৫৮ বসন্তের নিঃসঙ্গ নারী: তার কী হবে?

ডাক্তার সুলতানা আলগিন
Published : 14 Oct 2012, 06:53 PM
Updated : 14 Oct 2012, 06:53 PM

৫৮ বছর নিঃসঙ্গ এক নারী। ৬৩ বসন্ত পেরুনো নিসঙ্গ এক পুরুষ। এখন তাদের কি হবে। কোথায় পাবেন তারা আশ্রয়। তাদের নিসঙ্গতা কাটানোর উপায় কি! এদের কথা আমি জেনেছি লায়লা ও শামসুর নামের দুজন তরুন-তরুনীর কাছে থেকে। লায়লা একাধিকবার লিখে জানিয়েছেন তার আত্মীয়ের কথা।

কয়েকজন ভুক্তভোগী আমার ফেসবুক একাউন্টেওেমেসেজ পাঠিয়েছেন তাদের বয়স্ক আত্মীয়দের সমস্যার কথা জানিয়ে। ব্লগে লিখে সরাসরি সমস্যাক্রান্ত মানুষের সাথে এই ভাবে মিথষ্ক্রিয়া হবে এটা আমাকে অভিভুত করেছে।

শামসুর নামে একজন তার ফুপুর কথা লিখেছেন যার বিয়ে হয়নি। তার সমস্যা কিছুটা বিচিত্র। ফুপু ছিলেন খুব নাক উচুটে। তার ধারনা ছিল পুরুষরা নোংরা হয়। তাদের গায়ে গন্ধ থাকে। তারা নাকি গোছল করে না। একটা পুরুষের সঙ্গে এক বিছনায় তিনি কিভাবে থাকবেন-সেটা ভাবতে ভাবতে তার জীবনের মূল্যবান ৫৮ বসন্ত চলে গেছে। এখন খুবই দুর্বিষহ জীবন সেই ফুপুর। কোন মফস্বল শহরে তিনি থাকেন। অসুস্থ। তাকে দেখার কেউ নেই। ভাগ্নে ভাইপো ভাইজি কেউ দেখে না। শামসু দেখতে পারেন না। কেননা তিনি চাকরি করেন চট্টগ্রামে। অনেক দূরে। এই ফুপু এখন সবাইকে দোষারোপ করছেন কেন তাকে বয়সকালে বিয়ে দেয়া হল না। কেন তাকে তার ভাই বোন দুলাভাই রা জোর করেন নি। কেন তার টালবাহানাকে তারা মেনে নিয়েছিলেন। শামসু জানতে চেয়েছেন_ এখন কি করণীয়।

দুটো সমস্যাই আমার মন ছুয়ে গেছে।
তদুপরি বেশ কিছুকাল আগে এক রোগী এটেন্ড করলাম- তিনি অতি মুরুব্বি। বয়স অনেক। বিয়ে পাগল। বেশ কয়েকটা বিয়ে করেছেন। আরও করার খায়েশ। রোগীর আত্মীয় স্বজনরা খুবই পেরেশান। কিছুতেই তাকে সামলানো যাচ্ছিল না। আমার রোগীর ক্ষেত্রে আমি কাউন্সেলিং থেরাপি এপ্লাই করেছিলাম। কেননা এই সমস্যা লায়লা বা শামসুর বর্নিত সমস্যার মত নয়। মুরুব্বি রোগীকে তার সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা,ছেলে মেয়ে দের সমস্যা;একাধিক বিয়ের নানা জটিলতা; তার অব্যাহত আগ্রহের কারনে বর্তমানে অব্যাহত নানা সমস্যার ব্যাপার গুলো বেশ কয়েকটা শেসন ধরে বোঝানোয় একটা সুফল পাওয়া গেছে। তার আত্মীয়দের নিয়ে যৌথ কাউন্সেলিং শেসন হয়েছিল। তাতে পরষ্পর কথা বলেছেন। মন খুলে কথা বলতে পেরেছেন সকলে। যে কথা গুলো পারিবারিক পরিমন্ডলে তারা বলতে পারেন নি-তা চিকিৎসকের মধ্যস্থতায় বলা সম্ভব হওয়ায় তারা হালকা হয়েছেন। মুরুব্বি অনেকটা সংযত হয়েছেন। প্রথম দিকের কাউন্সেলিং-এ পক্ষগুলো খুবই বিবদমান ছিল। পরষ্পর দোষারোপ করেছেন। নানা রকম কটুক্তি হয়েছে তাদের মধ্যে। কেন বুড়ো এখনও বিয়ে করতে চায় অসংযতভাবে তা জানতে চেয়েছেন তার নিকটাত্মীরা। মুরুব্বি খুবা বিব্রত হয়েছেন। তার সম্পত্তি দেবেন না হুমকি দিয়েছেন। তারপরও আমরা সমঝোতায় যেতে পেরেছি। তার কৃতিত্ব আমার নয়। কৃতিত্ব হল আলোচনা পদ্ধতির। আমরা সিস্টেমিক কাউন্সেলিং-এর উপর পড়াশোনা করায় তা ফলপ্রসু হয়েছে।

