শুধু সাংবাদিকতাই তো করেছিলাম!

তৌফিক ইমরোজ খালিদী
Published : 6 Jan 2012, 09:22 AM
Updated : 24 Jan 2020, 02:00 PM

বিষয় যতই গুরুতর হোক, তা নিয়ে অন্তত এই কলামে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করা থেকে আমি বিরত থাকার চেষ্টা করেছি বেশির ভাগ সময়। আমাদের কাজ খবর নিয়ে, খবরের বিশ্লেষণ নিয়ে। সে খবর কে কীভাবে নেবে, তা পাঠক বা দর্শকের ওপর ছেড়ে দেওয়াই আমি যুক্তিযুক্ত মনে করেছি। ব্যতিক্রম যে ঘটেনি, তা নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।

আজ এখানে লিখছি এ কারণে যে, যা কিছু হচ্ছে, ঘটেছে, তার একটি ব্যাখ্যা আমাদের লক্ষ-কোটি পাঠককে দেওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়েছে।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ফার্মের সঙ্গে বিনিয়োগ চুক্তির খবর আমরা প্রকাশ করার পর দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে গতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, তা রীতিমত বিস্ময়কর। সেটা প্রশংসনীয়ই বলা যেত, যদি অন্য জরুরি ক্ষেত্রেও তাদের এমন করিৎকর্মা ভূমিকায় দেখা যেত।

অক্টোবরের মাঝামাঝি এক বিকেলে ওই বিনিয়োগের খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত হয়। এরপর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কাছ থেকে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত আসে- ওই 'বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিরত' থাকতে হবে। সেদিনই বিনিয়োগকারী কোম্পানির নামে চিঠি পাঠানো হয়, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে জানিয়ে দেওয়া হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপের খবর।

বাংলাদেশের সমস্যা জর্জরিত পুঁজিবাজারের কোনো অনিয়ম অথবা বিনিয়োগকারীদের হাজারো অভিযোগের সুরাহা করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এমন তৎপর যদি কখনও দেখা যেত!

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত নয়, নিয়ম অনুযায়ী যৌথমূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের দপ্তর থেকে অনুমোদন নিয়েই আমরা ব্যবসা করছি। সেখানেও ওই চুক্তি স্থগিতের বার্তা পাঠাতে দেরি করেনি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন- বিএসইসি। সরকারি ওই দপ্তরকে বলে দেওয়া হয়, ওই বিনিয়োগের ভিত্তিতে শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়টি যেন তারা নিবন্ধন না করে। অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে খবর পৌঁছে দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের কাছে। বিনিয়োগকারী কোম্পানি এলআর গ্লোবাল আর বিনিয়োগ গ্রহীতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের দপ্তরেও চিঠি পৌঁছে যায়।

এই এত কিছু করা হল শুধু ক্ষুদ্র অংকের একটি বিনিয়োগ আটকে দেওয়ার জন্য! হ্যাঁ, বিনিয়োগের ওই অংককে আমি ক্ষুদ্রই বলব। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংবাদ প্রকাশকের এগিয়ে চলার পথকে মসৃণ করতে; এর বিকাশ, উন্নয়ন আর সম্প্রসারণ নিশ্চিত করতে; সর্বোপরি কয়েক বছরে যে পরিমাণ দায় জমেছিল (এর কারণ ছিল বিজ্ঞাপনদাতাদের একটি অংশ এবং আরও অনেকের বৈরী আচরণ, তাদের বিষয়ে এ পর্যায়ে আমি বিশদ বলতে চাই না) তা পরিশোধ করতে প্রয়োজনীয় অর্থের তুলনায় ওই অংক সত্যিই ক্ষুদ্র। তারপরও এই বিনিয়োগ আমাদের জন্য সত্যিই জরুরি ছিল। আমাদের অনেক সহকর্মী দীর্ঘদিন সময়মত বেতন পাননি, অনেকেরই বকেয়া ছিল- সেই বকেয়া পরিশোধ করার তাড়া ছিল আমাদের। সে কারণে কোম্পানির ৩৭ হাজার ১০০ টাকা মূল্যমানের প্রতিটি শেয়ার মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকায় আমাদের ছেড়ে দিতে হয়েছে।

বিএসইসির সেই ত্বরিৎ পদক্ষেপের দুই সপ্তাহের মাথায় দৃশ্যপটে সক্রিয় হল রাষ্ট্রের আরেক সংস্থা দুদক- দুর্নীতি দমন কমিশন

এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটা আসতে পারে, দুদকের তদন্তাধীন একটি বিষয়ে আমার এখানে খোলাখুলি কথা বলা উচিত কি না। আমি সব সময় মনে করেছি, এবং বিশ্বাস করেছি, এরকম পরিস্থিতিতে আমার তা করা উচিত না। আর এ কারণেই গত ২৬ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা (আমার দৃষ্টিতে ওই সময়টা ছিল অনাবশ্যক রকমের দীর্ঘ) ধরে আমার কী কথা হল তার বিস্তারিত যখন সাংবাদিকরা জানতে চাইলেন, আমি বলতে রাজি হইনি।

