ফেসবুক ব্যবহারকারী নারীরা কি সত্যিই অসুখী?

ডাক্তার সুলতানা আলগিন
Published : 14 Nov 2012, 06:10 PM
Updated : 14 Nov 2012, 06:10 PM

কত আজব গবেষনা হয় এই দুনিয়ায়। কে সুখী কে অসুখী-এই প্রশ্নের জবাব খুজতে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে ফেসবুককে। ফেসবুক এখন অবশ্য রীতিমত ফোবিয়ায় পরিনত হয়েছে। কিশোর কিশোরী যুবক-তরুণ মাঝবয়সী সবাই এখন কমবেশী হাজিরা দিচ্ছে ফেসবুকে। অবশ্য যাদের কাছে ইন্টারনেট সহজ লভ্য তাদের কথাই বলছি।

পত্রিকান্তরে জেনেছি শান্তি সৌহার্দ্যের দেশ সুইডেনে সম্প্রতি এক গবেষনা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে যেসব নারী ফেসবুক ব্যবহার করেন তারা নাকি অসুখী। বিষয়টি কৌতূহল জাগানোর মত। সত্যিই কি তাই? নারীরা যখন অসুখী তখন ফেসবুক ব্যবহারকারী পুরুষদের ব্যাপারে কি বলবেন সুইডেনের গবেষকরা। বলাই বাহুল্য ফেসবুক ছাড়া লাখো কোটি মানুষের দিন যাপন অচল।

বিশ্বকে আরো ছোট করে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফেসবুক। কিন্তু এই ফেসবুকই নাকি আবার নাওয়া, খাওয়া, ঘুম কেড়ে নিয়ে কারো কারো জীবন অসুখী করে তুলছে। সুইডেনের সমীক্ষায় দেখা গেছে, নিম্নবিত্ত ও স্বল্প শিক্ষিত যেসব মানুষ ফেসবুকে বেশি সময় কাটায়, তাদের প্রায় সব তাই কমবেশি ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী। এর মধ্যে নারীদের কাউকেই সুখী পাওয়া যায়নি।

সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ জানায়, তারা প্রতিদিনের রুটিনে একটা সময় রাখে ফেসবুকের জন্য। তরুণদের কাছে ফেসবুক প্রাত্যহিক অভ্যাস এবং সময় কাটানোর একটা মাধ্যম মাত্র। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এটি একে অন্যকে জানার মাধ্যম। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, নারীরা গড়ে দিনের প্রায় ৮১ মিনিট এবং পুরুষরা ৬৪ মিনিট ফেসবুকে কাটান।

পুরুষদের এক-তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণকারী জানান, তাঁরা ফেসবুকে অন্যকে বিরক্ত করে থাকেন। আর এক-চতুর্থাংশ অংশগ্রহণকারী জানান, তাঁরা গর্ব করার মতো তথ্য প্রকাশের জন্য ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন। আর নারীরা ফেসবুকে তাঁদের আবেগ এবং সম্পর্ক নিয়ে লেখেন বেশি।

গুটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের ছাত্র লেইফ ডেন্টি তাঁর পিএইচডির অংশ হিসেবে এই সমীক্ষা চালান। তিনি জানান, অবচেতনভাবেই মানুষ ফেসবুক ব্যবহারকে তার অভ্যাসে পরিণত করেছে। ধীরে ধীরে এটি একটি ভয়াবহ আসক্তিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।

গত বছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুইডেনের ১৮ থেকে ৭৩ বছর বয়সী প্রায় এক হাজার মানুষের ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল।

