গিটার ও রঙ পেন্সিলেরা

সাবরিনা করিম মুর্শেদ
Published : 8 Sept 2011, 05:28 PM
Updated : 10 April 2022, 05:45 AM


রঙ পেন্সিলেরা
চৌকো একটা বড়ো প্যাকেটের মধ্যে রঙ পেন্সিলেরা থাকে। প্যাকেটের সামনের কাটা জানালাটা দিয়ে সূচালো মাথা আর খানিকটা ধড় দেখা যায়। বাকি অংশ ঢাকা পরে থাকে আড়ালে। তারা চব্বিশ জন থাকে একসাথে ।সব রঙ শুষে নিলে যে কালো রঙ থাকে, সে হলো তাদের পান্ডা; কুচকুচে কালো রঙ বড়ই গম্ভীর। তার হয়তো রঙের খেলা দেখাবার সুযোগ হয় না তেমন, কিন্তু ছোট ছোট আঁকিয়েদের কাছে তার অনেক চাহিদা। অনেক সময় সে সীমারেখা টেনে দিলে তবেই বাকি রঙেরা ভরে দেয় সেই সীমানা। লাল, নীল বেগুনী ফুল, গাঢ় সবুজ ঘাসের ওপর হলদে গঙ্গাফড়িং, হাল্কা নীল উদার আকাশ, সব একে একে ফুটে ওঠে আঁকার খাতায় । এই যে মধ্য আশির ঢাকা শহরের এক ভদ্রপল্লীর মনোহারি দোকানে তাদের বাস, সে ভাগ্য কটা পেন্সিলের হয় বলো দেখি? কালো পান্ডা তাই সাঙ্গপাঙ্গদের বলে- সবসময় মাথা উঁচু করে থাকবি। আমরা কি করি বলতো? শার্পনারের ব্লেডে নিজেদের চিরে চিরে অন্যের স্বপ্নে রঙ লাগাই; আর কেউ তা করে?

সারাদিন কত রঙ বাহারি মানুষ আসে যায় দোকানে। কত কথা, কত গান, কত ছবি তারা এঁকে যায় মনে মনে। উদয়াস্ত খেটে যাওয়া ছা পোষারা আসে; দু:খের রাত দীর্ঘায়িত হওয়া জীর্ণ আত্মারা আসে। তেমনি আসে স্বপ্নদেশে হারিয়ে যেতে চাওয়া প্রজাপতিগুলো। তাদের চোখেমুখে এখনো বর্ণিল আশার আলো।আসলে যে ঘোট পাকানো ক্লান্তি, বিরক্তি, হতাশা আর কলুষতা অন্যদের ঘিরে রাখে, তাদের সেগুলো এখনো ছুঁতে পারেনি। সেদিনও এসেছিলো তেমনি একজন। দুধারে দুটো বেণী ঝুলিয়ে, বাবার হাত ধরে তার আগমন। অবাক দৃষ্টিতে দেখেছিলো চারিদিক। সে দৃষ্টি প্রখর নয়, বরং শীতের সকালের রোদের মত নরম। সেই বিধুমুখী যখন তার দৃষ্টি মেলে ধরে, তার চোখের স্বপ্নগুলো যেন ছড়িয়ে পড়ে চারিদিক। তাকে দেখে আকাশি সাত তাড়াতাড়ি গোলাপী কে গুঁতোয়— দেখ, দেখ, দেখেছিস? এই হল সঠিক মানুষ। "একদম! চোখ দুটো দেখেছিস? এই জানে আসল রঙে রাঙিয়ে দিতে" গোলাপী বলে।" আহ, এত কথা কিসের! আমি ওর নাম দিলাম স্বপ্নময়ী। ওর চোখ দেখে বুঝেছি ও ছবি নয়, স্বপ্ন আঁকে," বলে ওঠে পান্ডা কালো রঙ।