তার ঠিক ১৫ দিন আগে, ১১ নভেম্বর, আমাকে আরও এক দফা সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমি কমিশনের কাছে লিখিতভাবে সময়ের আবেদন করেছিলাম। তারা মৌখিকভাবে আশ্বস্তও করেছিল। তারপরও আমি কেন সেদিন কমিশনে হাজির হলাম- যৌক্তিকভাবেই সেটা ছিল সাংবাদিকদের প্রথম এবং প্রধান প্রশ্ন।

আমার উত্তর খুবই সোজা। আমি লিখিত আবেদন করলেও কমিশন সময় বাড়ানোর বিষয়টি লিখিতভাবে জানায়নি। চিঠি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করার কোনো কাগজও দেয়নি। আমি কীভাবে নিশ্চিত হব যে আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা কেউ করবে না?

সত্যি কথা বলতে কি, রাষ্ট্রীয় ওই সংস্থার ওপর খুব বেশি ভরসাও আমি করতে পারি না। সেটা যে শুধু আমার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার কারণে, তা নয়। পুরনো দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত করে 'স্বাধীন' দুর্নীতি দমন কমিশন হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর যে মান তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ছিল, অনেক ক্ষেত্রেই তা তারা রাখতে পারেনি। বিগত বছরগুলোতে এ বিষয়ে আমি অনেকবারই বলেছি। এটা আস্থাহীনতার একটি কারণ। এ সংস্থার প্রতিষ্ঠাকালীন কমিশনারদের প্রকাশ্যে বিবাদে লিপ্ত হওয়ার ঘটনাগুলোও নিশ্চয় অনেকের মনে আছে।

আর ২০০৭-০৮ সময়ের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ কমিশনের কর্মকাণ্ড কতটা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল তা সবারই মনে থাকার কথা। সে সময় বহু রাজনীতিবিদকে দুদকের মামলায় ফাঁসানোর ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছে, যাদের মধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও আছেন। উঁচু পর্যায়ের অনেককে সে সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের অপরাধ দুদক প্রমাণ করতে পারেনি। কেন সেসব ঘটেছিল সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় আমি যাব না, অন্তত এখন নয়।

আস্থার সঙ্কট আছে বলেই আমি সেদিন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দুদকের লিখিত উত্তরের জন্য অপেক্ষা করি এবং তা না পেয়ে সময়মত কমিশনের দপ্তরে উপস্থিত হই। তখন আমাকে বলা হয়, আমার সেদিন না গেলেও চলত। দুদক থেকে বেরিয়ে আসার সময় অপেক্ষমাণ সাংবাদিক সহকর্মীদের এড়ানোর কোনো উপায় ছিল না।

সেদিন তাদের সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়েছি, নিজের এবং সেই সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অবস্থান স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছি। আমার সেদিনের বক্তব্য সব সংবাদমাধ্যমেই এসেছে, এমনকি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেও।

দুদকের ওই পদক্ষেপ সম্পর্কে যারা জানেন এবং বিনিয়োগের বিষয়গুলো সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন, সেদিন আমার দেওয়া ব্যাখ্যার পর তাদের কাছে অন্তত এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা যে দুদকের ওই 'অনুসন্ধান' আর এগিয়ে নেওয়া ছিল অর্থহীন। আমার একজন সাবেক সহকর্মী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এক পোস্টে পুরো বিষয়টিকে বর্ণনা করেছেন 'হয়রানি' হিসেবে।

এ পর্যায়ে এসে এটা সম্ভবত বলে দেওয়া যায়, শুধু দুদক নয়, আরও একাধিক রাষ্ট্রীয় সংস্থা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করেছে প্রকাশ্যে এবং অন্তরালে থেকে। তার কারণ হল, দুদকের পদক্ষেপ দৃশ্যমান হওয়ার আগে যে অভিযোগ বা গুজবগুলো সোশাল মিডিয়া বা অন্যান্য মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে, তা আসলেই গুরুতর।

একবার বলা হয়েছে, টাকা এসেছে লন্ডন থেকে; আবার বলা হয়েছে, আসলে টাকা গেছে লন্ডনে। ওই অর্থ লেনদেনের উদ্দেশ্য নাকি ছিল রাষ্ট্রবিরোধী (পড়ুন সরকারবিরোধী) কর্মকাণ্ডে মদদ দেওয়া, অন্তত অভিযোগগুলো সেভাবেই ছড়ানো হয়েছে। কেউ কেউ আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং পছন্দ-অপছন্দ নিয়েও ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছেন।

