কবি সাহিত্যিকরা কি সত্যিই পাগল!!

ডাক্তার সুলতানা আলগিন
Published : 19 Oct 2012, 06:10 PM
Updated : 19 Oct 2012, 06:10 PM

সৃষ্টিশীলতা কি মানসিক রোগ! কবি সাহিত্যিকরা কি তবে পাগল!!

কবি-সাহিত্যিক-চিত্রশিল্পীদের নানা ধরনের উদ্ভট কর্মকাণ্ড দেখে কেউ কেউ মুখ ফসকে তাদের 'পাগল' বলেও মন্তব্য করে বসেন। সৃষ্টিশীলদের এই পাগলামি কি কেবল কথার কথা?

বিবিসি নিউজ অনলাইন এক রিপোর্টে বলছে -গবেষকরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন, কথার কথা নয়, সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে পাগলামির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাঁরা গবেষণায় সৃষ্টিশীল ও জ্ঞানী মানুষের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সিজোফ্রেনিয়া ও বাইপোলার ডিজঅর্ডারের (হঠাৎ করেই অধিক আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ আবার একটু পরেই অবসাদগ্রস্ত হয়ে যাওয়া) গভীর যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। এই গবেষণা নিবন্ধ সম্প্রতি সাইকিয়াট্রিক রিসার্চ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।

১০ লাখের বেশি মানুষের ওপর এ গবেষণা চালিয়েছেন সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। এতে তাঁরা দেখতে পান, সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে মানসিক অসুস্থতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষ করে লেখকরা মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে শীর্ষে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া ও ইউনিপোলার ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আর তাঁদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও সাধারণের চেয়ে দ্বিগুণ। নৃত্যশিল্পী ও আলোকচিত্রশিল্পীদেরও বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা।

তবে সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের অন্য একটি অংশের এ ধরনের মানসিক রোগ নেই বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ক্ষুধামন্দা, অটিজমসহ অন্য রোগের লক্ষণ রয়েছে।

উপরে যে কথা গুলো বললাম সেগুলো আমার কথা নয়। বিবিসি অনলাইনের সূত্র ধরে পত্রিকান্তরে পড়ে জেনেছি একথা।

তবে এটা সাধারণভাবে আমরা অনেকেই কবি সাহিত্যিকরা খুব বড় প্রতিভা হিসেবে প্রকাশ না করলে তাদের এই প্রবনতাকে পাগলামি বলে ধরে নেই। তাদেরকে নিয়ে নানা রঙ্গ ব্যাঙ্গ করি। তাদের এমন উপদেশ দিতে কসুর করি না-রেখালেখির পাগলামি না করে কিছু একটা করতে। যাতে দুপয়সা আসে। আবার তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে অতি আবেগ দেখে তাকে অস্বাভািাবকতা বলে সাব্যস্ত করি। লেখক কবি নাট্যকার সাহিত্যিকরা যখন নিজের সৃষ্ট চরিত্রের সাথে মিশে গিয়ে তার সাহিত্য রচনা করেন-তখন তাদের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু আচরন দেখতে পাই। কিংবা শুনতে পাই। শুনতে পাই বলছি একারণে যে কবিদের সান্নিধ্য ধন্য হওয়ারর সুযোগ আমদের মত সাধারণ মানুষ সবাই পাই না। তবে মেডিকেল কলেজ জীবনে দেখেছি যারা একটু কবি কবি স্বভাবের;তাদের ভাব স্বভাব অন্যরকম। তারা নরম কোমল ;অতিমাত্রায় ভালবাসাপ্রবন। তাদের চুল বড়;উসকো খুসকো। চলাফেরাতেও বড় কবি কবি ভাব। একই সঙ্গে একথা স্বীকার না করাটা অন্যায় মনে হচ্ছে_সিএমসি_চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে যে বিখ্যাত_ইতোমধ্যেই যে দেশের বড় কবিদের মাঝে চলে এসেছেন_ সেই কবি মোশতাক আহমেদ-সবসময় খুব স্বাভাবিক ছিল্ তার মধ্যে কবি সুলভ বাড়াবাড়ি দেখি নি। কবি মোশতাকের মত কবিরাই শেষ কথা নয়। তবে কবি সাহিত্যিকদের নির্জনতাপ্রিয় জীবন;অনেকের অমিশুক স্বভাব; জীবনতরঙ্গের নানা চ্যালেঞ্জ থেকে দূরে থাকা_বিচিত্র জীবনপ্রিয়তা-ইত্যাদি সুবিদিত। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই প্রবনতা আছে। তবে তারা বিখ্যাত নন বলে যখন কোন বিখ্যাত কবি বা উপন্যাসকার একাধিক বিয়ে করে জীবনের অস্বাভাবিকতা প্রকাশ করেন তখন তা ব্যাপক আলোচনায় আসে।

বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনজরুল উত্তর শীর্ষ কবি জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর আগে বিষাদগ্রস্ত ছিলেন_তিনি জীবন ভর নির্জনতা প্রিয় ছিলেন তা আমরা কম বেশী জানি। কলকাতায় তার মৃত্যু ট্রাম দূর্ঘটনায় না আত্মহত্যার মত দুর্ঘটনা ছিল তা নিয়ে কানা ঘুষা আছে। বরিশালের আরো দুই মহৎ কবি আবুল হাসান ও রুদ্রদা -তাদের অনবদ্য জীবন নিয়ে কত কথকতা। মার্কিন প্রখ্যাত কবি সিলভিয়া প্লাথ মারা গিয়েছিলেন চরম বিষাদে।

এগুলো কি ব্যতিক্রম! না প্রতিভার সঙ্গে সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে মানসিক রোগের ব্যাপক প্রকোপ রয়েছে তা নিয়ে জোর দিয়ে কিছু বলার জ্ঞান আমার নেই।

তবুও মনোরোগ চিকিৎসক-গবেষকদের গবেষনার তথ্য আমরা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারি কি? উপন্যাসিকরা নিজেদের লেখা চরিত্রের সাথে একা একা বিড় বিড় করে কথা বলেন। মনে করেন চোখের সামনেই চরিত্রগুলো রয়েছে। হাটাচলা করছে। কথাবার্তা বলছে। ওরা যেন চোখের সামনেই দাড়িয়ে আছেন। হুমায়ুনের নাটকে এমন পাগলাটে প্রবনতা আমরা দেখেছি। লেখক চরিত্রের সঙ্গে রাগ করছেন। তাদের কষ্টে কষ্ট পাচ্ছেন। কাঁদছেন। আদের আনন্দেও ভাগীদার হচ্ছেন। হাসছেন।

মনোরোগবিদ্যা ও মনোবিজ্ঞানের ছাত্র এবং পেশাদার মনোরোগবিশেষজ্ঞ হিসেবে এসব আচরণকে আমি অস্বাভাবিক বলব না। বলব স্বাভাবিক। খুবই স্বাভাবিক।কবি যদি বনলতা সেনকে নাই দেখবেন ; নাই বা অনুভব করবেন তবে আমরা বনলতা সেনের মত সেরার সেরা কবিতা কেমন করে পাব। উপন্যাসিক যদি তার চরিত্রের দুঃখকষ্টকে নাই কাদেন তবে তবে জীবন ঘনিষ্ট উপন্যাস আমরা কেমন করে পাব। তবে সমস্যাও রয়েছে। যখনই এই লক্ষণগুলো অতি মাত্রায় প্রকাশ পাবে:যখনই তা অতিমাত্রায় মানুষকে অ্যাফেক্ট করবে_তখনই তা মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষ্মণ বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। তখন তাকে কবি সাহিত্যিক সুলভ স্বাভাবিক আচরণ বলে মনে করার কোন কারণ দেখি না।

তখন তিনি কবিই হন বা সাহিত্যিকই হন কিঙবা সাধারণ মানুষই হন তার চিকিৎসা দরকার। যত দ্রুত চিকিৎসা সুস্থতার সম্ভাবনা তত বেশী। যত দেরী তত ভয়।

আবার দেখা যায় – অনেকে লেখার ম্যুড পাচ্ছেন না। লেখায় মন বসাতে পারছেন না। কোন থিম আসি আসি করেও মাথায় আসছে না। লিখতে বসেও মনে হচ্ছে আমার বুঝি আর লেখা হবে না। আমাকে দিয়ে বুঝি আর হবে না। আমার কবিত্ব শক্তি শেষ। আমাকে নিয়ে সবাই বুঝি হাসাহাসি করে। বলাবলি করে_ওর স্টক শেষ। এই প্রবণতাকে যখন কেউ লাগাতার মনেও মননে প্রশ্রয় দেন_তখন তা তার মধ্যে হীনমন্যতা হতাশা তৈরি করে। তিনি আস্তে আস্তে বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত হন। নিজের অজান্তেই রোগের গহীনে তলিয়ে যেতে থাকেন। সুইসাইড করার চিন্তা ভাবনাও তাকে পেয়ে বসতে পারে। নিজেকে কষ্ট দেয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। হাত পা কাটা মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি।

এমন কথা কমবেশী কানে আসে_কবি দের কারো কারো মধ্যে গাজা মদ খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। শিল্পী-গায়ক সাহিত্যিকদের মধ্যে এই প্রবণতা রয়েছে। এই বদঅভ্যাসকে কোন অবস্থাতেই কবি সাহিত্যিক সুলভ প্রবণতা ভাবার অবকাশ নেই। এটি অন্য সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যেমন মানসিক সমস্যা প্রসূত রোগ তেমনি প্রতিভাবানদের ক্ষেত্রেও তাই। মদ গাজা চরস খাওয়া সেবনের জন্য কবি সাহিত্যিক শিল্পীদের জন্য আলাদা কোন স্পেস নেই। তাদের জন্য স্পেশাল কোন অজুহাতের মওকা নেই। গাজা মানুষের মনের অবসাদ ও উচ্ছাস দুটোই বাড়াতে পারে। তবে প্রতিভা বিকাশের জন্য সহায়ক_এমন ধারনা কেবল গেঁজেল বা মাতালের পক্ষেই করা স্বাভাবিক। এইসব বদ অভ্যাস সাইকোটিক সমস্যা। এগুলো দ্রত চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্য। অন্যথায় যত দেরী;তত ক্রনিক ডিসঅর্ডারের আশঙ্কা। বেড়ে যেতে পারে সাইকোটিক ডিপ্রেসিভ ডিস অর্ডারের লক্ষণগুলো। যে পরিবারে ; যে বংশে মানসিক রোগের ইতিহাস আছে-তাদের মধ্যে এ ধরণের নেশার আগ্রহ বেশী হয়।

