ডা.সাজিয়া হত্যা: দ্রুত আইনে দৃষ্টান্ত-বিচার দরকার যে কারণে

ডাক্তার সুলতানা আলগিন
Published : 4 Dec 2012, 08:08 AM
Updated : 4 Dec 2012, 08:08 AM

কথাটা সোজাসুজিই বলি-ব্র্যাকের চিকিৎসক ডা. সাজিয়া হত্যার দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে দ্রুত বিচার দরকার। হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক বিচার দরকার। এমন শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার যাতে আগামীতে এধরনের অপরাধ করার সাহস কেউ না পায়। এমন বিচার দরকার যা মিডিয়ায় ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হয়। আমরা যারা ব্লগে লেখালেখি করি তাদের উচিত এব্যাপারে সোচ্চার হওয়া। শুধু আমি লিখলেই হবে না ব্লগে আরও যারা লিখে ইতোমধ্যেই জনপ্রিয় হয়েছেন তাদের সবাইকে একান্ত অনুরোধ করছি এই বিষয়ে লিখুন। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলুন। প্রিয় আইরিন সুলতানা , জিনিয়া অনুগ্রহ করে আপনারা লিখুন। রীতা মিঠু , প্রবীর বিধান আপনাদের প্রতিও অনুরোধ রইল। আপনারা লিখুন। আমি আশা করবো আপনারা অন্তত একথা বলবেন না ডা. সাজিয়া একজন চিকিৎসক বলে আমি আরেক চিকিৎসক হিসেবে বিশেষ স্পর্শকাতরতা দেখাচ্ছি। না, ডা. সাজিয়া একজন সাধারণ মানুষই ছিলেন।

হ্যা তিনি বি এম এ কিংবা আওয়ামীলীগ-বিএনপি-বাম রাজনৈতিক দলের সমর্থক চিকিৎসক সংগঠনের বড় নেতা ছিলেন না। ডা. সাজিয়া মন্ত্রী মিনিস্টার ছিলেন না। দেশের বড় কোন পরিবারের সন্তানও ছিলেন না।তিনি দেশের নামকরা কোন শীর্ষ স্থানীয় চিকিৎসকও ছিলেন না। নামকরা কোন সাংবাদিকের কন্যা ছিলেন না। প্রশ্ন উঠতে পারে ডা. সাজিয়া এমন কোন মহান ব্যাক্তি যে আমি তার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচার চাইছি। কেন চাইছি সেটাই এবার বলছি। এটা আমরা অনেকেই জানি যে কোন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রান হল বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান যেমন হাসপাতাল ক্লিনিক এ যারা ডিউটি ডাক্তার ও নার্সিং ডিউটি করেন। এরাই হাজার হাজার কোটি কোটি রোগীর সেবা করেন। তাদের কেয়ারিং করেন। চিকিৎসা দেন। নানাভাবে সেবা শুশ্রূষা করেন। এই ডিউটি ডাক্তার ছাড়া কোন অবস্থাতেই দেশের চিকিৎসা ব্যাবস্থাকে সচল রাখা সম্ভব না। এরা না থাকলে হাসপাতাল ক্লিনিক নার্সিং হোম সব কিছু মুহুর্তের মধ্যে অচল হয়ে পড়বে। এই জন্য দেখবেন কোন অপ্রীতিকর ঘটনায় ডিউটি ডাক্তার , ইনটার্ন ডাক্তাররা বা নার্সিং স্টাফরা সেবা সাময়িক বন্ধ করে দিলে চিকিৎসা ব্যাবস্থার কি হাল হয়। হাসপাতালগুলো বন্ধের উপক্রম হয়। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা বড় ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা বা হাসপাতালের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হয় না। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে কোন অবস্থাতেই চিকিৎসা সেবার মত জরুরি সেবা সেকটরে ধর্মঘট বা অচলাবস্থার পক্ষে নই। আমি একথাগুলো বললাম দেশের চিকিৎসা সেকটরে ডিউটি ডাক্তারদের গুরুত্ব বোঝাবার জন্য।

