নাসরিন আকতার (৪০) একজন প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী। লেখা-পড়া কিছুই জানেনা। ১৪ বছর বয়সে পার্শ্ববর্তী এক দরিদ্র কৃষকের সাথে তার বিয়ে হয়। স্বামী কৃষি কাজে সব সমই ব্যস্ত থাকত। সাংসারিক দায়িত্ব পালন করত নাসরিন। বিবাহিত জীবনের ২৬ বছরে ঘরে জন্ম নেয় ৬ মেয়ে ও ১ ছেলে। ছেলের আশায় সন্তান নেওয়া বন্ধ করে নি। ফলে এই বয়সী সন্তানদের নিয়ে অতি কষ্টে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। মাঝে মধ্যে উপোস বা অনাহারে থাকতে হয়। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া হলে স্বামী দোষ দেয় নাসরীনের। নাসরীন নিজের দোষ স্বীকার করে ঘরে বসে কাঁদে। অথচ তাদের বাড়ীর পাশে ছিল ইউপি স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কেন্দ্র।
মোসাঃ সুখি বেগম (৪৭) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক দিনমজুরের ঘরে জন্ম গ্রহণ করে। গ্রাম্য রীতি অনুযায়ী মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয় পার্শ্ববতী গ্রামের আল আমিন নামের এক দিনমজুরের সাথে। বর্তমানে সে চার মেয়ে এবং চার ছেলের জননী। স্বামীর একার রোজগারে সংসার চালাতে হয়। ভিটে মাটি যা ছিলো বিক্রি করে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছে। মাত্র ১ কাঠার জমির ওপর একটি ঘর তাদের সম্বল। বিভিন্ন স্থানীয় ব্যাংক ও এনজিওতে প্রায় লক্ষাধিক টাকার ঋণ নিয়েছে। ঋণের দায় থেকে মুক্তি পেতে দুই ছেলের বাল্যকালে বিয়ে দিয়েছে। ছেলেদের বিয়ের যৌতুকের টাকা দিয়েও দেনা পরিশোধ করতে পারে নি। এখন স্বামী স্ত্রীর মাঝে সব সময় ঝগড়া লেগেই থাকে। পাশ্ববর্তী মানুষ শুধু সুখি বেগমের ঘাড়ে দোষ চাপান। অথচ বাড়ির পাশে প্রায় দুই যুগ আগে থেকে রয়েছে গ্রাম্য স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র।
শুধু নাসরিন আকতার ও সুখি বেগমই নয়। এদের মত রয়েছে লাখ লাখ নারী। যারা জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে সচেতন না হওয়ায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে।
বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্যতম ও জনবহুল দেশ। এই দেশের ৮০ ভাগ জনগোষ্ঠী বসবাস করে গ্রামাঞ্চলে। মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হচ্ছে আমাদের দেশে। এসব নারীদের অধিকাংশ অশিক্ষিত। তারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ। একসময় মানুষ মনে করত যিনি জন্ম দিয়েছেন তিনি দিবেন খাবার। এই ধ্যান-ধারণা আধুনিক কালে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেছে। ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটো সন্তান। একটি হলে ভালো। শহুর এলাকা ও শিক্ষিত পরিবার ছাড়া গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও রয়েছে অনেক নারী যাদের দুই তিনজন ছেলে মেয়ে থাকা সত্বেও সন্তান নেওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে। ফলে জনসংখ্যা হু হু করে বেড়েই চলছে। ১৮৬০ সালে বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে লোক সংখ্যা ছিলে মাত্র ২ কোটি। ১৯৪১ সালে ৪.২০ কোটিতে দাঁড়ায়। ১৯৭৪ সালে আদম শুমারী মতে, ৭.৬৪ কোটি জনসংখ্যা ছিল। ২০০১ সালে দাঁড়ায় ১২.৯৩ কোটি। অর্থাৎ ২৭ বছরে বেড়েছে ৫.২৮ কোটি জনসংখ্যা। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। এক হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর জন্ম নিচ্ছে ২৫ লাখ শিশু এবং মৃত্যুবরণ করছে মাত্র ৬ লাখ শিশু। ফলে প্রতিবছর বাড়ছে ১৯ লাখ মানুষ। তাছাড়া আধুনিক যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নত ব্যবস্থা থাকায় বাংলাদেশী মানুষের গড় আয়ু আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন জনসংখ্যা সমস্যা সবচে বড় সমস্যা।