সব কথার শেষ কথা হল রোগ রোগই। মানসিক ব্যাধি কোন বিশেষ পেশার লোকের জন্য নির্ধারিত _এমনটি বোকার ভাবনা। মানসিক রোগ হতে পারে আমার আপনার সকলের। আর ১০টা রোগের মতই এটি সাধারণ রোগ। এটা কোন রহস্যময় বিশেষ রোগ নয়। সর্দি কাশি জ্বর সহ অন্য োগের যেমন নিরাময় সম্ভব; এই রোগের তেমনি নিরাময় সম্ভব। শেষ কথাটা একটু হেসেই বলি _মানসিক রোগ কবি সাহিত্যিকদের জন্য বরাদ্দ কোন উচ্চমার্গের রোগ নয়। এটি সকল মার্গের রোগ। অতি সাধারণ এলোপ্যাথিক রোগ। ওঝা, পীর, ঝাড়ফুঁকের রোগ এটি নয়। এই রোগ হলে অপচিকিৎসা নয়; দরকার বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক এলোপ্যাথিক চিকিৎসা। প্লিজ ওঝা পীর ঝাড়ফুঁকের কাছে গিয়ে মানসিক রোগীর জীবন বিপন্ন করে শেষে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঝর কাছ জটিল অবস্থায় আসবেন না। মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা পেশাদার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বাদে সাইকো অপচিকিৎসকদের কাছে গিয়ে এলোপ্যাথি প্রেসক্রিপাশন নেবেন না। ইদানিং ডাক্তার নন;পেশাদার চিকিৎসক নন- এমন কিছু লোক মানসিক রোগের চিকিৎসা দিচ্ছেন। রেডিও টিভিতে এদের দৌরাত্ম্য দেখে বিভ্রান্ত হবেন। মনে যিনি প্রকৃত চিকিৎসক নন; তার তত বিজ্ঞাপন ;নানা টিভি প্রেসক্রিপশন অনুষ্ঠান বেশী। এত মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বেশী। পেশাদার চিকিৎসকদের কাছে এরা আসছেন সাত হাত ঘুরে। রোগের প্রকোপ মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাওয়ায় আমরা বিব্রত হচ্ছি বেশী। হিমশিম খাই রোগীকে নিয়ে।

আবারো বলছি চেম্বারে নয়; আপনাদের চেম্বারে আসতে বলছি না। এই লেখা লিখি সচেতনতা তৈরীর জন্য। বর্তমানে দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ভার্সিটিতে _বিএসএমএমইউতে মানসিক রোগ বিদ্যা বিভাগে পেশাদার বিশেষজ্ঞ মনোরোগচিকিৎসকদের দ্বারা অতি অল্প খরচে মানসিক রোগের সুচিকিৎসা হচ্ছে। একাধিক সিনিয়র অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অন্য জুনিয়র সুযোগ্য চিকিৎসকবৃন্দ এখানে মনোরোগ চিকিৎসা ও সাইকোথেরাপি দিচ্ছেন। ওঝার কাছে কেন যাবেন, টিভির বিজ্ঞাপন-অবৈজ্ঞানিক আলোচনায় বিভ্রান্ত হবেন না। একজন ডাক্তার চিকিৎসা বিদ্যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত না হয়ে সর্বরোগহর ডাক্তার হতে পারেন না। মনোরোগবিদ্যা মেডিকেল সাইন্স। এটি কোন সৌখিনবিদ্যা নয়। ওঝার বিদ্যা নয়। ওঝাদের বর্জন করুন। ঝাড়ফুক বর্জন করুন। নন-মেডিকেলদের কাছ থেকে মেডিকেল প্রেসক্রিপশন নেবেন না। একা সরকারের পক্ষে সবকিছু দেখা সম্ভব নয়। আমাদের সচেতন হতে হবে। শুধু ওঝা ঝাড়ফুকদের দোষ দেই কেন; স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোয় নন-মেডিকেল মহাবিশেষজ্ঞ সর্বরোগহর চিকিৎসাদের আধাঘন্টা একঘন্টা দুঘন্টার অনুষ্ঠান দেখে বিভ্রান্ত হবেন না। চিকিৎসা যত ভন্ডামি পূর্ন, তার বিজ্ঞাপন তত বেশী। এত পুরানা প্রবাদ।