সবচেয়ে সুখী কারা?

ডাক্তার সুলতানা আলগিন
Published : 20 Nov 2012, 05:21 AM
Updated : 20 Nov 2012, 05:21 AM

সবচেয়ে সুখী কারা! আপনারা বিরক্ত হচ্ছেন কিনা জানি না- কিন্তু আমি সুযোগ পেলেই এই সুখ-অসুখ বিষয়টা নিয়ে লিখব। এর কারন হচ্ছে মানসিক রোগের ক্ষেত্রে সুখবোধ নিয়ে অসুখের বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ন। যতই বিতর্ক থাকুক, ডাকতারদের যতই ভাল মন্দ বলা হোক না কেন ;আমরা চাই না রোগীর সংখ্যা বাড়ুক। রোগব্যাধি হলে মানুষ কত এবং কেমন কষ্ট পায় তা ডাক্তারের চেয়ে ভাল কে জানবেন। ব্যক্তিগত জীবনে কোন পরিবারে বছরে হয়ত একজন অসুস্থ হন;একটি পরিবার তা নিয়ে ভোগান্তিতে ভোগে_কিন্তু একজন ডাক্তারের জন্য এটা প্রতিদিনের। তাকে প্রতিদিনই অনেক রোগীর ভোগান্তি ও কষ্ট দেখতে হয়। হয়তো চিকিৎসা দিয়ে সেবা দিয়ে সবাইকে ভাল করতে পারি না। সন্তুষ্ট করতে পারি না।তারপরও কথা এই অসুখ দেখে আমরা পীড়িত ব্যাথিত না হয়ে পারি না।

আমি মানসিক রোগের চিকিৎসক। আমার কাছে সুখের অসুখ খুবই বড় ব্যাপার। আমরা জানি সুখবোধ নিয়ে নানা পীড়া নানা অসুস্থতা গুলো যদি নিয়ন্ত্রন করা যেত তবে একটা বড় অংশ মানুষকেই আর মনোরোগ নিয়ে হাসপাতালে বা চেম্বারে যেতে হত না। আর এজন্য দরকার সচেতনতা। এজন্য দরকার একটা পরিবারের সকলের সুখের মৌলিক অনুভব নিয়ে মোটামুটি একমত থাকা। জীবনে টাকা আমরা কম বেশী চাইবোই। টাকার পেছনে ছুটবোই। আমি যদি এখন বলি চলুন সবাই দরবেশ হয়ে যাই। অমনি সবাই দরবেশ হতে ছুটবো না। বরং টাকার পেছনে আমরা ছুটছি দল বেধে। কেন এই টাকা! টাকা চাই সুখের জন্য। টাকা চাই আরামের জন্য। টাকা চাই আয়েশের জন্য। আরাম আয়েশ স্বস্তি সুখ যদি টাকা ছাড়াই পাওয়া যেত তবে হয়ত আমরা বেশীর ভাগ মানুষ এই ভাবে টাকা টাকা করে মরতাম না।

সারা দুনিয়াতেই এখন চিন্তা চেতনা বদলাচ্ছে। সুখের সংজ্ঞা বদলাচ্ছে। বিশেষ করে উন্নত দুনিয়ায়। ওরা এখন নতুন করে ভাবতে চাইছে। চাইছে বলছি কেন -ওরা নতুন দর্শনের জন্য পাগল হয়ে গেছে। পুজিবাদী ভোগবিলাস আরাম আয়েশ করে ওরা এখন ক্লান্ত। তাই চায় নতুন থিংকিং।পত্রিকায় একটা লেখা দেখলাম। এটা নিয়ে আলোচনার লোভ সামলাতে পারছি না।