আর এই ডিউটি ডাক্তার ও নার্সিং স্টাফদের আরও গুরুত্ব একারনে যে তারা শিফট অনুযায়ী নাইট ডিউটি করেন। সংসার ছেলেমেয়ে বাবা মা ফেলে তারা মানুষের সেবায় আর্তজনের সেবায় রোগীর সেবায় নির্দ্বিধায় নাইট ডিউটি করেন। হাসপাতালে ক্লিনিক নার্সিং হোমে নারী পুরুষ সকল চিকিৎসককে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের মহান আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে এই মহান সেবাব্রত পালন করতে হয়। রাতের বেলা জরুরি দরকারে সাধারনত সিনিয়র ডাক্তার ও বড় ডাক্তারকে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় এই ডিউটি ডাক্তারদের। তারাই সিনিয়র চিকিৎসকদের নির্দেশনা অনুযায়ী রোগীর পাশে সারারাত জরুরি দরকারে সদা হাজির থাকেন। নারী ডাক্তাররাও নিয়মিত এই ডিউটি পালন করে থাকেন। সেবায় তারা ঘাটতি করেন না। দেশে চেম্বার প্রাকটিসিং বড় ডাক্তারদের নিয়ে রোগীদের অভিযোগ থাকলেও ডিউটি ডাক্তারদের নিয়ে অভিযোগ খুবই কম। এর কারন হল এরাই চিকিৎসার প্রান। এদের নিবিড় নিয়মিত সেবায় রোগীরা জীবনের ঠিকানা ফিরে পান।

ডা. সাজিয়া কোন নামজাদা ডাক্তার ছিলেন না। ছিলেন এমনই একজন নাইট ডিউটি পালন কারী জরুরি দরকারের চিকিৎসক। রোগীর জরুরি দরকারের জন্য তিনি কাছেই বাসা ফেলে হাসপাতালে অবস্থান করছিলেন। এবং রোগী সেবার মহান ব্রত পালন করতে গিয়েই তিনি হত্যা কারীর শিকার হলেন। প্রান হারালেন।

এখন যদি এই হত্যার জরুরি দৃষ্টান্তমূলক দ্রুত বিচার না হয় তাহলে তা হাজারহাজার নারী চিকিৎসক এর পারিবারিক জীবনে সৃষ্টি করবে নানা জটিলতা। যা কোনদিন পত্রিকায় আসবে না। আদালতে বিচারের কাঠগড়ায় উঠবে না। কেউই তা জানবে না। হাজার হাজার নারী চিকিৎসকের পরিবারে বিচারের বানী গুমরে গুমরে কাদবে। সেই কান্নার পরিনাম ভাল হবে না। সেই সমস্যাটা সাদা চোখে দেখাও যাবে না। ঘটনাগুলো ঘটবে হাজারো পরিবারে সবার চোখর অন্তরালে।

ডা. সাজিয়া হত্যার যদি দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হয় তাহলে আরেক অবিবাহিত জীবিত ডা. সাজিয়া বা ডা. রাজিয়ার দায়িত্ববান পিতা তার কন্যাকে নাইট ডিউটিতে পাঠাতে সাহস পাবেন না। বলবেন মা, রাতের ডিউটিতে না গেলে হয় না। এই ঘটনার শক্ত বিচার না হলে আরেক বিবাহিত ডা. রাজিয়ার স্বামী তার স্ত্রীকে নাইট ডিউটিতে যেতে কঠিন ভাবে বাধা দেবেন। বলবেন- নাইট ডিউটি করা লাগবে না। চাকুরি ছেড়ে দাও। নারী চিকিৎসকদের পরিবারে এই ধরনের বাধা আসবে যা কোনদিন পত্রিকায় আসবে না। ব্র্যাক হাসপাতালের কেয়ার টেকার ডা. সাজিয়াকে ধর্ষণ চেষ্টা ও হত্যা করে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এই জঠিল সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এতে দেখা দেবে আস্থা হীনতা। দেখা দিয়েছে অবিশ্বাস। এটা হচ্ছে বাংলাদেশের মত দেশের সামাজিক বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় আঘাত। ওই কেয়ার টেকার সাজিয়াকে হত্যা করে নাইট ডিউটির ডাক্তারদের নিরাপত্তাকে প্রচন্ড হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সে নিষ্চয়ই আর দশটা ধর্ষন চেষ্টা ও হত্যা মামলার আসামীর মত অপরাধী। কিন্তু হাসপাতাল ক্লিনিক ও নার্সিং হোমের রাতের ডিউটির সুস্থ পরিবেশকে সে নষ্ট করে পুরো স্বাস্থ্য ব্যাবস্থায় মারাত্মক অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে।