কালো রঙ ঠিক বুঝেছিল।স্বপ্নময়ীর চোখে ও হাতে ছিলো সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। চোখ বুজেও সে এঁকে দিতে পারতো জাফলং যাবার পথে পাহাড় চিরে নেমে আসা এগারটি ঝর্ণা। অবিশ্রান্ত জলধারার পাশেই মিলেমিশে একাকার হওয়া গাঢ় সবুজ, কচি কলাপাতা সবুজ, টিয়া সবুজ, শ্যাওলা সবুজ আর সমুদ্র সবুজ – কোথায় কতটুকু দিতে হবে সে ঠিক জানে।রঙের বিদ্যা, আঁকার হাত তার ষোল আনার ওপর দু'আনা, একেবারে আঠারো আনা। আর তাই রঙ পেন্সিলের প্রতি তার গাঢ় ভালোবাসা কখনই ফিকে হবার নয়। চারিদিকে উড়ে উড়ে স্বপ্নময়ীর প্রজাপতি চোখ ঠিক এসে স্থির হয়েছিলো রঙপেন্সিলের প্যাকেটের গায়ে। যেন পানপাতা সরিয়ে শুভদৃষ্টির মতোই চোখে চোখ পড়েছিল রঙ পেন্সিলদের আর স্বপ্নময়ীর। না, এমনটা নয় যে তার কোন রঙ পেন্সিল নেই। তবু সেগুলো এই মরালী গ্রীবার ন্যায় সরু, তীব্র এবং মৃদু রঙের সঠিক মিশেল নয়। আছে কিছু মোম রঙ, ঠিক তার মতোই নরম কোমল। তাদের ভেতরে লাল রঙের আঁচড়ে সাদা কাগজের উল্টো দিকে গোলাপী আভা ফুটে ওঠে- ঠিক তার গালের মতো। কিন্তু স্বপ্নময়ীর স্বপ্ন ধারণ করার ক্ষমতা নেই ওই মোম রঙেদের। আঁকার খাতায় চেষ্টা করলেও তারা জলপ্রপাত ঝরাতে অপারগ।

"কি রে মা, কি দেখছিস?" বলে ওঠেন বাবা।ওমনি হই হই করে ওঠে রঙ পেন্সিলেরা। "এইবার এইবার আমরা ওর সাথে যাবো" শ্যাওলা সবুজ বলে।স্বপ্নময়ী চোখ তুলে তাকায় বাবার দিকে। আচ্ছা, আঁকার খাতায় যেভাবে রঙের ঝড় ওঠে, মুখের কথায় ওঠে না কেন? তার সকল শব্দ যেন আজন্মলালিত জড়তা কাটিয়ে বের হতে পারেনা। জননীর জঠর থেকে মুক্তি লাভ করে যেদিন চিৎকার করে আগমনী বার্তা জানিয়েছিল সে, সেটাই ছিল প্রথম ও শেষ ।
এরপর সহজে নিজের মনের কথা, ভালো লাগার কথা কখনো জোরগলায় বলেনি সে। তারা খেতে পায়না, অথবা এক প্যাকেট রঙ পেন্সিল কেনা সামর্থের বাইরে, এমনটা নয়। তবে, প্রয়োজন আর চাহিদার পার্থক্য করতে সে শিখে গেছে অনেক ছোট বেলায়। বাহুল্য বর্জিত জীবনে তাই একখানা মোম রঙের প্যাকেটই যথেষ্ঠ। অন্তত বাবার কাছে সে কিছুতেই ওই রঙ পেন্সিলের কথা বলতে পারবে না।

চোখ মেলে তাকিয়ে আবার সে চোখ নামিয়ে নেয়। অস্ফুট স্বরে শুধু এটুকুই বলে- 'আমার কিছু চাই না বাবা।'তার দীর্ঘশ্বাসের সাথে রঙ পেন্সিলদের হাহাকার বুঝি বা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