গ্রামাঞ্চলে সন্তান প্রসবের কারণ হচ্ছে, অধিকাংশ নারী ও পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্বন্ধে সচেতন নয়। কারণ বাল্য বিবাহের প্রবণতা বেশী প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে এখনও গ্রাম্য নারীরা সচেতন নয়। স্ত্রীর গর্ভে পুরুষ শিশুর জন্ম হোক সেটা চায় স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে। এতে দেখা যায় দুই বা তিন জন কন্যা সন্তান থাকা সত্ত্বেও ছেলে সন্তানের আশায় ক্রমান্বয়ে সন্তান জন্ম দিতে থাকে। নারী-পুরুষ উভয়ে জীবিকার নির্বাহের জন্য কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকে। বিনোদনের জন্য কোন ব্যবস্থা না থাকায় যৌন তৃপ্তিকে একমাত্র বিনোদন ব্যবস্থা মনে করে। ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোন খেয়াল থাকে না। অধিক সন্তান প্রসবের দরুণ মায়েদের স্বাস্থ্য হানি ঘটে। অধিক সন্তান প্রসব করতে গিয়ে নারীরা ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন নারী ফিস্টুলা রোগে ভূগে। কারণ টাকার অভাবে ৮৭ ভাগ ডেলিভারী সম্পন্ন হয় বাড়ীতে।
পবিত্র কোরান শরীফে ইরশাদ হয়েছে, সন্তান জন্মদাতার কর্তব্য তাগিদে (সন্তান) ভদ্রভাবে ভরণ পোষণ করা। ( সুরা বাকারাহ্ আয়াত: ২৩৩) বেশি সন্তান জন্ম দিলে বাচ্চাদের সঠিকভাবে গড়ে তুলা সম্ভব নয়। অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের মতে, খাদ্য উৎপাদন অপেক্ষা জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্য সামগ্রী বাড়ে গাণিতিক হারে, জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার না করার জন্য স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে দায়ী হলেও সম্পূর্ণ দায় এসে পড়ে নারীর ঘাড়ে। তবে এই কথা অনস্বীকার্য যে, জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সর্ব প্রথমে স্ত্রীকে সচেতন হতে হবে। এক সময় ধর্মীয় নেতারা বলতেন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করা ইসলাম ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ হারাম। কিন্তু আধুনিককালের আলেম ওলামাদের মতে, তিনটি কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। কারণ সমূহ হচ্ছে, স্ত্রী যদি মনে করে সন্তান জন্ম প্রসব করার কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার আশংঙ্কা রয়েছে, সন্তান লালন-পালন করতে ঝামেলা হবে, অসুস্থতার কারণে। এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের এখতিয়ার স্ত্রীর। এছাড়াও হাদীসে বলা হয়েছে, জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আজল করার কথা। হাদীসের আলোকে আধুনিক কালের আলেম ওলামারা বলেন, আজল করার ক্ষেত্রে স্ত্রী অনুমতি প্রয়োজন। এখানে থেকেও স্পষ্ট যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করার দায়িত্ব নারীর।
দেশে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার ও পরিকল্পনা কেন্দ্র, সরকারি স্বাস্থ্য ও উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক সহ অসংখ্য ব্যবস্থা রয়েছে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য। কিন্তু মাঠ কর্মীরা গ্রামেগঞ্জে দম্পতিদের দ্বারে দ্বারে যায়না। ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এছাড়াও সরকারিভাবে যে পিল বা মায়া বড়ি প্রদান করা হয় তা এদেশের নারীরা খেলে মাথা ঘুরায় প্রাথমিক অবস্থায়। ফলে অনেক নারী সহ্য করতে না পেরে খাওয়া বাদ দেয়। জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ইনজেকশনও নারীদের নানা সমস্যা করে। অন্যান্য যে সব জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি রয়েছে সে সম্বন্ধে গ্রামাঞ্চলের নারীরা অজ্ঞ। ফলে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেসব নারীরা জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে অজ্ঞ তাদের উচিত স্থানীয় স্বাস্থ্য, উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও পারিবারিক স্বাস্থ্য ক্লিনিক গুলোতে স্ব-উদ্যোগে যোগাযোগ করতে হবে। তাছাড়া শিক্ষিত নারীদের নিকট পরামর্শ নিতে হবে। দাদি, নানী, চাচী, ফুফু, ননদ, শাশুড়ি ও ভাবীরা নব সন্তান প্রসবী নারীকে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সর্তক ও সহায়তা করতে পারে। নারীর সদিচ্ছা না থাকলে যতই সচেতন করা হোক না কেন সব বিফল হবে।
বিভিন্ন নারী সংগঠন সমূহকে অধিক সন্তানের পরিণতি বিষয়ে নাটক, বিজ্ঞাপন, প্রবন্ধ, ফিচার ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
জন্মনিয়ন্ত্রণের নারীর একান্ত সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন তা না হলে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় এ কথা কারো অস্বীকার করার অবকাশ নেই।
***
আজমাল হোসেন মামুন