সবচেয়ে ক্রূর অংশটি হল, অভিযোগ রটনাকারী পক্ষ খুব ভালোভাবে জানত যে ওই অর্থের (যে টাকা এলআর গ্লোবাল বিনিয়োগ করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে) লেনদেন হয়েছে বাংলাদেশে নিবন্ধিত দুটো কোম্পানির মধ্যে, বাংলাদেশের ভেতরে, এবং বাংলাদেশের সব আইন-কানুন যথাযথভাবে অনুসরণ করে। তারপরও সেই শক্তিশালী আর হিংসাপরায়ণ পক্ষটিকে অন্তরালে থেকে তাদের সেই কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। অপপ্রচার চালাতে যারা তাদের সহযোগিতা করেছে, তারাও সব জেনেশুনেই করেছে। আর সর্বোপরি, শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের অবহিত করতে যারা এ বিষয়ে 'প্রতিবেদন' তৈরি করেছেন, তারাও পুরোপুরি অবগত ছিলেন। তারা সবকিছু জানতেন না, এমন বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।

এর মধ্যে গোলপোস্ট সরানো হয়েছে বার বার। লন্ডনে অবস্থানরত বাংলাদেশি এক রাজনীতিকের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে উল্টোটাও। আবার অযৌক্তিকভাবে এও বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারীর সঙ্গে যোগসাজশে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দুই পক্ষই লাভবান হয়েছে। আবার বলা হল, বিনিয়োগের অর্থ পাচার করা না হলেও পাচারের সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে। শেষ পর্যন্ত মুদ্রাপাচারের ওই সম্ভাবনার কথা বলেই আমার ব্যক্তিগত এবং কোম্পানির ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার একটি আদেশ আদালত থেকে বের করা হয়েছে, যা কিনা আমাদের জানতে হয়েছে কয়েকটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন পড়ে।

ওই বিনিয়োগ থেকে যে অর্থ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে এসেছে, তার ২৫ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়েছে কোম্পানির পুঞ্জীভূত দায়ের একটি বড় অংশ মেটাতে। আর আমার শেয়ার বিক্রির টাকা কোথায় আছে তা এফডিআর অ্যাকাউন্টগুলো দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায় (ওই টাকার ওপর প্রযোজ্য কর আমাকে ২০১৯-২০ করবর্ষে পরিশোধ করতে হবে)। পত্রিকার খবর বলছে, ওই টাকা আমি অন্য দেশে পাচার করে দিতে পারি- এই যুক্তি দেখিয়ে দুদকের আইনজীবী আমার অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করার আদেশ চেয়েছিলেন আদালতে। আর সেই আবেদনেই আদালত নাকি ১ ডিসেম্বর আদেশ দিয়েছে, যদিও আজ পর্যন্ত সেই আদেশ সংক্রান্ত কোনো চিঠি আমার হাতে পৌঁছেনি।

অবশ্য যে তারিখে আদালতের আদেশ দেওয়ার কথা পত্রিকায় বলা হচ্ছে, তার আগেই, নভেম্বরের ২৯ তারিখ দুটো ব্যাংকের কাছ থেকে আমার কাছে কয়েকটি এসএমএস আসে। এসএমএসগুলোর একটিতে আমার ব্যক্তিগত (স্যালারি) অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলার সুযোগ বন্ধ রাখার কথা বলা হয়। আর দুই ব্যাংকে আমার এফডিআর অ্যাকাউন্ট 'ব্লকড' হওয়ার কথা বলা হয় অন্য এসএমএসগুলোতে। অন্যান্য ব্যাংকের অ্যাকাউন্টগুলোর কী অবস্থা, তা আর দেখার আগ্রহ বোধ করিনি তখন।

ওই এসএমএস যে আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল, সেটা স্বীকার করতে আমি বিব্রত নই। কারণ আমার কাছে ওই এসএমসের অর্থ হল, আবার সেই অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হবে, যার অবসান ঘটেছে বলে আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, কিছু শেয়ার বিক্রি করে যে অর্থ পেয়েছি, তাতে আমার দীর্ঘমেয়াদি অর্থচিন্তা কেটে যাবে, প্রয়োজনে কোম্পানিকেও সহযোগিতা করতে পারব। আমার সহকর্মীরা যখন ওই এসএমএসের বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলেন, একটি ব্যাংক থেকে তাদের বলা হল, উপর থেকে মৌখিক আদেশ পেয়েই তারা অ্যাকাউন্ট আটকে দিয়েছেন।

আমাদের এফডিআর অ্যাকাউন্ট (বিশেষ করে কোম্পানির) অবরুদ্ধ রাখার মানে হল, আয় বাড়িয়ে কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি শক্ত করার জন্য যে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আমরা নিয়েছিলাম, সেগুলো আপাতত আটকে থাকবে। বিনিয়োগের সুফল থেকে বঞ্চিত হবে দুই পক্ষই।

