাত্র ১০ দিন কারাগারে থাকার পর ১৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পায় ঝিন্টু। তাকে মুক্তি দেন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ।

ঝিন্টুর মুক্তি পাওয়ার আগে ফাঁসির দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে সুইডেনের বিএনপির শাখার সভাপতি হয়ে সেদেশে বসবাস করে। ঝিন্টু সুইডেনে থাকাকালে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ তার আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। সুইডেন থেকে প্রকাশিত প্রবাসীর কণ্ঠ নামের ম্যাগাজিনের এপ্রিলের সংখ্যায় প্রকাশিত একাধিক ছবিতে ফাঁসির আসামি ঝিন্টুর সঙ্গে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও তাঁর পত্নী হাসনা মওদুদের সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, সূত্রাপুরের জোড়া খুনের অভিযোগে ঝিন্টু ও মানিকের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফ করা হলো। অথচ তাদের সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত গালকাটা কামালের ফাঁসি হয়ে গেল। একই মামলায় একই অপরাধে গালকাটা কামালের একজনের ফাঁসি দেয়া হলো। আর বিএনপির নেতা বলে ঝিন্টুর মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফ করে দেয়া হলো। গালকাটা কামালের পরিবার যদি বিএনপির কাছে এর জবাব চায় তার উত্তর কি হবে ?

আর এবার সর্বশেষ ক্ষমা করলেন বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব জিল্লুর রহমান। তিনি তার সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে এডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যামামলার মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামী লক্ষ্মীপুর পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহেরের ছেলে এ এইচ এম বিপ্লবকে ক্ষমা করে মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করেন। এ নিয়ে দেশের প্রায় সবারই রাষ্ট্রপতির প্রতি একটা নেতিবাচক ধারনা লক্ষ করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রপতি কি তা জানতে পেরেছেন ?

যারা মৃত্যুদণ্ড ক্ষমা করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছেন তাদের যুক্তি তৎকালীন আইন মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ ষড়যন্ত্র করে তাদের নাম এখানে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। আমরা মানলাম। তাহলে কেসটা রিভিউ করে নিয়ে আইনের মাধ্যমে মুক্তি হলে বেশী ভাল হত না ? কেন এই নগ্ন হস্তক্ষেপ ? আবার কেউ কেউ বলে বেড়াচ্ছেন, রাষ্ট্রপতির আদেশ নিয়ে নাকি কিছু বলা যাবেনা। কেন তিনি কি সব বিতর্কের উর্ধে ? যদি তাই হন, তাহলে কেন এরকম বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিলেন ?

কেউ যদি বিতর্কিত কোন সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তার সমালোচনা হবেই, এটাই বাস্তব জনাব সুরঞ্জিত বাবুরা। এর সাথে সাথে সুরঞ্জিত বাবুদের কাছেও আমার প্রশ্ন আপনারা কি আওয়ামী লিগ ও হাসিনাকে ধ্বংস করতে চান ? যা ১/১১ সময় তথা কথিত সংস্কার কর্মসূচীর আওতায় পারেন নাই ? সেদিন একজন মাত্র মতিয়াই কঠোর ছিলেন, আপনারা তো এস্তেহার ও গঠনতন্ত্র তৈরী করে ফেলেছিলেন, কি ভুলে গেছেন ?

যাক ওসব কথা। সাবেক রাষ্ট্রপতি এএইচএম এরশাদ পুরনো ঢাকার দিলা ও মোখলেছ নামের দুই ফাঁসির আসামির প্রাণভিক্ষা দিয়েছিলেন। ফাঁসির দন্ড মওকুফ হওয়ার পর তারা পরবর্তীতে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়। এরশাদ সরকারের পতনের পর দিলা ও মোখলেছ যোগ দেন বিএনপিতে। এখন আবার বিএনপির নেতারাই বিল্পবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফের বিরুদ্ধে মানববন্ধনসহ নানা ধরনের বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছে। এভাবে অনেক উদাহরন খুঁজলে পাব।

কিন্তু আমার প্রশ্ন, মাননীয় রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করা কি একান্তই প্রয়োজন ছিল ? আপনি কি দেশের অবস্থা জানেন না ? আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সাবেক সরকারের দুই বর পুত্রদ্বয় সহ মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতির বিচার, সংবিধান নিয়ে বিতর্ক, দ্রব্য মূল্য নিয়ে জনমনে হতাশা-ক্ষোভ, বিদ্যুৎ সমস্যা, গ্যাসের ও পানির সমস্যা ইত্যাদির কারনে জনগণ সত্যিই অতিমাত্রায় আপনাদের উপড়, বর্তমান সরকারের উপড় খুবই অসন্তুষ্ট। সেখানে আবার এরকম একটা বিতর্কিত ও প্রশ্নবোধক কাজ কি খুব প্রয়োজন ছিল ? দেশ থেকে কি সবল আইন তুলে নেয়া হবে ? আইন রে শাসন কি আইনের শোষণে পরিনত হবে ? আজ যদি ২১ আগষ্ট মামলার রায় হয় আসামীর মৃত্যুদণ্ড, তারা প্রাণভিক্ষা চাইলে করবেন কি ? যুদ্ধাপরাধীরা মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত হলে প্রাণভিক্ষা চাইলে করবে কি ? যদি আপনার আমলে না হয়, পরবর্তী রাষ্ট্রপতি বা সরকার যদি একই কাজ করেন, তখন আপনার সরকার বা আপনি কি বলবেন ? মাননীয় রাষ্ট্রপতি দেশ-বাসী জানতে চায়। আপনার কাছ থেকেই!!! আপনি একটু বলবেন কি?