(azmal22@gmail.com)
উন্নয়নকর্মী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
দক্ষিণখান,& উত্তরা, ঢাকা-১২৩০।
***
ফিচার ছবি: ইন্টারনেট
পিয়াস বলেছেনঃ
আপনি বলেছেন, অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের মতে, খাদ্য উৎপাদন অপেক্ষা জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্য সামগ্রী বাড়ে গাণিতিক হারে, জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে।
বর্তমানে এ ধারণাটি সঠিক নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুন, কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেড়ে তিনগুনেরও বেশি হয়েছে। আসল সমস্যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারনে জন্ম নেয়া বৈষম্য।
আজমাল হোসেন মামুন বলেছেনঃ
আমি আপনার সাথে একমত হতে পারলাম না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা হচ্ছে অধিক জনসংখ্যা। এ জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে খুবই ভয়াবহ আকার ধারণ করবে যা পারমানবিক বোমার চাইতেও ভয়ংকর। আসুন বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করি। ভাল থাকবেন।
কিং অফ ইথিওপিয়া বলেছেনঃ
স্থান-কাল-পাত্র জ্ঞানহিন ভাবে জন্মনিয়ন্ত্রন করতে চাওয়াট চরম বোকামি । দরিদ্রদের জন্ম নিয়ন্ত্রন করা হলেও সমর্থ বা ধনিদের আবার অধিক হারে সন্তান জন্ম দিতে উতসাহিত করা উচিত । জনসংখ্যা পৃথিবির সর্বোতকৃষ্ট সম্পদ ; আমাদের এই সম্পদের সাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধ সাধা মোটেই উচিত নয় ।
আজমাল হোসেন মামুন বলেছেনঃ
আপনি যে কথা বললেন তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলাটা কতটুকু সমীচীন হবে তা একটু চিন্তা করলেই সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে ৯০ তম। অথচ জনসংখ্যার ভয়াবহতা দেখলে মাথায় আগুন ধরে। তাই আমাদের উচিত দেরীতে বিয়ে করা এবং সন্তান কম নেওয়া। ভাল থাকবেন। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
হাসান বলেছেনঃ
জনসংখ্যা নামক সমস্যাকে সম্ভাবনায় পরিনত করা যায়:
দেশে ১৯৭১ সালে মাত্র ৭ কোটি লোক ছিল। তারপরও মানুষ না খেয়ে থাকত। আর এখন ১৬ কোটি লোকের দেশে জনগণের অবস্থা খুব ভালো না হলেও কাজের লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন।
৭১ সালে দেশে খাদ্য উৎপাদন ছিল মাত্র ১০০ লক্ষ মেট্রিক টন। আর বর্তমানে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে দাড়িয়েছে ৩০০ লক্ষ মেট্রিক টনেরও বেশি। অর্থাৎ এ সময়ে দেশে মানুষ বেড়েছে দ্বিগুনের একটু বেশি কিন্তু একই সময়ে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিন গুনেরও বেশি। বর্তমান বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনের ক্ষমতা প্রায় ১২০০ কোটি মানুষের। কিন্তু ৭০০ কোটি লোকের এক তৃতীয়াংশ মানুষ অভুক্ত থাকে তথা তাদের প্রয়োজনীয় ক্যালরি থেকে বন্চিত হয়। মূল সমস্যা ধনী দেশগুলোর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অধিক মুনাফা লাভের মানসিকতা ও বন্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য। বর্তমান বিশ্বে খাদ্যদ্রব্যের স্বল্পতার অজুহাত ও দাম বৃদ্ধির কাল্পনিক প্রপাগান্ডার মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যের বাজারে সবচেয়ে বেশি জুয়াখেলা হচ্ছে।
আজমাল হোসেন মামুন বলেছেনঃ
জনসংখ্যা নামক সমস্যাকে সম্ভাবনায় পরিনত করা যায় কিন্তু সেটা কি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সমাধান হবে। তাই আমাদের উচিত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা। নারীদের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে খুবই ফলপ্রসূ। খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে এক সময় ফসলী জমিই খুজে পাওয়া মুসকিল হবে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনার সময় এসেছে। আসুন আমরা একযোগে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কাজ করি।
ফারাবী বলেছেনঃ
আপনাকে ধন্যবাদ। আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আপনাদেকে উত্তম প্রতিদান দিক। in Facebook I have an account by that- Farabi1924@gmail.com
হাসান বলেছেনঃ