গিটার
সকাল থেকে কয়েকজন এসে টুং টাং করে তাকে হাতিয়ে গেলো। হ্যাঁ, হাতিয়ে গেলো, বাজিয়ে নয়। যত সব হাভাতে খদ্দের তারা; বাজনার ব জানেনা, এদিকে হ্যাংলার মত ছুটে আসে। গিটারের মেজাজটা তাই একদম খিচড়ে আছে। চাঁটি খাওয়া ডুগি তবলার জুটি আবার তাকে স্বান্তনা দিতে এসেছিলো; তাতে তার আরো ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। এই যে অভিজাত বাজনার দোকানে তাদের সকলের বসবাস, এতো আর আজীবন কালের ব্যাপার নয়। একদিন তো সকলকেই যেতে হবে কোন একজনের প্রিয় বাদ্যযন্ত্র হয়ে। তবে সে ওই সুরহীন নির্বোধগুলোর সাথে কিছুতেই যাবে না। সে যাবে তার সুরসম্রাটের সাথে। আহ, তার মত গিটারিস্ট আর কোথায়। আঙুলের ছোঁয়ায় যে প্রবল সুর সে তোলে, গিটারের মনে হয় স্বর্গ থেকে নেমে আসা সেই সুরের গঙ্গার স্রোত কেউ রুখতে পারবে না। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সসাগরা পৃথিবী।
সে এই কথা বললেই ডুগি তবলা খ্যাক খ্যাক করে হাসে। "নিয়ে যে যাবে তোকে, তার জন্য কিছু মাল খসাতে হবে তো, বল? বন্ধুর গিটার বাজিয়ে বাজিয়ে কেমন এক বাজনদার হয়েছে তোর সুরসম্রাট। নিজের যদি গিটার কেনার মুরোদ থাকতো, তাহলে এই বাজনার দোকানে এসে টুং টুং করতে হত না।"
ওরা কেন যেন জীবনের সুর ছন্দ কিছুই মানতে চায়না। নিজেদের ছন্দের কারবার হলেও ওরা বলে সব ছন্দই যে মিলে যাবে এমনটা নয়। আলোর চেয়ে আঁধারে, আর ছন্দের চেয়ে দ্বন্দে ওদের ভক্তি বেশি, বিশ্বাস বেশী। মানুষ হাসলে ওরা তার মনের নির্মলতা না দেখে শুধু কতগুলো কুৎসিত হলদেটে দাঁত দেখতে পায়।

গিটার তেমনটা নয়। তার বসবাস সুরের সাথে, গানের সাথে। তাবৎ সংসারের নিকৃষ্টতা যেন বায়োস্কোপের ছবির মত খটাখট সরে যায় তার চোখের সামনে, কিন্তু ধরা পড়ে না। তার মানসপটে সত্য, সুন্দর আর বিশ্বাস ব্যতীত কিছুই আঁকা নেই। সুরসম্রাট বলেছে সে গিটার কে কিনে নেবে। এটাই তার কাছে সত্য। ভক্তশ্রেষ্ঠ ধ্রুব হয়ে গিটার শুধু তার ভগবানের কাছে যেতে চায়। ডুগি তবলা তাকে নিয়ে আহা উহু করে। বলে, "তুই কবে বড় হবি রে গিটার? দুনিয়াদারি বুঝবি কবে?" ওদের কথায় গিটার শুধু হাসে।

ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে গিটারের চোখ চলে যায় দরজার দিকে। কোথায় সে? এখনও এলো না তো? আজ তো তাকে সত্যি নিয়ে যাবার কথা। পথ চেয়ে বসে গিটারের ঝিমুনি ধরে যায়।
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার উপক্রম। দোকানে বসে কামাল ভাই আর বাবু আয়েসী আলাপে মত্ত। "এই যে জিমি হেন্ড্রিক্স! এতক্ষণে আসবার সময় হল?" কামাল ভাই এর গলা শুনে গিটারের ঝিমুনি ভাঙে। আহ, অবশেষে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো বুঝি। গিটার তার ছয়টি স্ট্রিং এ যেন শিহরণ অনুভব করে। আজ ডুগি তবলা দেখবে, কার কথা ঠিক। কিন্তু সুরসম্রাটকে আজকে বড্ড অন্যরকম লাগছে না? চোখ দুটো দ্যুতিহীন, ঠিক যেন মরা মাছের নিশ্চল চোখের মত। কোন এক অজানা ব্লটিং পেপার যেন শুষে নিয়েছে তার সকল আশা আনন্দ। কামাল ভাই নরম গলায় জানতে চাইলেন কি হয়েছে। "বড় ভাইয়ের ভর্তি পরীক্ষা আছে, কামাল ভাই। বাবা বলেছেন…" ধরে আসা গলায় এর বেশী কিছু বলতে পারে না সে। কামাল ভাইও চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, "আমার হাতও যে বাঁধা ভাই,"। "আমি জানি," এটুকু বলে সে আর দাঁড়ায় না। তার চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে গিটারের স্ট্রিং গুলো কি টনটন করে ওঠে? সেখান থেকে সাত সুর উঠে বুঝিবা সাত আসমানে মিলিয়ে যায়।