সবচেয়ে সুখী কারা? এমন প্রশ্নের উত্তর ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু যুক্তরাজ্যে মালী ও পুষ্পজীবীরাই সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে দাবি করেছেন গবেষকেরা। সিটি অ্যান্ড গিল্ডসের গবেষণা সূচকে সুখী মানুষের তালিকায় এই পেশার মানুষ সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। এ পেশার অনেকে স্বাধীনভাবে কাজ করাকে তৃপ্তির প্রধান বিষয় বলে দাবি করেছেন। পাশাপাশি কম সুখী হিসেবে তালিকায় স্থান পেয়েছেন ব্যাংকিং পেশায় যুক্ত মানুষেরা।

গবেষকেরা অনলাইনের মাধ্যমে দুই হাজার ২০০ জন কর্মজীবীর কর্মক্ষেত্রে তাঁদের স্বাধীনতা ও পরাধীনতার চিত্র তুলে আনেন। সিটি অ্যান্ড গিল্ডসের গবেষণায় প্রতি ১০ জনে নয়জন মালী ও পুষ্পজীবী অর্থাৎ প্রায় ৮৭ শতাংশই তাঁদের সুখী মানুষ বলে দাবি করেছেন। এ পেশার ৮০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের কাজ সামলাতে সক্ষম। কাজের সময়সূচি ও দৈনন্দিন কাজে তাঁরা পূর্ণ স্বাধীনতা পান। প্রতিদিন কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এ পরিতৃপ্তি তাঁরা পেয়েছেন প্রায় ৮২ শতাংশ। এই পেশাগত জীবনে পরিতৃপ্তির সূচকে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। তাঁদের মধ্যে মাত্র ৪৪ শতাংশ নিজেদের সুখী বলে দাবি করেছেন। অসুখী মানুষের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) ও উপাত্ত বিশ্লেষণে যুক্ত পেশাজীবীরা।
উপরের যে লেখাটি পড়লেন সেটি আমার কোন বানিয়ে বলা কথা নয়। এসব তথ্য দিয়েছে বিবিসি। লন্ডনের বিবিসি।

ইউরোপ আমেরিকা এখন সবচেয়ে সুখী হিসেবে গবেষনা করে তকমা দিয়েছে মালী ও পুষ্পজীবীদের। অনেকে বলে থাকেন ওরা সব কাজই করে ষড়যন্ত্র করে। ওরা ভাল কাজটাও করে প্লান করে। সুনির্দিষ্ট কল্যানী প্লান করে। এই যে ওরা মালী ও পুষ্পজীবীদের সবচেয়ে সুখী দেখাচ্ছে তার মধ্যেও রয়েছে সেই কল্যান প্লান। ওরা নতুন প্রজন্মের দেখার চোখ অনুভবের চোখটা বদতে দিতে চাচ্ছে। ওরা চায় আস্তে আস্তে ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলাক। এখনকার বিশ্ব ভাবনা সবাইকে নিয়ে। পরিবারের অন্য সদস্যরা যদি সুখে না থাকে তবে আপনি আমি একা একা সুখে থাকতে পারবো না। আমেরিকা ইউরোপে সবকাজেই ভাল আয় আছে । বেতন সবার ভাল। তারপরও যে লোকটা দেশের মস্ত কর্নধার; যিনি কেটি কোটি বিলিয়ন পাউন্ড ডলারের মালিক তিনি আর মালী/পুষ্পজীবী সমান কাতারের নন। কি সামাজিক সম্মানে কি ভোগ বিলাসে। বিলিয়নারের ভোগবিলাস আর মালীর ভোগ বিলাস এক হওয়ার কথা নয়। বাস্তবে নযও। তবু মালী সবচেয়ে সুখী কেন! বিলিয়নার তে কষ্ট করে কোটি কোটি ডলার কামাল সে নয় কেন!