একজন মানসিক রোগের চিকিৎসক হিসেবে, একজন নারী হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে সর্বোপরি এই উপমহাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার ধারণা করতে অসুবিধা হচ্ছে না এই ঘটনা চিকিৎসকদের পারিবারিক বাস্তবতায় কি সমস্যা তৈরি করবে। আর তাই আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সবার সচেতনতা দাবী করছি। মনে রাখতে হবে সেই হত্যাকান্ডের রাতে খুনি কেয়ার টেকার যখন গিয়ে ডা. সাজিয়ার রেস্টরুমে করাঘাত করল বা নক করল তখন সাজিয়া ভুলৈও ভাবেন নি তিনি খুন হতে যাচ্ছেন! এটা বুঝতে কষ্ট হয় না খুনি কোন রোগীর জরুরি চিকিৎসার কথা বলেই সাজিয়াকে দরজা খুলতে বলেছিল। অর্থাৎ সাজিয়া কোন রোগী জরুরি ভিত্তিতে এটেন্ড করতে গিয়েই খুনের শিকার হন।

সাজিয়া ডাক্তার ছিলেন কেবল এই কারণে আমি এই হত্যার সুবিচার চাইছি না। আমি সুবিচার চাইছি দেশের চিকিৎসা সেক্টরের বৃহত্তর স্বার্থে। আর এজন্য সকল শুভানুধ্যায়ী ব্লগ লেখক কুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আপনারাও অনুগ্রহ করে বৃহত্তর প্রয়োজনে লিখুন। আসুন আমরা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি। দেশের চিকিৎসা সেবা সেক্টরকে রক্ষা করতে হবে। আমি ঘরে ঘরের যে সমস্যার কথা বললাম তা সংবাদপত্র বুঝবে না। নেতারা বুঝবেন না। রাজনৈতিক দল গুলো বুঝবে না। এই সমস্যাকে তুলে ধরার জন্যই ব্লগ আন্দোলন। ব্লগ আন্দোলন হচ্ছে তা নিয়ে-যা সমাজে সত্য-খালি চোখে দেখা গেলেও সমাজপতিরা তা দেখেন না। সেসব নিয়ে লেখাই আমাদের দায়িত্ব বলে আমি আমার সামান্য জ্ঞানে মনে করি।

এবার এখানে পাঠকদের জন্য ডা. সাজিয়া হত্যাকান্ড সংক্রান্ত প্রথম আলোয় ৩ ডিসেম্বর ছাপা রিপের্টটি তুলে ধরলাম।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন ফয়সাল

নিজস্ব প্রতিবেদক |

রাজধানীর দক্ষিণখানে ব্র্যাক ক্লিনিকের খণ্ডকালীন চিকিৎসক সাজিয়া আফরিন হত্যায় গ্রেপ্তার একই ক্লিনিকের কর্মচারী মো. ফয়সাল গতকাল রোববার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি শেষে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণখান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) গোলাম সরোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, সকালে ফয়সালকে ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তিনি সাজিয়াকে ধর্ষণের চেষ্টার কথা স্বীকার করে বলেন, বাধা দেওয়ায় তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়।

গত বৃহস্পতিবার রাতে দক্ষিণখানের আমতলায় ব্র্যাক ক্লিনিকে খুন হন সাজিয়া। পরদিন শুক্রবার সকালে তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার পর তাঁর বাবা মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ঘটনার পর থেকেই ফয়সাল পলাতক ছিলেন। শুক্রবার রাত আড়াইটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শামুগ্রামে অভিযান চালিয়ে নানার বাড়ি থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।@@