পরিশিষ্ট
ইতিমধ্যে ছান্দসিক ঘড়ির কাঁটা ঘুরে গেছে বহুবার। দরগা মহল্লা, মোহাম্মদপুর ছাড়িয়ে সময় পৌঁছে গেছে সাত সমুদ্র তেরোনদীর পাড়, যেখানে নীড় বেধেছে স্বপ্নময়ী আর সুরসম্রাট। জীবন সেখানে গড়িয়ে চলে ঝাঁ চকচকে চার চাকায়; বেগবান সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উঠে যায় আকাশ পেরিয়ে ছায়াপথের দিকে, যেখানে আঁকার খাতার নীল ফুটকি দেয়া তারাগুলো ঝিকমিক করে।
যে পৃথিবী স্বপ্নময়ী আর সুরসম্রাটের, সে আবর্তিত হয় সংসার নামের এক সূর্যের চারপাশে। নিজ অক্ষরেখায় ভর করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে সে সতত ঘূর্ণায়মান। এই সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ টানকে উপেক্ষা করা বা কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হওয়া প্রশ্নাতীত। এই সংসার সূর্যের আলোয় ভরে ওঠে স্বপ্নময়ী আর সুরসম্রাটের জীবন। ঠিক সূর্যের মতই তারা তাদের ঘরের দুটি সূর্যমুখীকে আলোয় ভরিয়ে দিতে চায়। রঙধনু থেকে এনে দিতে চায় সাত রঙ।
তাদের ইচ্ছের শুয়োপোকা প্রজাপতি হয়ে ডানা মেলবার আগেই স্বপ্নময়ী আর সুরসম্রাট তা পূরণে ব্যস্ত হয়ে পরে। কখনো তাতে ওই সূর্যমুখীরা সূর্যালোকে পরিপুষ্ট ফুলের মতো হেসে ওঠে, কখনো আবার মেঘে ছাওয়া আকাশের নিচে নেতিয়ে পরা সূর্যমুখী হয়ে যায়। কখনো মায়ের মুখে, "এতো কাগজ, এতো রঙ পেন্সিল, রঙতুলি ছড়িয়ে থাকে, মাঝে মাঝে একটু ছবি আঁকলেও তো পারো," –এর প্রতিউত্তরে আহ্লাদ, অবহেলা, আর বিরক্তি মেশানো ভ্রূকুঞ্চন দেখা যায় : "ইউ নো আই ডোন্ট ফিল লাইক ইট, মা।"
কখনো তাদের বাবা কাকভোরে একহাতে ব্রিফকেস আর একহাতে টাই গোছাতে গোছাতে বের হবার সময় মেঝেতে ফেলে রাখা গিটারে হোঁচট খায়। এখন আর সুরসম্রাটের আঙুলে সুরের ঝড় ওঠে না। এক পলক গিটারের দিকে তাকিয়ে সে পা দিয়েই সরিয়ে দেয়।
আঁকার ক্লাসের উপস্থিতিতে ক্রস চিহ্ন পরতে থাকে। মিউজিক টিচার বদল হতে থাকে। রঙ পেন্সিলেরা আর গিটার বোঝে তাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে। কারো স্বপ্ন আঁকা, অথবা কারো সুরের মালা গাঁথা আর তাদের কাজ নয়। চৌকো স্ক্রীন গুলো দখল করে নিয়েছে তাদের ভাগের সময়।
তাই কোন এক সময় অসহায় রঙ পেন্সিল গুলোর ঠাঁই হয় ট্র্যাশ ক্যানে। আর অভিমানী গিটার পরে থাকে বেসমেন্টে।