তার কারণ আমরা সবাই জানি। কোটি পতির কত টেনশন। টাকার টেনশন। টাকা রক্ষার টেনশন।

আরও আরও টাকা আয়ের টেনশন। মালীর সে টেনশন নেই। ফুলের সঙ্গে ফলের সঙ্গে সে আছে বড় চমৎকার।
এ যেন টলস্টয়ের সুখের গল্প। এই পুজিবাদী ভোগের দুনিয়ায় প্রাচীন সুখের গল্প। আশ্চর্য হচ্ছেন ! অবাক হওয়ার কিছু নেই। আসলে দিন বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে লন্ডন আমেরিকার মানুষও। ভোগ আরাম বিত্ত বিলাস ব্যাসনের সবচেয়ে বড় বাধা টেনশন। নানা রোগের আখড়া এই টেনশন। টেনশন মানেই মৃত্যুর আগাম ভয়ংকর হাতছানি। তাই এখন সুখ খুজতে হবে সেখানে ; যেখানে টেনশন কম। মালীর কাজে মান সম্মান নেই। সবাই সালাম দেয় না। পসারও নেই। তারপরও সে কাজ সুখের । কেননা এই কাজ অসুখের মৃত্যুর হাতছানি দেয় না। বাংলাদেশেও যদি এমন জরিপ হয় আমরা দেখব অনেক সুখী হল সেই কলাচাষী। সেই ফুল চাষী। সেও হয়তো ছোটখাট ব্যবসায়ী। তারও টেনশন আছে। তবে তা ভুমি দস্যু ব্যাবসায়ীর চেয়ে লক্ষ গুন কম। অফিসের যে সবচেয়ে বড় কর্তা ;তারচেয়ে মানসিক সুখে আছে ছোটকোন কর্মী। কলাচাষী কেন সুখী।কেননা সে তার কাজের দাম পাচ্ছে। কোটি টাকা সে কামাচ্ছে না।কিন্তু ধানচাষীর মত পথেও বসে পড়ে নি। আর কোটি পতি হাজারো টেনশনের ছিটে ফোটাও তার নেই। সে তার লোভ লালসা যদি সম্বরন করতে পারে তবে সে খুবই সুখী। তবে জীবনকে চালিয়ে নেয়ার ন্যুনতম আয় উপায়ের ব্যাপারটিকে আবার এড়িয়ে গেলে চলবে না। ওটা দরকার। কিন্তু কতটা দরকার। সেই দরকার যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়। সারা জীবন চুরি চামারি করে চাদাবাজি ঘুষবাজি করে জীবনের একটা পর্বে সেই টাকা বাচার একান্ত লিপ্সায় সিংগাপুর থাইল্যান্ড লন্ডন আমেরিকা যদি খরচ করে সর্বসান্ত হতে হয়-সেই অঢেল কামাই করে কি লাভ। আগে সুস্থ জীবনের আশ্বাস, তারপর আর্নিং প্লান হওয়া উচিত।

প্রশ্ন হল এই কথাগুলো কেন বলছি । বলছি একারনে যে টাকার পেছনে অবিরাম ছুটে আর লাভ নেই। সন্তানকে ছুটিয়ে লাভ নেই। সন্তানকে যখন কোন পথ দেখাবেন তখন সেই মহাজনী পথের নানা হিসাবপাবি ভাল করে দেখে নেবেন। সেকাজে কেমন আয়;কত টাকা কত বিত্ত সেটা দেখার পাশাপাশি কি পরিমান টেনশন তাও জেনে বুঝে নেবেন। তারপর সন্তানকে পথ বাতলে দেবেন। দেখেন ইউরোপ আমেরিকা ঠিকই তাদের তালে তালে সুখের নতুন সংজ্ঞা নতুন প্রজন্মকে শিখিয়ে নিচ্ছে। ওরা অনেক দুরদর্শী। ওরা যা আজকে ভাবছে- সেই অনুযায়ী নানা গবেষনা জরীপ করে শিশুদের কিশোরদের তথা জনগনের মানস গঠন করছে সেটা আমরা ৫০-১০০ বছর পরে শিখব।

সত্যিই তো বিত্ত বেসাত আয়ের যে লড়াই মানুষকে দেয় নানা অসুখ টেনশন মৃত্যুর হাতছানি-তারচেয়ে মালীর কাজ -জীবনকে সহজে চালিয়ে নেয়ার কাজ তো অনেক সুখের।