হিজড়াদের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত

আজমাল হোসেন মামুন
Published : 7 June 2015, 07:12 PM
Updated : 7 June 2015, 07:12 PM

কেস স্টাডি-১: রজনী গন্ধ্যা (৩০) জন্মগতভাবে একজন লিঙ্গ প্রতিবন্ধী। মাত্র চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখা-পড়া করে বেঁচে থাকার তাগীদে বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলা থেকে ঢাকা শহরে পাড়ি জমিয়েছে। তাঁর লেখা-পড়া করার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ায় সে স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। ৪ ভাই বোনদের মধ্যে সে একাই হিজড়া। বর্তমানে শ্যামপুরে ১ হাজার টাকা মাসিক ভাড়া থাকেন। সাথে থাকেন দুই ভাতিজা। ভাতিজারা স্কুলে লেখা-পড়া করে। লেখা-পড়ার খরচ সে বহন করে। প্রতিদিন সকালে ৭ থেকে ১০ জন হিজড়া এক সঙ্গে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বের হয়। সকল ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে দান স্বরূপ ২ টাকা ৫ টা করে টাকা চান। এভাবেই আয় করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন বলে তিনি জানান।

কেস স্টাডি-২: মাকুস (২৫) একজন লিঙ্গ প্রতিবন্ধী। গ্রামের বাড়ি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ৩ ভাই ও বোনের মধ্যে সে ছোট। হিজড়ার কারণে এলাকার মানুষ নেতিবাচক দৃষ্টিতে তাকে দেখত। ফলে মা ঢাকার একজন সর্দারনীর হাতে মাকুস কে তুলে দেন। লেখা-পড়া কিছুই জানে না। শুধু নাম সই করতে পারে। সর্দারনীর তত্তাববধানে সে বড় হয়েছে বলে সর্দারনীকে মা বলে সম্বোধন করে। এখন দলবদ্ধভাবে সে অন্যান্যদের সাথে গিয়ে সাধারণ মানুষের নিকট থেকে উপহার স্বরূপ যে টাকা পায় তা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সে জানান, কুকুরের দাম আছে তো আমাদের দাম নেই। আমাদের নিয়ে সরকার কী করবে? আমরা না পুরুষ না হিন্দু। তবে উপযুক্ত প্রশিণ প্রদান করা হলে হয়ত: আমাদের মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে হবে না।

কেস স্টাডি-৩: ঝর্ণা (২২) গ্রামের বাড়ি কালিগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। লেখাপড়া মাত্র ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত। অর্থাভাবে ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার জন্য লেখা-পড়া করতে পারে নি। ৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে সে একমাত্র লিঙ্গ প্রতিবন্ধী (হিজড়া)। শ্যামপুরে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করে। বেঁচে থাকার তাগীদে অন্যান্য হিজড়াদের সাথে দলবদ্ধভাবে ঢাকা শহরে টাকা উঠিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। সে জানায়, আমরা (হিজড়া) বিধাতার অভিশাপ। কেন বিধাতা আমাদের এই হিজড়া বানিয়েছে। এটা তার রহস্য নাকি পিতা ও মাতার পাপের ফসল। আমাদের নিয়ে কেউ ভাবে না। আমরা ভালোভাবে সমাজে মর্যাদার সাথে বাঁচতে চায়। কারণ আমরা্ও মানুষ।

আমাদের দেশে বিভিন্ন সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী রয়েছে। তার মধ্যে হিজড়ারা অন্যতম। ওরা সবচেয়ে অবহেলিত। শিাক্ষা-দীক্ষা, কর্মক্ষেত্রে, চিকিৎসা সেবা থেকে তারা বঞ্চিত। এদের সংখ্যাও কম বলে বিভিন্ন বে-সরকারি সংগঠন মোটেই তাদের নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না। বাংলাদেশে এদের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। প্রকৃতির বিচিত্র কারণে হিজড়ারা বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। হিজড়াদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ৩ ধরনের হয়ে থাকে। ১. নারীদের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও নারী যৌনাঙ্গ থাকে না, ২. পুরুষের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও পুরুষাঙ্গ থাকে না এবং ৩. উভয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান । তবে ওরা কর্মম হয়েও বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজের এক অবহেলিত জনগোষ্ঠী। কুসংস্কারবশত সামাজিকভাবে তাদেরকে কোন কাজকর্মে নিয়োগ করা হয় না ও সবসময় এড়িয়ে চলার প্রবণতা লক্ষণীয়। যার কারণে হিজড়ারা সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সকলে মিলে সংঘবদ্ধ থাকতে ভালো বাসে এবং জীবিকার সন্ধানে ভব ঘুরে। যুগ যুগ ধরে হিজড়া জনগোষ্ঠীরা নিজের ঘর বাড়ি ছেড়ে দেশের আনাচে কানাচে একসাথে কয়েকজন বসবাস করে থাকে।

বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠী পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে শহরে এলাকা সমূহে চলে আসে জীবিকা নির্বাহের তাগীদে। শহরের রাজপথে হাত পেতে ২/১ টাকা চেয়ে অন্য হিজড়াদের মত জীবিকা নির্বাহ করে। সারাদিন সে যা আয় করে, তার একটা ভাগ হিজড়াদের সর্দারকে দিতে হয়। হিজড়াদের শাসন পদ্ধতি ভিন্ন প্রকৃতির। হিজড়াদের প্রতিটি এলাকায় একজন সর্দার থাকে। তারাই নিয়ন্ত্রণ করে হিজড়াদের। সর্দারের আদেশ ব্যতীত কোন দোকানে কিংবা কারো কাছে হাত পেতে টাকা চাইতে পারবে না। সর্দারই গ্রুপ করে টাকা তোলার এলাকা ভাগ করে দেয়। ৫/৬ জনের একটি করে গ্রুপ থাকে। প্রতিটি সর্দারের অধীনে এরকম ৮ থেকে ১০টি গ্রুপ থাকে। প্রতিদিন সকালে সর্দারের সঙ্গে দেখা করে দিক-নির্দেশনা শুনে প্রতিটি গ্র"প টাকা তোলার জন্য বের হয়ে পড়ে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত যে টাকা তোলা হয়, প্রতিটি দলই ওই টাকা সর্দারকে জমা দেয়। সর্দার তার ভাগ নেয়ার পর দলের সদস্যরা বাকি টাকা ভাগ করে নেয়। প্রতি সপ্তাহে হিজড়াদের সালিশী বৈঠক হয়। ১৫ থেকে ২০ সদস্যের সালিশী বৈঠকে সর্দারের নির্দেশ অমান্যকারী হিজড়াদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হয়। বেত্রাঘাতসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতন এবং কয়েক সপ্তাহের জন্য টাকা তোলার কাজ বন্ধ করে দেয়ার মত শাস্তি প্রদান করা হয়। জরিমানা পর্যন্ত করা হয়ে থাকে। দণ্ডিত হিজড়াকে তার নির্ধারিত এলাকা থেকে তুলে এই টাকা পরিশোধ করতে হয়। হিজড়ারা সর্দারের শালিসকে মাথা পেতে গ্রহণ করে। কারণ, সর্দারকে অনেক সময় মা বলে সম্বোধন করে থাকে। সর্দারের সাথে অসৈজন্যমূলক আচরণ করে না। সবসময় সম্মান করে থাকে।

ইসলাম ধর্ম মতে, তাদের পিছনে নামায পড়া হারাম নয়। তবে মাকরুহ তথা অপছন্দনীয়। হিন্দু ধর্মের মতে, হিজড়া প্রতিবন্ধীরা সকলের পে মন্দিরে পৌরহিত্য করতে পারবে না। তবে মন্দিরে পুজো অর্চনা করতে পারবে বলে 'শ্রী গৌড়বাণী' ম্যাগাজিনের সম্পাদক এ্যাডঃ শ্যাম কিশোর দেবনাথ জানান। হিজড়ারা হচ্ছে এক ধরনের প্রতিবন্ধী। এরা শারীরিক দিক দিয়ে একেবারে পিছিয়ে। সমাজে বেঁচে থাকার অধিকার তাদের রয়েছে। এদের প্রতিবন্ধী হিসেবে সরকারকে স্বীকৃত দেয়া উচিত।

হিজড়ারা বিধাতার অভিশাপ নয়। হিজড়া কেউ ইচ্ছে করে হয় না। এটা শারীরিক সমস্যা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি জন্মগত সমস্যা। যে কোন শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই এই শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। অধিকাংশ  দরিদ্র ও অশিক্ষিত পরিবারেই হিজড়া সন্তানে জন্ম বেশি হয়। তবে উচ্চবিত্ত পরিবারেও যে হিজড়া সন্তানের জন্ম হয় না, তা নয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা হলে সুস্থ করা সম্ভব । তবে চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যয়বহুল । বাংলাদেশে সংবিধানে সকল শ্রেণির নাগরিকের অধিকার রয়েছে। কিন্তু হিজড়ারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেক হিজড়া ভোটার হয়ে প্রথমবারের মত তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। হিজড়াদের পুনর্বাসনের জন্য কিছু বেসরকারি সংগঠন উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সরকারিভাবে তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নি বললেই চলে। অথচ ভারতের হিজড়াদের গুরুত্ব দেওয়া হয়। বেশকিছুদিন আগে ভারতে একটি কলেজের অধ্যক্ষ পদে হিজড়াকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত জনেগো্ষ্ঠির মতে তাদের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা জরুরী। যারা শিক্ষিত নয়, তাদের বৃত্তিমূলক প্রশিণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পরিশেষে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, হিজড়া জনগোষ্ঠীদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন করা অসম্ভব। তাই ওদের উন্নয়নে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও সরকারিভাবে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। নাহলে ওরা যুগ যুগ ধরে অবহেলিত থাকবে। আসুন এই বিষয়ে আমরা তাদের উন্নয়নে কিছু অবদান রাখার চেষ্টা করি।

লেখক-

আজমাল হোসেন মামুন
সহকারী শিক্ষক, হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ।

(ব্লগার ও সিটিজেন জার্নালিস্ট ঢাকা শহরে থাকাবস্থায় হিজড়াদের সাথে কথা বলে লেখাটি লিখেছিলেন। আজ প্রকাশ করা হলো)।