আজমাল ভাই আশা করি পুরোটা মনোযোগ দি পড়বেন, তাহলে আপনার ভ্রান্তি দূর হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। একদিকে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যার বৃদ্ধি, অন্যদিকে উন্নত বিশ্বে জৈব জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে খাদ্য সঙ্কট দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে। ফলে গত কয়েক বছরে খাদ্যদ্রব্যের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় দারিদ্র্য ও অপুষ্টির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে অনুন্নত ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোতে দ্রব্যমূল্যের কারণে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। আর এর ভয়াবহতা আমাদের মতো জনবহুল দরিদ্র দেশটির জন্য এক বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করেছে। তবে যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের সম্পদের সঠিক ব্যবহার বিশেষ করে কৃষির আধুনিকায়ন এবং সময় ও সম্ভাবনাকে ধারণ করে শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশকে কৃষিভিত্তিক শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করা সম্ভব।
আমাদের অর্থনীতির (বর্তমান) চিত্র:
মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দরিদ্র দেশটিতে প্রায় ১৬ কোটি লোকের বসবাস। যা কি না সমগ্র বিশ্বে বিরল। অধিকন্তু একদিকে যেমন আমরা আমাদের ক্ষুদ্র হলেও অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ও উর্বর ভূমিটুকুর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি, অন্য দিকে এই বিশাল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে না পারায় তা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলতে গেলে আমাদের কৃষিতে এখনো সেকেলে চাষ পদ্ধতিই রয়ে গেছে। কৃষিতে আধুনিকায়ন করা গেলে কয়েক গুণ উৎপাদন বাড়ানো যেত। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের কৃষিব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারলে দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেও রফতানি করা সম্ভব।
দেশের মোট জনশক্তির ৬২ শতাংশ কৃষি খাতে নিয়োজিত।
২০০৬-০৭ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ২১.৩৭ শতাংশ। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দেশে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় ২৮৯.৪২ লাখ মেট্রিক টন। আর সরকারি ও বেসরকারিভাবে খাদ্যশস্য আমদানি করা হয় ২৪.২০ লাখ মেট্রিক টন।
২০০৭-০৮ অর্থবছরের খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৩৬.৩২ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৩২.২৩ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়েছে।
জনসংখ্যা নামক সমস্যাকে সম্ভাবনায় পরিনত করা যায়:
দেশে ১৯৭১ সালে মাত্র ৭ কোটি লোক ছিল। তারপরও মানুষ না খেয়ে থাকত। আর এখন ১৬ কোটি লোকের দেশে জনগণের অবস্থা খুব ভালো না হলেও কাজের লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন।
৭১ সালে দেশে খাদ্য উৎপাদন ছিল মাত্র ১০০ লক্ষ মেট্রিক টন। আর বর্তমানে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে দাড়িয়েছে ৩০০ লক্ষ মেট্রিক টনেরও বেশি। অর্থাৎ এ সময়ে দেশে মানুষ বেড়েছে দ্বিগুনের একটু বেশি কিন্তু একই সময়ে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিন গুনেরও বেশি। বর্তমান বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনের ক্ষমতা প্রায় ১২০০ কোটি মানুষের। কিন্তু ৭০০ কোটি লোকের এক তৃতীয়াংশ মানুষ অভুক্ত থাকে তথা তাদের প্রয়োজনীয় ক্যালরি থেকে বন্চিত হয়। মূল সমস্যা ধনী দেশগুলোর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অধিক মুনাফা লাভের মানসিকতা ও বন্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য। বর্তমান বিশ্বে খাদ্যদ্রব্যের স্বল্পতার অজুহাত ও দাম বৃদ্ধির কাল্পনিক প্রপাগান্ডার মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যের বাজারে সবচেয়ে বেশি জুয়াখেলা হচ্ছে।
[সূত্র : অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০০৮]