ফেসবুক আসক্তি দেশে বিদেশে বেশ আলোচিত। ফেসবুকের ভার্চুয়াল বন্ধুরা অনেকের সঙ্গী। হয়তো মুখোমুখি দেখা হচ্ছে না অনেকদিন; হয়ত এক অপরে ভিনদেশে রয়েছেন-তাদের মাঝে যোগসূত্র রক্ষা করছে ফেসবুক।আবার অনেকের অচেনা বন্ধুও কম নয়। যাদের মাঝে দেখা হয়নি তারা বাধা পড়েছেন ফেসবুকের বন্ধনে। সমীক্ষায় এইযে অসুখী নারীদের কথা বলা হচ্ছে তাদের হয়তো মনোসমস্যা হল নিঃসঙ্গতা। কিংবা আনন্দময় জীবন যাপনের জন্য আত্মীয় সঙ্গী সাথী না থাকা। সেই শূন্যতা পূরণের জন্যই তারা নিজেদের শেয়ার করছেন ফেসবুকে। তাদের সুখ দুঃখ সেখানে ভার্চুয়াল বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করছেন। তাতে খুজে পাচ্ছেন প্রশান্তি। আশার কথা এই য়ে গবেষনায় বলা হয় নি ফেসবুক এইসব নারীর জীবন অসুখী করে তুলছে। তারা আরও অসুখী ও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সেটা হলে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তাম। উন্নত দেশ সুইডেন। জীবন সেখানে প্রশান্তিময়। সুখের সকল উপকরন সেখানে মজুদ। পরিচ্ছন্ন দেশ। ছবির মত সব কিছু সাজান সুন্দর। তারপরও সুইডিশ নারীরা অসুখী কেন! সুখের এত আয়োজন তাদেরকে সুখী করতে পারছেন না কেন! তবে কি সুখের ব্যাপক আয়োজন সেখানে অসুখের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।

ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে ইউরোপের ছবির মত সুন্দর দেশগুলোর প্রশান্তির মাঝে নিঃসঙ্গতার নিঃশব্দ সুর। প্রান আছে প্যানের কলতান নেই। সুখ তো ব্যাপক আয়োজনে হয়না। সুখ কেবল অঢেল উপকরণে হয় না। সুখের জন্য মন চাই। সুখ উপভোগের জন্য উচ্ছল প্রান চাই। আমাদের দেশে হয়তো তথাকথিত সুখের জন্য অঢেল আয়োজন নেই। কিন্তু এখনও আমরা কম আয়োজনে সুখী কম নই। বিত্ত নেই। বেসাত নেই। তবুও সুখী। এর কারণ হল সামাজিক বন্ধন। পারিবারিক বন্ধন। হয়ত শত সমস্যা আছে। তারপরও সামাজিক পারিবারিক বন্ধন আমাদের জন্য কিভাবে আর্শীবাদ হয়ে কাজ করছে অঢেল সুখের সন্ধানের হতাশায় আমরা তা টের পাচ্ছি না। সুখ যখন অধরা হয়ে যায়; তখন তা ফেসবুকেও যায় না পাওয়া। ইউরোপীয় নারীর জন্য হতাশার অসুখের একটা প্রধান কারণ পারিবারিক বন্ধনের শৈথিল্য। বয়স যখন বেড়ে যায়; বন্ধনগুলো ঢিলে হয়ে যায় তখনই তাদের পেয়ে বসে হতাশায়। নিঃসঙ্গতায়। বাড়ি আছে বিত্ত আছে জীবন যাপনের সব দরকারি উপকরন আছে। নেই শুধু পারিবারিক বন্ধনের আস্থা। তখন ফেসবুকও আশ্রয় হতে পারে না। এই কথাগুলো বলছি এ কারনে যে আমাদের সুখ স্বস্তির যে উপকরন গুলো আছে সেগুলোকে আমরা যেন অবহেলা করি। পারিবারিক বন্ধন ছিন্নের খেলা ইউরোপীয় মানসকে করে তুলছে নিঃসঙ্গ। সুখের সায়রের পাখি হয়েও তারা সুখের ঠিকানা খুজে পাচ্ছি না। আর নানা সঙ্কট সমস্যার মাঝে অটুট সামাজিক বন্ধন ও পারিবারিক বন্ধনের সুতোয় স্বস্তির আনন্দময়তায় আছি। এই বন্ধনের ফজিলতের কথা আমরা যেন ভুলে না যাই।