যারা আমাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে, তারা যে কোনোভাবে কিছু লোকের বিরাগভাজন হয়েছে, সেটা শুরু থেকেই স্পষ্ট ছিল। বোঝা যাচ্ছিল তখন থেকেই, যখন আমাদের বিনিয়োগ চুক্তি আটকানোর জন্য ত্বরিৎ গতিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হল। কিন্তু তহবিল ব্যবস্থাপকদের অনেক বাজে বিনিয়োগের ঘটনায় যে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার 'নিয়ম' যে কেবল বেছে বেছে প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেটা যখন সংবাদমাধ্যম বলতে শুরু করল, আমরাও যখন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলাম, তখন আমি এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমই তাদের প্রধান নিশানায় পরিণত হলাম।

এটা স্পষ্ট যে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে আমাকে নীরবে ওই চিঠি পাঠানোর আসল উদ্দেশ্য ছিল সেই শক্তিশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে 'সমঝোতায়' আসতে বাধ্য করা, যারা এসব কিছু করিয়েছে। কিন্তু আমাকে 'সাহায্য করার' সেই 'প্রস্তাব' আমলে না নিয়ে আমি আমার সহকর্মীদের বললাম তারা যেন এই 'তদন্ত' নিয়েও নিয়মিতভাবে খবর প্রকাশ করে, যেমনটা তারা অন্যসব ক্ষেত্রে করে থাকে। সেজন্য কেউ একজন আমার সমালোচনা করলেন, বললেন, আমার ওই সিদ্ধান্ত নাকি বাস্তবসম্মত ছিল না; আমার উচিত ছিল তাদের সাথে সমঝোতা করা। আমার সহকর্মীরা খবর প্রকাশ করে গেলেন ঠিকই, কিন্তু আমি যখন বললাম সব সমস্যা মেটার আগ পর্যন্ত আমি প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে বিরত থাকতে চাই, তারা তাতে রাজি হলেন না।

আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর চেষ্টায় তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল; একের পর এক মিথ্যা সাজিয়ে সে কি কদর্য চেষ্টা! কিন্তু তাদের তাড়াহুড়ো ছিল বোঝা যায়, কারণ তাদের গল্পে অনেক অসঙ্গতি, অনেক অসম্ভব কল্পনা, অনেক ফুটো থেকে গিয়েছিল। তাদের দুঃসাহস এবং সেই সঙ্গে নির্বুদ্ধিতা দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই।

ঠিক কী ভুল ছিল আমাদের?

বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যমের জন্য বিনিয়োগ যোগাড় করা? এমন বিনিয়োগ- যা কিনা বাংলাদেশে প্রথম? যে সংবাদমাধ্যম সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা এবং সহিংসতা উসকে দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং সে ধরনের মতামত ছাপায়।

কেবল কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করাই আমাদের ভুল ছিল? সেরকম হলে আমাকে প্রেস কাউন্সিলে নেওয়া যেত, কারো মানহানি হলে আদালতেও যেতে পারতেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বিনিয়োগ করে ওই কোম্পানি যে ঝুঁকিটা নিল, তাতে কোনো সমস্যা?

সেজন্য তো বিএসইসি রয়েছে এবং সেখানেই অবশ্য তারা গেছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এক্ষেত্রে চমৎকার কাজ দেখিয়েছে, স্বীকার করতেই হয়। কতটা অস্বাভাবিক দ্রুততায় তারা সক্রিয় হয়েছে, সে কথা ইতোমধ্যে বলেছি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের চার্টার সংশোধনের সময় খসড়া তৈরির সঙ্গে যুক্ত একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা আমাদের বলেছেন, এ বিষয়টা দুদকের এখতিয়ারেই পড়ে না। ওই সাবেক কর্মকর্তার পাশাপাশি আরও অনেকের মতে, বাংলাদেশ নিউজ টোয়েন্টিফোর আওয়ারস লিমিটেডের (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মালিক কোম্পানি) মত একটি 'নন-লিস্টেড' কোম্পানিতে ওই বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে কোথাও আইনভঙ্গ হয়েছিল কি না তা বিচার করার এখতিয়ার কেবল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন- বিএসইসির।

বিনিয়োগগ্রহীতা হিসেবে তাদের কারও কাছেই এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জবাবদিহি করার কথা নয়। তাছাড়া এলআর গ্লোবালের সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করার আগে আমরা পরামর্শের জন্য বিএসইসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলাম। তখন আমাদের স্পষ্ট বলা হয়েছে, কোম্পানি যদি আইপিওতে না গিয়ে থাকে, তাহলে একটি নির্দিষ্ট অংক পর্যন্ত বিনিয়োগ নেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই। (বিএসইসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে ওই যোগাযোগ এবং আলোচনা আনুষ্ঠানিক দুটি চিঠিতে নথিভুক্ত আছে।)