এ ছাড়া সঠিকভাবে বাজারজাতকরণের অভাবে কৃষকরা তাদের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গড়ে উঠেছে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিশাল সিন্ডিকেট। সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অনেক ফসল। অথচ দেশে উৎপাদিত আলু, কলা, আনারস, পেঁপে, তরমুজ, বেল, আম, কাঁঠাল প্রভৃতি পণ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে নতুন নতুন উপাদেয় তৈরি করে নিজেদের পুষ্টির সরবরাহের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা যেত। যেমন- ১ কেজি আম বিক্রি করে কৃষক বড়জোড় ২৫-৩০ টাকা পান। অথচ উন্নত উপায়ে আম থেকে জুস তৈরি করে পেপসি কিংবা কোকাকোলার মত আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রান্ডিং করা গেলে অনেক বেশি মূল্য সংযোজন করা যেত। নরসিংদীর একজন কৃষক জানালেন তার বাগানে ৫-৭ কেজি ওজনের পেঁপে উৎপাদিত যা ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়। অথচ ৫-৭ কেজি ওজনের একটি পাঁকা পেঁপে থেকে উন্নত উপায়ে জুস তৈরি করে পেপসি কিংবা কোকাকোলার মত আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রান্ডিং করা গেলে প্রায় ২০০০ – ৩০০০ টাকা মূল্য সংযোজন করা যেত। অনুরূপভাবে বলা যেতে পারে আলু, কলা, আনারস, তরমুজ, বেল, কাঁঠাল প্রভৃতি পণ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে অনেক বেশি মূল্য সংযোজন করা যায়। কারণ মালয়েশিয়া মূলত তাদের পামওয়েল ও পর্যটনের ওপর নির্ভর করে কিংবা নিউজিল্যান্ড তাদের গাভির ওপর নির্ভর করে যদি তাদের অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে পারে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে এত কিছু থাকার পরেও অগ্রগতি না হওয়াটা লজ্জাকর ও আমাদের সীমাহীন অদক্ষতার প্রমাণ বহন করে।
সম্প্রতি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে শুধু পশুসম্পদ খাতে যে পরিমাণ উৎপাদন সম্ভব বর্তমানে তার মাত্র ২০ শতাংশ উৎপাদন করা হচ্ছে এবং অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ অনুৎপাদিত থেকে যাচ্ছে।
জার্মানির একজন কৃষি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ সফর শেষে দেশে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, দেশটি এত বেশি উর্বর যে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রে লাঙ্গল লাগে না, আঙ্গুল দিয়ে খুঁচিয়ে কদুর (লাউয়ের) বীজ বপন করলে দুই দিন পর লতা, কয়েক দিন পরে পাতা এর পর কদু (লাউ) জন্মায়। অথচ দেশটির লোকেরা অশিক্ষিত ও অলস। তারা চিংড়ি মাছ দিয়ে মজা করে লাউ খায় আর গান ধরে- ‘স্বাদের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী।
একজন জাপানি বিশেষজ্ঞের মন্তব্য ছিল বাংলাদেশটাকে আমাদের হাতে দেয়া হলে আমরা বিশ্বকে কৃষিভিত্তিক শিল্পোন্নত দ্বিতীয় জাপান উপহার দিতাম।
কচুর লতি রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে:
কচুর লতির পুষ্টিগুন ও ভেজষ তথা ওষধিগুন অপরিসীম। এর বানিজ্যিক সম্ভাবনাও ব্যাপক। প্রতি একরে কয়েক মণ নয়, কয়েক টন কচুর লতি উৎপাদিত হয়।
জয়পুরহাটের কচুর লতি দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। স্বল্প সময়ে অধিক লাভবান হওয়ায় জেলার কৃষকরা দিন দিন লতি চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে লতি চাষ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব বলে লতি ব্যবসায়ীরা মনে করেন। জয়পুরহাটে উৎপাদিত কচুর লতি ঢাকা, জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল, সিলেট, রাজশাহী, খুলনাসহ বিদেশে ও রপ্তানি হচ্ছে। গত ক’বছর ধরে গ্রেট ব্রিটেন, আমেরিকা, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের বাজারে এ লতি বাজারজাত করা হচ্ছে। ঢাকাভিত্তিক ৪টি কোম্পানি হরটেজ ফাউন্ডেশন, ইউরেশিয়া, গোল্ডেন হারভেস্ট ও মেরিনো লিঃ বাংলাদেশ থেকে এই লতি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক আব্দুস সোবহান ফেরদৌসী জানান, কচুর লতি চাষ একটি লাভজনক ফসল। দিনদিন এর চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্দিষ্ট বাজার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে সরকার ও কৃষক উভয়ই লাভবান হবে।
সম্ভাবনার অপার দিগন্ত এ দেশ-
আমাদের সমমানের কয়েকটি দেশের অগ্রগতির তুলনামূলক চিত্র:
মাথাপিছু আয়
১৯৮০ সালে –
১. বাংলাদেশ – ৫৫০ ডলার,
২. ভারত – ৬৬৮ ডলার,
৩. চীন – ৪৬৪ ডলার
