১৫ অক্টোবর, সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস: সাদাছড়ি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিরাপত্তার প্রতীক

আজমাল হোসেন মামুন
Published : 15 Oct 2015, 05:26 PM
Updated : 15 Oct 2015, 05:26 PM

সাদাছড়ি হচ্ছে একটি লাঠি, যা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের (অন্ধ) নিরাপত্তার প্রতীক। কারণ এটি প্রয়োজনীয় চলাচল গাইড, সহায়ক ও নিরাপত্তা উপকরণ হিসেবে বিশ্বব্যাপী ব্যবহƒত হয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার জন্য প্রায় একশ বছর ধরে এ সাদাছড়ি ব্যবহার করে আসছে। ১৯৫৯ সালের ৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অন্ধ সংস্থার উদ্যোগে প্রথম বিশ্ব অন্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তৎকালীন সিংহলে (বর্তমান শ্রীলংকা)। এ সম্মেলনে ১৫ অক্টোবরকে বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন শওকাত হোসেন ভূঁইয়া, অ্যাডভোকেট খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী, হাশমী ও মনসুর চৌধুরী নামের চারজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। এরও অনেকদিন পর ১৯৬৩ সালের ৬ জুলাই ন্যাশনাল ফেডারেশন অব দ্য ব্লাইন্ড-এর এক কনভেনশন থেকে প্রতিবছর ১৫ অক্টোবরকে সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য একইসঙ্গে ৫০টি রাষ্ট্রের কাছে আহ্বান জানানো হয়।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭৫ সালের ৯ ডিসেম্বর সাদাছড়ি নিরাপত্তা আইন অনুমোদন ও কার্যকর করার অনুকূলে প্রস্তাব পাস করে (প্রস্তাব নং ৩৪৪৭)। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) একই বছর তার ৬০তম অধিবেশনে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বৃত্তিমূলক পুনর্বাসন আইন অনুমোদন করে। এর পর থেকে সাদাছড়ির ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।

আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়। তারাও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান, ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং স্বাধীনভাবে চলাচলের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে সাদাছড়ি ব্যবহারের দ্বারা চলাচলের পথ সহজ হয়। কারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে সাদাছড়ি ব্যবহারকারীরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। পথের কোথায় উঁচু-নিচু, কোথায় বাঁক, কোথায় দরজা বা কোথায় দেয়াল, কোথায় গর্ত বা কোথায় পানি, কোথায় পাথর বা হোঁচট খাওয়ার ভয় আছে- এসব বুঝতে সাহায্য করে সাদাছড়ি। এটি যে কোনো স্থানে ও পরিবেশে সহজে বহন করা সম্ভব।

সাদাছড়ি শুধু দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ব্যবহারযোগ্য। কেউ এটি ব্যবহার করলে অন্য মানুষ সহজেই বুঝতে পারে সে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে রাস্তা পারাপারের সময় সহযোগিতার জন্য সর্বস্তরের মানুষ স্বউদ্যোগে এগিয়ে আসে। শুধু তাই নয়, সাদাছড়ি ছাড়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের একা চলাফেরা করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। সাদাছড়ি ব্যবহার করলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহযোগী হিসেবে আরেকজন লোকের প্রয়োজন হয় না। এতে একজন সহযোগী ব্যক্তির শ্রম, সময়, অর্থ বাঁচে। তাই সাদাছড়ির গুরুত্ব অপরিসীম।

সাদাছড়ির তেমন কোনো বাধাধরা ধরন বা মাপ নেই। প্রয়োজন অনুযায়ী সাদাছড়ির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সাধারণভাবে পায়ের পাতা থেকে ব্যক্তির বুকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ধরা হয়। তবে দ্রুত পথ চলতে হলে একটু লম্বা মাপের ছড়ি ব্যবহার করা সুবিধাজনক। বহনের সুবিধার্থে কাঠের ছড়ির পাশাপাশি বিভিন্ন হালকা উপকরণ যেমন অ্যালুমিনিয়াম বা প্লাস্টিক ধরনের সামগ্রী দিয়ে তৈরি সাদাছড়ির ব্যবহার বাড়ছে। আজকাল ভাঁজ করা সাদাছড়িও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি সাদাছড়ির ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, যাকে বলা হয় ভার্চুয়াল সাদাছড়ি। টেকনিক্যাল নাম লেজার বেইজড রেঞ্জ সেন্সিং ডিভাইস। এতে একটি ক্যামেরা, লেজার টর্চ ও মাইক্রো প্রসেসর ব্যবহার করা হয়েছে। এটি ছোট্ট, অনায়াসে পকেটে রাখা যায়। হাতের মুঠোতে রেখেই এটি দিয়ে পথের উঁচু-নিচু, দূরত্ব, বাধা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এবং বড় সাদাছড়ির প্রায় সব প্রয়োজনই মেটানো যায় এর মাধ্যমে।
দেশে প্রায় ৪৮ লাখ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রয়েছে। তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে- স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে না পারা। তাদের প্রতি মানবিক দৃষ্টি নিয়ে রাস্তা পারাপারে সহযোগিতা করা উচিত। বাংলাদেশ ট্রাফিক আইন মোতাবেক কোনো অবস্থায় অনির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি থামানো না গেলেও রাস্তা পারাপারের সময় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে সংশোধনী আনা প্রয়োজন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা সাদাছড়ি উত্তোলন করলে ট্রাফিককে লাল সিগন্যাল দিতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রাস্তা পার না হবে, ততক্ষণ যানবাহন বন্ধ রাখতে হবে। দেশব্যাপী দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মাঝে সাদাছড়ি ব্যবহারের প্রচলন ঘটাতে হবে। এছাড়া দেশে সাদাছড়ি আইন অনুমোদন করতে হবে।