চুক্তি হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো যে গতিতে তৎপর হয়েছে, সেটি একটি বিষয়। আরেকটি বিষয় ছিল যোগ্যতা ও পেশাদারিত্বের নিদারুণ ঘাটতি। যে লোকগুলো পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন, তাদের সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা এখানে পাওয়া যায়।

দুদকের চিঠিতে যেভাবে তারা আমার নামটি লিখেছেন, সেভাবে আমি কখনও লিখি না। 'অবৈধ সম্পদ অর্জন… জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন… অবস্থান গোপন'- এসব অভিযোগ আমার এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিরুদ্ধে করা হচ্ছে, অথচ সেগুলোর প্রাথমিক কোনো প্রমাণ (prima facie evidence) আছে কি না- তা খোঁজার সামান্যতম চেষ্টাও তারা করেননি। বরং অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে একটি চিঠি পাঠিয়ে বলা হয়েছে, আমার বক্তব্য 'শ্রবণ ও গ্রহণ' করা 'একান্ত প্রয়োজন', কারণ তারা নাকি কোনো এক অজ্ঞাত সূত্র থেকে ওই অভিযোগ পেয়েছে। নিয়মসিদ্ধ কর্মপদ্ধতির প্রতি অবজ্ঞা এবং অযোগ্যতার মাত্রা এসব কাজের ছত্রে ছত্রে স্পষ্ট।

আবার দুদক ও অন্য রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর কাজের ধরন বিবেচনা করলে কারও মনে হতে পারে যে বুদ্ধিমান কিন্তু অতিলোভী কিছু লোকও হয়ত এর পেছনে রয়েছে, যাদের চোখ আসলে পড়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ওপর।

সব মিলিয়ে এ এক হতাশাজনক পরিস্থিতি। কিছু বিতর্কিত লোক, যাদের কাজ সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ, তাদের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতটা নগ্নভাবে ব্যবহার- এটা আমরা কখনও দেখতে চাই না, যখন আমরা সেরকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, যেটাকে মানুষ অনুকরণ-অনুসরণ করবে, যেটা হবে মানুষের ভরসার জায়গা।

বাস্তবিক অর্থেই আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

আমরা আইনের দ্বারস্থও হতে পারছি না। আইনজীবীরা আমাকে বলেছেন, সব যেখানে সাজানো, সেখানে সেই চেষ্টা করাও বৃথা।

সুতরাং আমাকে অপেক্ষা করে যেতে হচ্ছে। বিনিয়োগ যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, চোখের সামনে তা নষ্ট হতে দেখছি। সেই সঙ্গে ভুগতে হচ্ছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।

যা ঘটেছে, তা বোঝাতে কয়েকটি বিষয় আরও একবার মনে করিয়ে দিই:

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন- দুটো সংস্থাই তৎপর হয়েছে অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে।

এর একটি উদ্দেশ্য হয়ত ছিল এলআর গ্লোবালকে ধরা, তাদের কোণঠাসা করা, কারণ তারা কোনো একটি কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছিল।

আর দ্বিতীয়টি হল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম যেন ওই বিনিয়োগ থেকে কোনোভাবে লাভবান হতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। কারণ কেউ নিশ্চয় চাইছে যে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ডুবে যাক, তিলে তিলে মরে যাক, কারণ তারা এ সংবাদ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে করায়ত্ত করতে পারছে না, কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

কথা ছিল, চুক্তির পর প্রথম দু'তিন মাসের মধ্যে আমাদের জরুরি কাজগুলো গুছিয়ে নেব। কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কন্ট্রাক্টরদের সঙ্গে আলোচনা সেরে ফেলব মধ্য জানুয়ারির আগেই। সেই কাজগুলো করা হলে বিভিন্ন উৎস থেকে যে আয় বাড়বে, তাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের আর ভাবতে হবে না- এটা ছিল আমাদের প্রত্যাশা। এটাও নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম, যেন বিনিয়োগকারী একটি যৌক্তিক হারে মুনাফা পান, সেটাও আমাদের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

খুব অল্প টাকায় অত্যন্ত উঁচু মানের কাজ বের করে আনার সুনাম আমাদের অনেক দিনের। দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে স্বল্প বিনিয়োগ কিংবা বিনিয়োগ খরার কারণে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে। তারপরও বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ উৎস হিসেবে অর্জিত সুনাম ধরে রেখেছে।

আমার জানামতে এবং বিভিন্ন তদন্তের ফল সম্পর্কে যারা অবগত, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, অভিযোগগুলো তদন্তকারীদের কেবল হাসির খোরাক দিয়েছে।

তাহলে অনেক প্রথমের জন্ম দেওয়া যে সংবাদমাধ্যমকে দেশের একমাত্র স্বাধীন সংবাদ প্রকাশক হিসেবে অনেকে বিবেচনা করে থাকেন, সেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ক্ষতি করে কার স্বার্থ তারা হাসিল করতে চান?