মাথাপিছু আয়
২০১০ সালে –
১. বাংলাদেশ – ১৫৮৭ ডলার,
২. ভারত – ৩৩৩৭ ডলার,
৩. চীন – ৭২৫৮ ডলার
এমনকি আমাদের চেয়ে কম সম্ভাবনাময় অনেকগুলো দেশের মাথাপিছু আয় ২০০০০ মার্কিন ডলারের বেশি।
বিশ্বমোড়লদের নজরে বাংলাদেশ:
যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, ভারত, চীন, জাপান, ডব্লিউবি, আইএমএফ প্রভৃতি দেশ ও সংস্থার দরিদ্র এই দেশটির দিকে নজর দেয়ার কারণ হিসেবে অনেকে শুধু দেশটির তেল-গ্যাস-বন্দর প্রভৃতি সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক সম্পদ ও তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের কথা বলে থাকলেও এর সাথে জড়িত রয়েছে অনেক বড় অর্থনৈতিক স্বার্থ। কারণ দেশটি আয়তনে বিশ্বের ৩ হাজার ভাগের মাত্র ১ ভাগ হলেও এর লোকসংখ্যা ৪০ ভাগের ১ ভাগ। যা কি না বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে ২০-৪০ গুণ বড় এরকম অনেক দেশেই অনুপস্থিত। আর এই বিশাল ভোক্তার জনসংখ্যার কারণে আয়তনে দরিদ্র হলেও এই দেশটি একটি বিশাল বাজার। এই ১৮ কোটি লোকের বাজার দখল বিশ্বমোড়লদের অতিরিক্ত নজরের একটি অন্যতম কারণ। কেননা অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের নিজেদের অর্থনীতিকে উৎপাদনমুখীর পরিবর্তে ভোগমুখী করে তোলা হয়েছে দৃশ্যমান এসব দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর পরামর্শে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, তৃতীয় বিশ্বের এই জনবহুল উন্নয়নশীল দেশটির রাজধানী শহরকে এখন বিশ্বের ‘সিটি অব শপিংমল’ বললে অত্যুক্তি হবে না। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহর টোকিও “সিটি অব প্রোডাকশন” তথা উৎপাদনের শহর হিসেবে বিবেচিত।
দেশের অর্থনীতির দিকে তাকান, দেখতে পাবেন আমাদের ভোগকৃত অধিকাংশ পণ্যসামগ্রীই শুধু নয়, চিন্তা-চেতনা তথা সংস্কৃতিও হয় প্রতিবেশী দেশ নতুবা ওই সব মোড়ল দেশের বহুজাতিক কোম্পানি বা চ্যানেল থেকে আমদানি করা। যেখানে আমাদের নিজস্ব যোগান নামমাত্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে আরো ৮০ শতাংশ খাঁটি দুধ উৎপাদন সম্ভব অথচ শিশুখাদ্যের জন্য বিদেশীদের ভেজাল দুধেই আমরা অধিক সন্তুষ্ট। এখন প্রশ্ন আসতে পারে- দেশের বাজেটে ও বাঘা বাঘা অর্থনীতবিদ ও সংস্থাগুলোর গবেষণায় আমাদের প্রবৃদ্ধি তো বাড়ছেই। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতির একজন ছাত্র হিসেবে আমার কাছে যেটা মনে হয়, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেখানে বাস্তবতার আলোকে অনেক বেশি উৎপাদনমুখী হওয়ার কথা ছিল সেখানে তা কেবলই ফটকা কারবারি ও প্রতারণার ফাঁদে বন্দী। এখানে যেটা হচ্ছে তা হলো ১০ টাকাকে ২০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে দেশের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি সত্যিকার অর্থে খুবই নগণ্য।
প্রয়োজন সময় ও সম্ভাবনাকে ধারণ করা:
বিশ্ববাজারে কৃষিপণ্যের অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধিকে আপাত আমাদের মতো কৃষিনির্ভর জনবহুল দেশের জন্য অধিক বিপদসংকুল মনে হলেও এটাকে আমরা বাস্তবমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে পারি। কারণ বাংলাদেশের কৃষিতে যে অযুত সম্ভাবনা রয়েছে সেটাকে কাজে লাগাতে পারলে নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেও বিশ্ববাজারে রফতানি করা সম্ভব। বিভিন্ন গবেষণা থেকে এ কথা প্রমাণিত যে, আমরা কৃষি ক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাবনার খুব কমই বর্তমানে উৎপাদন করছি। এর মূল কারণ কৃষিকে আমরা এখনো আধুনিক করতে পারিনি। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা ও হীনমন্যতার কারণে কৃষিতে এখন প্রায় শতভাগ কৃষক ও খামারীই অশিক্ষিত।