এখন কি আপনারা ভাববেন শামসুর বা ণায়লাকে কি আমি আমার চেম্বার বা হাসপাতালে আসতে বলবো কিনা। মো্টেই তা বলব না। পারিবারিক পরিমন্ডলেই বিনা খরচেই এই কাউন্সেলিং হতে পারে। যখন সাইকিয়াটিস্টরা ছিলেন না ; তখন কি সমাজে সংসারে এই সমস্যা ছিল না। সেসবের কি সুন্দর সমাধান হয় নি। অবশ্যই হয়েছে। তখন পারিবারিক পরিমন্ডলে প্রীতিময় শৃংখলা ছিল। সবাই বসে পারিবারিক বৈঠক করা হত। সেখানেই আসতো সুন্দর সমাধান। তার বৈজ্ঞানিক আঙ্গিকেই এসেছে আধুনিক কাউন্সেলিং প্রথা। এটাও মূলত
বৈঠক। এখনও যদি আপনারা ধৈর্য ধরে বসতে পারেন ;তাহলে চিকিৎসকের সহযোগিতা ছাড়াই সমস্যার সুরাহা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে ধৈর্য শৃং্খলা খুব দরকারী। এই বৈঠক মানে ঝগড়া ঝাটি নয়। মারামারি দোষারোপ নয়। গালাগালি নয়। যদিও আমার কাউন্সেলিং-বৈঠকগুলোতেও এধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। চিকিৎসকের তখন কাজই হল সেই ঝগড়াঝাটিকে প্রশমিত করে তাদেরকে একটি সমাধানের দিকে নিয়ে যাওয়া। বা তাদের যেতে সহযোগিতা করা। পারিবারিক পরিমন্ডলেও যখন এধরনের সুরাহা বৈঠক হবে_ তখন সবাই যদি ঝগড়ায় লিপ্ত হন_ তবে ভাল ফল আসবে না। বিবদমান পক্ষগুলোকে কথা বলতে দিতে হবে। আবার সহনশীল পরমতকে গুরুত্ব দেবার মন থাকতে হবে। আমি যে জিনিষটাতে খুবই জোর দেব_ তা হল পরিবারের মধ্যে পারিবারিক বিষয়গুলো নিয়ে মাঝেমধ্যেই আলোচনা বৈঠক করুন। পরষ্পরকে বোঝার চেষ্টা করুন। এক অপরের উপর মত চাপিয়ে না দিয়ে অন্যের মতের গুরুত্ব বোঝার আগ্রহ দেখান। নাগরিক ব্যস্ত জীবনে সময় খুবই দামী। সবাই ছুটছি। তারপরও বসুন। একে অপরের সঙ্গে কথা বলুন। ভাই বোন বাবা মা চাচা চাচী মামা মামী ফুপু মিলে নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে আলাপটা বাড়ান। আমরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। শেয়ারিং হয় না। সবাই মিলে বসা হয় না। বসলে অনেক সমস্যার সৃষ্টিই হবে না।সাইকোথেরাপির জন্য সাইকয়াট্রিস্টএর কাছে আসতে হবে না।