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং যিনি এর নেতৃত্বে, তার ভাবমূর্তি নষ্ট করে কার কী লাভ?

বাংলাদেশের প্রথম ২৪/৭ সংবাদ সেবা এবং শুধু-ইন্টারনেটভিত্তিক বিশ্বের প্রথম জাতীয় সংবাদমাধ্যমটির বিকাশের পথ বন্ধ করে কেউ যদি বিকৃত আনন্দ পেতে চান, আর একটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যম হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব যদি হুমকির মুখে পড়ে, সেক্ষেত্রে আমরা কি চুপচাপ বসে থাকব?

আমাদের দুর্ভাগ্য, তথ্য-প্রমাণের ধার না ধেরে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলো ছুটেছে গুজবের পেছনে।

আর যেভাবে আমাদের অবরুদ্ধ থাকতে হচ্ছে, সেই অনুভূতি সুখকর কিছু নয়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে আমরা কেবল নৈতিক সাংবাদিকতা চর্চার চেষ্টা করি না, বাংলাদেশে যে ধারায় সাংবাদিকতার চর্চা হয়ে এসেছে, তার আধুনিকায়নের চেষ্টাও আমরা করে যাচ্ছি। দুষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বী আর শত্রুরা কখনও এর কদর করবে না, তারা বুঝবে না যে অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের হারিয়ে ফেলা সম্মান পুনরুদ্ধারের সর্বোচ্চ চেষ্টা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম করে যাচ্ছে।

২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে BDNEWS থেকে bdnews24.com হওয়ার পর বিগত বছরগুলোতে আমরা বহু ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছি, বেঁধে দিয়েছি মান। বহু ঘটনায় আমাদের রাজস্ব হারাতে হয়েছে, অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছে, নতুন শত্রু তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমাদের সাংবাদিকতার মান আমাদের মিত্রের সংখ্যাও বাড়িয়েছে। সাংবাদিকতার একজন অধ্যাপক ২০০৭ সালেই বলেছিলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকতার চেহারাই পাল্টে দিয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। আর ওই কঠিন দু'বছরে আমাদের ভূমিকার কথা সবারই জানা (রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পক্ষে সোচ্চার থেকেছি সব সময়)।

এমন এক অস্থিরমতি সমাজে আমরা বাস করি, যা নিঃস্বার্থ একদল সংবাদকর্মীর নিষ্ঠা আর ঐকান্তিকতার কথা ভুলে গেছে দ্রুত; এ বড় বেদনার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এই সংবাদকর্মীদের অনেক ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, কারণ বহু মাস তারা সময়মত বেতন পাননি। যে অবিচার আর অন্যায় তাদের সঙ্গে করা হচ্ছে, তার গভীরতা বুঝতে খুব গভীর ভাবনার প্রয়োজন পড়ে না। এটা এতটাই নগ্ন যে সাদা চোখেই দেখা যায়। এই দীর্ঘ পথযাত্রার কোনো পর্যায়ে কোনো অন্যায় করেননি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাংবাদিক-কর্মীরা। যা কিছু করা হয়েছে, তার নাম সাংবাদিকতা।

দুদক এ বিষয়ে কাজ শুরু করার পর প্রায় তিন মাস হতে চলল, কারও পক্ষ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে আর কিছু জানানো হয়নি।

ঘটনাক্রম

২০১৫: কয়েকটি একুইটি ফার্ম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে এলো। তবে ভ্যালুয়েশন নিয়ে মতের মিল না হওয়ায় আলোচনা এগোয়নি।

মার্চ ২০১৬: একটি প্রাইভেট ফার্ম একটি ইনফরমেশন মেমোরেন্ডাম (আইএম) তৈরি করল। তবে কাজের মান নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সন্তুষ্ট না হওয়ায় আলোচনার ইতি ঘটে।

৩ এপ্রিল ২০১৭: আইএম তৈরির জন্য ব্র্যাক-ইপিএলের সঙ্গে এনডিএ স্বাক্ষর হল। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কয়েক মাস কাজ করে একটি ইনফরমেশন মেমোরেন্ডাম তৈরি করল ব্র্যাক-ইপিএল। তাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ভ্যালুয়েশন হল ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৮)

২০১৮: নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক একটি মিডিয়া ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আলোচনা শুরু হল, যারা সারা বিশ্বে একশর বেশি মিডিয়া কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে। আলোচনা অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের বোর্ড বাংলাদেশে বিনিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সুইডিশ এক একুইটি ফার্মের সঙ্গে আলোচনা শুরু হল। (এটা ছিল দ্বিতীয় পার্বের আলোচনা। এবারের আলোচনা হল ব্র্যাক-ইপিএলের তৈরি করা ইনফরমেশন মেমোরেন্ডামের ভিত্তিতে)