শিক্ষা ব্যতিরেকে কৃষির আধুনিকায়ন বলতে গেলে অসম্ভব। কারণ হিসেবে একটি উদাহরণ পেশ করছি। আমি একজন কৃষককে বললাম, আপনি আপনার জমিতে ধানের অবশিষ্ট যে গোছা বা (নাড়া) জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য পোড়াচ্ছেন সেটা আপনি অন্যত্র পুড়িয়ে এনে জমিতে দিলে সারের কাজও করবে এবং অন্যত্র পোড়ানোর কারণে জমির গুরুত্বপূর্ণ উপাদানও নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পাবে। তখন প্রবীণ ওই কৃষকটি আমার ওপর অনেকটা রাগই করে বসেন। তিনি বললেন, বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষ থেকে জমিতে পুড়িয়ে আসছেন কোনো সমস্যা শুনলাম না আর তুমি এসেছ নতুন কথা নিয়ে। এখন দেখুন যে দেশে বলতে গেলে একজন কৃষকও উচ্চশিক্ষিত দূরের কথা সামান্য শিক্ষিতও নয়, তাদের কাছ থেকে কৃষির আধুনিকায়ন দুরাশা মাত্র। এ ক্ষেত্রে আমাদের বিপুল জনশক্তির একটি বিশাল অংশকে যেমন যোগ্য ও দক্ষ করে বিদেশে পাঠানোর পাশাপাশি দেশের হাজারো শিক্ষিত যুবকদের যদি কৃষি ক্ষেত্রে নিয়োজিত করা যায় তাহলে একদিকে যেমন অপরাধ কর্মকাণ্ড হ্রাস পাবে অন্য দিকে দেশের কৃষিতে একটি বিপ্লব সাধিত হবে।
যদিও সরকারের যুব উন্নয়ন, কৃষি, মৎস্য বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলা সদরে সহযোগিতার ব্যবস্থা রেখেছেন এবং সম্প্রতি দেশী-বিদেশী সব ব্যাংকের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কৃষি ঋণ দেয়া বাধ্যতামূলক করেছেন কিন্তু এ ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের কাক্ষিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৭৫% অর্জিত হয় গার্মেন্টস খাত থেকে। তদুপরি সম্ভাবনাময় এ সেক্টরে প্রায় ৩০ লক্ষ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। যেখানে প্রায় ৮০% নারী শ্রমিক। গার্মেন্টস সেক্টরে এই বিশাল পরিমাণ দরিদ্র নারী সমাজের কর্মসংস্থান করা না গেলে দূর্মূল্যের এই বাজারে দেশের অধিকাংশ স্থানে গার্মেন্টস শিল্পের স্থলে ফিলিপাইন কিংবা সিংগাপুরের মত তথাকথিত যৌন শিল্প গড়ে ওঠলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। উল্লেখ্য বিভিন্ন দেশের মাথাপিছু আয় যত বেশিই হোক না কেন ? সেটা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ? কারন বর্তমান বিশ্বের Single largest business হল sex industry. 2nd Arms industry and 3rd illegal drugs. কিন্তু বিপুল সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস খাতেও গ্যাস-বিদ্যুতে অভাব ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারনে বর্তমানে বিশ্ববাজারে চাহিদার মাত্র অর্ধেক যোগান দিতে পারছি। দেশে যেখানে প্রতিদিন মাত্র ১/২ গিগা বিদ্যুৎ দরকার সেটাও আমাদের সরকারসমূহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ!!!!???? কাজে/অকাজে ব্যস্ত থাকায় উৎপাদন করতে পারেনি। লোডশেডিং এখন অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। অথচ জাপান, জার্মানি সহ অনেক দেশে ১০-২০ গিগার উপরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা অর্জন করেছে কেবল বিনামূল্যের সৌর শক্তি কে কাজে লাগিয়ে। বিগত ২০ বছরে জার্মানিতে কখনো লোডশেডিং হয়েছে কিনা সেটা গবেষনা করে দেখতে হবে। আর গার্মেন্টস সহ যেকোন শিল্পের বিকাশে আমাদের অন্যতম সুবিধা বিপুল জনশক্তি। যেখানে ভারতে একজন শ্রমিকের মজুরি কমপক্ষে ১০০০০ রুপি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ লক্ষ টাকা সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ২-৩ হাজার টাকায় শ্রমিক পাওয়া যায়। তবে গার্মেন্টস শিল্পের অর্জিত আয়ের প্রায় সিংহ চলে যায় বিদেশিদের পকেটে। কারন শ্রম ছাড়া কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি (বিনিয়োগ ) , মূল উদ্যেক্তা, লবিষ্ট, বিশেষজ্ঞ সবই বাইরের। বাস্তবতা হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্পে শ্রম সস্তা হওয়ার কারনে আমরা কেবল দর্জিগিরি করার সুযোগ পাচ্ছি। আর এ শিল্পের এ দেশীয় মালিকদের মালিক না বলে মালী বললেই যথার্থ হবে। এরপরেও দেশের অর্থনীতিতে গার্মেন্টস শিল্পের ভূমিকা অসামান্য। তবে গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা সমাধান করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শ্রমিকদের যথাযথ অধিকার নিশ্চিত করা গেলে এ খাত থেকে আমাদের আয় অনেক বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি দেশীয় কাঁচামালের সম্ভাব্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে ওষুধ শিল্পসহ কৃষিনির্ভর শিল্পায়ন অগ্রাধিকার দেয়া দরকার।
একটি কেস স্টাডি:
অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর অনেক নেতিবাচক বিষয়গুলোর প্রচার-প্রসার আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার কাজটুকু যতটা ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায় তাদের ভালো দিকগুলোর ছিটেফোঁটাও চোখে পড়ে না। যুক্তরাষ্ট্রে বা জাপানে একজন কৃষক বা খামারীও অশিক্ষিত চোখে পড়বে না অথচ আমাদের দেশের একজন উচ্চশিক্ষিত তো দূরের কথা সামান্য শিক্ষিত লোকের কাছেও কৃষক পরিচয় দেয়াটা জাতকুল চলে যাওয়ার মতো বিষয়। উচ্চশিক্ষিতদের (তাদের) চোখে কোনো মোবাইল কোম্পানির অফিসে করণিক বা রিসিপশনিস্টের কাজটাকে অধিক আকর্ষণীয় হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। ঠিক এ রকম প্রেক্ষাপটে ভিন্নরকম সম্ভাবনাময় কিছু উদ্যোগ মাঝে-মধ্যে চোখে পড়ছে।
দেশের অর্থনীতি যখন ফটকা কারবারি ও ভোগমুখী তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন মেধাবী তরুণ পড়াশোনা শেষ করেই কৃষিভিত্তিক ও দেশের জন্য উৎপাদনমুখী একটি ফার্মের স্বপ্ন নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন একটি গরু মোটাতাজাকরণ খামার। পঞ্চাশটি গরু নিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে তারা ২ বিঘা জমি বন্যা প্রতিরোধের উপযোগী করে ২০০টি গরুর সেট এবং প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে ঘাসের চাষাবাদের ব্যবস্থা করেছে। মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে তারা তাদের খামারে ব্যাপক উন্নতি করতে পেরেছে। কারণ উচ্চশিক্ষিত হওয়ার কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই খামারটি অত্যন্ত লাভজনক হতে পেরেছে। উল্লেখিত তরুণরা সম্মিলিত মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে খামারটি গড়ে তুললেও বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত থেকে সম্ভাবনাময় এই কৃষিভিত্তিক ফার্মটিতে সময় দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চেয়েও একজন সফল কৃষক বা খামারী পরিচয়টাই তাদের কাছে অধিক পরিতৃপ্তির। তাদের ধারণা, দেশের উচ্চশিক্ষিত কিছু যুবক যদি আমাদের সম্ভাবনাময় কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত করে সঠিকভাবে কৃষিঋণসহ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে বাংলাদেশকে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে দাঁড় করানো সময়ের ব্যাপার মাত্র।সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। একদিকে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যার বৃদ্ধি, অন্যদিকে উন্নত বিশ্বে জৈব জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে খাদ্য সঙ্কট দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে। ফলে গত কয়েক বছরে খাদ্যদ্রব্যের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় দারিদ্র্য ও অপুষ্টির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে অনুন্নত ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোতে দ্রব্যমূল্যের কারণে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। আর এর ভয়াবহতা আমাদের মতো জনবহুল দরিদ্র দেশটির জন্য এক বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করেছে। তবে যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের সম্পদের সঠিক ব্যবহার বিশেষ করে কৃষির আধুনিকায়ন এবং সময় ও সম্ভাবনাকে ধারণ করে শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশকে কৃষিভিত্তিক শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করা সম্ভব।
তাজুল ইসলাম বলেছেনঃ
কি আর বলব? বাঘা বাঘা সব মন্তব্যের ভিড়ে আমার মন্তব্য হল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন আনা উচিত। কিন্তু যিনি পাঠাবেন তিনি নিশ্চয়ই খাদ্যের, বাসস্থানের উপযুক্ত ব্যবস্থা করেই পাঠাবেন। ধন্যবাদ
কিং অফ ইথিওপিয়া বলেছেনঃ
সাইজ-টাইজ বিচারে আমি আপনার চেয়ে অধিক প্রতিবন্ধি । আর আপনি আসলে শারিরিক প্রতিবন্ধিতার চেয়ে মগজের প্রতিবন্ধিতায় বেশি আক্রান্ত ।
আপনাকে কে বলেছে যে, আমাদের ক্রমবর্ধমান অতিরিক্ত জনসংখ্যা দেশেই থাকবে ? আর যদি থাকেও শুধু বৃহত্তর ঢাকা, চিটাগাং, রাজশাহি, সিলেট, বরিশাল আর খুলনাতেই তো সারা দেশের বর্তমান জনসংখ্যার অন্তত ১০ গুন জন সংখ্যা অতি সহজে সংকুলান করা যাবে । নিচের লিঙ্কে বিশ্বের পপুলেটেড শহরগুলোর পরিসংখ্যান দেখুন –
http://en.wikipedia.org/wiki/List_of_cities_proper_by_population
নাহুয়াল মিথ বলেছেনঃ