এবার আসি লায়লার সমস্যা নিয়ে। তার যে বিয়ে পাগল চাচা- যার বয়স ৬৩। তিনি আদতে বিয়ে পাগল নন। ওনারা এমনটা মনে করল্ওে আমি তা মোটেই মনে করি না। অতীতে যা হয়েছে। এখন তা শুধরানো যাবে না। এখন তার দরকার একজন সঙ্গিনী। তিনি এখন নিসঙ্গ। কেউ তাকে সময় দেয় না। তার বিয়ে হয় নি বলে তার এখন কোন তরুনি বা যুবতীকে বিয়ে করা ঠিক হবে না। সম্ভবও নয়। তবে বৈবাহিক বন্ধনে তার জন্য যে একজন সঙ্গিনী খুজে বের করা একেবারে অসম্ভব নয়। সে সাথী হতে হবে তার বয়সের সঙ্গে মানানসই। এক্ষেত্রে বৃদ্ধস্য তরুনি ভার্যা হলে তা ডেকে আনবে বড় বিপর্যয়। সঙ্গ হয়ে পারে দুঃসঙ্গ। তার সাথে পারিবারিক ভাবে বসুন। কথা বলুন। তাকে বোঝারচেষ্টা করুন। যদি সম্ভব হয়- তার বয়সএর সঙ্গে মানান সই একজন সঙ্গীনী বের করুন। বৃহৎ আত্মীয় পরিমন্ডলে খোজ করুন। দেখা যাবে এমন কোন নারী আছেন যার বিয়ে হয় নি। হলেও সধবা নন। সেরকম ক্ষেত্রে তাদেরকে নতুন বন্ধনে মিলিয়ে দিন। দুজনই হয়তো নিঃসঙ্গ। মিলন বন্ধনে তারা উভয়েই জীবনের এই পর্বে খুজে পাবেন বাচার নতুন ঠিকানা। এখন তো আমাদের আয়ু বাড়ছে। এই পরমায়ু হয়ে উঠতে পারে আরও অর্থময়। সুখময়।

শামসুর যে সমস্যার কথা বলেছেন-সেটা আমাদের সমাজে ব্যতিক্রম নয়। মনে হয় তার ফুপু প্রথম জীবনে শুচি বাই রোগ ভুগছেন। সেটার প্রতি যথাযথ নজর দেয়া হয় নি। সাইকিয়াট্ট্রিতে বৈজ্ঞানিক সুফলদায়ক চিকিৎসা রয়েছে। তার সুচিকিৎসা এখনও সম্ভব। যদি তিনি পুরুষদের সম্পর্কে এখনও এমন ধারণা পোষন করেন_ তবে প্রথমে সুচিকিৎসা করা একান্ত প্রয়োজন। তিনি বাই মুক্ত হলে তখন তার সঙ্গে বসে তার নিসঙ্গতা দুর করার পথ খুজতে হবে।

আশ্চর্য একটা ব্যাপার_ উপরের দুটো ঘটনা প্রমান করে নিসঙ্গ নারী পুরুষ উভয়েই আছেন আমাদের চারপাশে। তারা কষ্টে আছেন। তারা যদি পরষ্পরের হাত ধরে নিসঙ্গতা মুক্ত হতে চান_বাচর পথ খুজতে চান _আমাদের উচিত হবে সামাজিক পারিবারিক যোগাযোগের মাধ্যমে বৈবাহিক বন্ধনে তাদের মিলিত হওয়া এবং জীবনের পথে এগুবার সুগম পথ করে দেয়া।