(একটি বিষয় এখানে খেয়াল রাখা দরকার। আমাদের মত মিডিয়া কোম্পানির কাছে টাকাটাই শেষ কথা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও সম্পাদকীয় স্বাধীনতা এবং সম্মানের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ)

মে ২০১৯: যার হাতে কোম্পানির সবচেয়ে বেশি শেয়ার ছিল, তিনি অভিহিত মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে কোম্পানি ছাড়লেন, কারণ প্রাইভেট একুইটি ফার্মগুলোর সঙ্গে আলোচনায় তেমন কোনো আশার আলো তখনও দেখা যাচ্ছিল না, কোম্পানির পুঞ্জীভূত দায়ের পরিমাণও বাড়ছিল।

১০ সেপ্টেম্বর: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মালিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নিউজ টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স লিমিটেডের সাবেক অংশীদার এদিন এলআর গ্লোবালের সিইও এবং চিফ ইনভেস্টমেন্ট অফিসার রিয়াজ ইসলামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, কর্নেল ইউনিভার্সিটি ও নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করা রিয়াজ ইসলাম ওয়ালস্ট্রিটে কাজ করেছেন দারুণ সুনামের সঙ্গে, তার ওপর আস্থা রাখা যায়। বললেন, "আমি ওকে চিনি অনেক দিন ধরে, সেই স্কুলজীবন থেকে।"

১২ সেপ্টেম্বর: এলআর গ্লোবালের সঙ্গে আলোচনা শুরু হল, চলল দ্রুত গতিতে। এর মধ্যে ব্র্যাক-ইপিলের কাছ থেকে ইনফরমেশন মেমোরেন্ডামের হালনাগাদ সংস্করণ আনা হল, যাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ভ্যালুয়েশন করা হল ৩৭১ কোটি টাকা।

৩ অক্টোবর: চুক্তি হল।

৬ অক্টোবর: বাংলাদেশ নিউজ টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স লিমিটেড এবং তৌফিক ইমরোজ খালিদীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছাল। (তৌফিক ইরমোজ খালিদী তার হাতে থাকা কোম্পানির শেয়ারের একটি অংশ বিক্রি করে দেওয়ায় ওই টাকা পুরোপুরি বৈধভাবেই তার অ্যাকাউন্টে যায়)

১৩ অক্টোবর: চুক্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হল। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করল, যার শিরোনাম 'বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করল এলআর গ্লোবাল।'

বিএসইসি তৎপর হল অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে। 'বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিরত' থাকার আদেশ দিল, ওয়েবসাইটে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও তা জানানো হল।

১৩-১৪ অক্টোবর: এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যমে কিছু প্রতিবেদন ছাপা হল। স্পষ্টতই রসদ যোগানো হয়েছিল নেপথ্যের সেই গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে।

অক্টোবরের শেষ, নভেম্বরের শুরু: সোশাল মিডিয়ায় শুরু হল মিথ্যা প্রচার, চরিত্রহনন এবং কুৎসা রটনা। শুরুটা হল বেশ গোছানো ভঙ্গিতে, (এক 'সাংবাদিকের') এক ফেইসবুক পোস্টে আমার সম্মানহানির চেষ্টার মধ্য দিয়ে। কয়েক দিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এক অস্পষ্ট বক্তব্যের সূত্র ধরে সেই অভিযোগের সঙ্গে আমাকে জড়ানো হল। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কোনো একজন পত্রিকার সম্পাদক একটি ব্যাংকের এমডিকে ফোন করে টাকা দাবি করেছেন এবং সেই রেকর্ডও আছে।

যারা এ বিষয়গুলো নিয়ে অবগত, তারা ভালোভাবেই জানেন যে প্রধানমন্ত্রী কার কথা বলেছেন। গুরুত্বহীন কতকগুলো নিউজ সাইটে (যেগুলোর মূল কাজ প্রপাগান্ডা চালানো) অনুমাননির্ভর বেশ কয়েকজনের নাম এল, সেখানেও আমার নাম ছিল না। কিন্তু সেই 'সাংবাদিক' তার এক ফেইসবুক পোস্টে আমার নাম লিখে দিলেন।

তার অভিযোগ এতটাই অবাস্তব ছিল যে আমি এবং আমার সহকর্মীরা গুরুত্ব না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু অতীতে আমার সঙ্গে কাজ করার কারণে আমাকে জানেন এরকম কয়েকজনসহ শতশত ব্যক্তি ফেইসবুকে জবাব দেওয়া শুরু করলেন। কয়েকজন সোশাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টের তীব্র সমালোচনার মুখে কয়েক দিন পর সেই 'সাংবাদিকের' অবমাননাকর পোস্টগুলো সরিয়ে ফেলা হল। তাদের ওই কৌশল ব্যর্থ হল।

৪ নভেম্বর: দুদকের একটি অভ্যন্তরীণ চিঠি থেকে জানা গেল, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের 'মালিকের' বিষয়ে তারা তদন্ত করতে চায়।

৫ নভেম্বর: বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে একটি চিঠি পৌঁছাল, তাতে ৪ নভেম্বরের তারিখ দেওয়া। প্রধান সম্পাদকের সঙ্গে কোম্পানির বিরুদ্ধেও অভিযোগের কথা বলা হল সেখানে। বলা হল, আমার এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হিসাবে 'বিপুল অংকের অর্থ স্থানান্তরের' মাধ্যমে 'অবস্থান গোপন' এবং 'অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জনের' অভিযোগের বিষয়ে আমাকে উত্তর দিতে হবে। চিঠিতে 'অনুরোধ' করা হল, আমি যেন ওই বেনামা অভিযোগের বিষয়ে নিজের 'বক্তব্য' দেওয়ার জন্য ১১ নভেম্বর সকালে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত থাকি।

৭ নভেম্বর: আমি সময় চাইলাম, কারণ ওই একই দিনে গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (ঢাকা গ্লোবাল ডায়লগ) আমার যোগ দেওয়ার কথা ছিল। তিন দিনের ওই আয়োজনের দ্বিতীয় দিন একটি 'On and Offline: Countering Violent Extremism and Hate Crimes' শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ প্যানেল আলোচনায় আমার সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। দেড়শ বিদেশি অতিথিসহ প্রায় সাতশ লোকের ওই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে আমার নাম বাদ দেওয়া হয়।

১১ নভেম্বর: দুদক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে কথা বললাম আমি।

২৬ নভেম্বর: দুদকের একজন অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গে কথাবার্তা চলল ৫ ঘণ্টা ধরে

২৮ নভেম্বর: সকাল বেলা দুটো ব্যাংক থেকে আমার মোবাইলে কয়েকটি এসএমএস এল। তাতে বলা হল, আমার ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আর এফডিআর অ্যাকাউন্ট 'ব্লক' করে দেওয়া হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত (স্যালারি) অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলার সুযোগও বন্ধ রাখা হল।

৩ ডিসেম্বর: সন্ধ্যার দিকে ব্যাংকের কর্মঘণ্টা শেষ হওয়ার ঠিক পরপর আবার কয়েকটি এসএমএস পেলাম। বলা হল, 'ব্লকড' অ্যাকাউন্টগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কয়েক মিনিট না যেতেই এল এক ঝাঁক এসএমএস। বলা হল, এফডিআর অ্যাকাউন্টগুলো অবরুদ্ধ করা হয়েছে।

কয়েক দিন বাদে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারলাম, একটি আদালত গত ১ ডিসেম্বর অ্যাকাউন্টগুলো অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছে।

বিনিয়োগ চুক্তি সইয়ের পর প্রায় চার মাস হতে চলল, এখনও আমরা তাকিয়ে আছি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ, দুদকও 'অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের' অভিযোগের বিষয়ে কোনো ফাইনাল রিপোর্ট দেয়নি।

[একটি ব্যক্তিগত কৈফিয়ত: আমাদের নতুন বিনিয়োগকারী আমাকে সতর্ক করেছিলেন, বলেছিলেন, আমার শেয়ার বিক্রি করে দিলে মানুষের কাছে একটি ভুল বার্তা যেতে পারে। লোকে মনে করতে পারে, তারা যখন বিনিয়োগ করছে, আমি তখন কোম্পানি ছেড়ে যাচ্ছি। তারপরও কেন আমি কিছু শেয়ার বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলাম? কারণ যে দেশে আমার বা আমার মত নাগরিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই, সেখানে একটুখানি স্বস্তি আমার প্রয়োজন ছিল। কীসের স্বস্তি আমি চেয়েছি? আমি চেয়েছিলাম চিকিৎসাসহ জীবন চালানোর প্রয়োজনীয় খরচগুলো (যার কোনো সঞ্চয় নেই, নিজের বাড়ি নেই, সম্পদ নেই, তার জন্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ) মেটানো যেন আমার জন্য একটু সহজ হয়; আমি যেন অবসরের (যার স্বপ্ন আমি বেশ কিছুদিন ধরে দেখে আসছি) প্রস্তুতিটা ঠিকঠাক নিতে পারি; পরিবারের প্রয়োজনে যেন সাড়া দিতে পারি; এবং আবারও যদি কখনও আমার সহকর্মীদের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়ে, তাদের সহযোগিতা করার মত আত্মবিশ্বাস যেন আমার থাকে।]

[ইংরেজি থেকে অনূদিত]