শ্রদ্ধাঞ্জলি: মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কবি ও ছড়াকার সৈয়দ নাজাত হোসেন

আজমাল হোসেন মামুন
Published : 13 Dec 2015, 05:16 PM
Updated : 13 Dec 2015, 05:16 PM

বিশিষ্ট সাংবাদিক , গীতিকার, নাট্যকার, কবি ও ছড়াকার সৈয়দ নাজাত হোসেন গত ৭ ডিসেম্বর বেলা ২ টায় ধানম-িস্থ ফারাবি জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। সৈয়দ নাজাত হোসেন লিভার সিরোশিসে আক্রান্ত হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ২৮ অক্টোবর ভারতের কলকাতায় যান। গত কয়েকদিন আগে তিনি দেশে ফিরে আসেন। গত ৩ দিন ধরে খুব গুরুতর অসুস্থ্য থাকাবস্থায় অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারি সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব সৈয়দ নাজাত হোসেন।
সৈয়দ নাজাত হোসেন প্রায় ৪০ বছর ধরে সাংবাদিকতা করলেও মূলত তিনি একজন ছড়াকার। ৭০ দশকে যারা ছড়া লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁরমধ্যে তিনিও একজন। একাধারে তিনি একজন নাট্যকার, গীতিকার ও পা-ুলিপি রচয়িতা। ৮০ দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে তাঁর প্রচুর এ সপ্তাহের নাটক ও গান প্রচারিত হয়েছে। তিনি একজন সফল মঞ্চ অভিনেতাও। ঢাকার বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মঞ্চ ও ব্রিটিশ কাউন্সিল মঞ্চে অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। 'বৃত্তের বাইরে'সহ একাধিক চলচ্চিত্রেও তিনি অভিনয় করেছেন। এছাড়াও জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন 'কিশোর কুঁড়ির মেলা'র সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৮ সালে দেশের সেরা ৭ সাংবাদিকের একজন হিসেবে তিনি সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি'র কাছ থেকেও পুরস্কৃত হয়েছেন। গত ৯ অক্টোবর তিনি শিশু সাহিত্য বিষয়ক ক্যাটাগরিতে 'হাত ঝুম ঝুম পা ঝুম' ছড়াগ্রন্থটির জন্য এম নূরুল কাদের শিশু সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন।
৭০ দশকে তাঁর প্রচুর ছড়া ও কবিতা দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও তাঁর মা'র অসাবধানতা ও একটি বিশেষ দুর্ঘটনায় প্রকাশিত তাঁর সব লেখা হারিয়ে যাওয়ায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ২০১৪ সালে বিষয়টি জানার পর দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর সমসাময়িক ছড়াকার বন্ধুরা একটি একটি করে, কেউবা ৪/৫টি করে ছড়া-কবিতা সরবরাহ করায় ২০১৪ সালের একুশে বই মেলায় তাঁর প্রথম প্রকাশিত হয় 'হাত ঝুমঝুম-পা ঝুমঝুম' ছড়াগ্রন্থ।
সৈয়দ নাজাত হোসেন জন্মসূত্রে জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলাধীন কানুপুর গ্রামের অধিবাসী হলেও ১৯৮৯ সালে প্রথম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার প্রথম সংবাদপত্র 'সাপ্তাহিক নবাবগঞ্জ বার্তা' ও পরবর্তীতে 'দৈনিক নবাব' সম্পাদনা করেন। যা প্রায় ২২ বছর নিয়মিত প্রকাশিত হয়। চ্যানেল আই ও মাছরাঙা টেলিভিশনেও তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেন।
সৈয়দ নাজাত হোসেনের বাবা মরহুম সৈয়দ হামিদুর রশিদ পুলিশ বিভাগে চাকরি করলেও তিনি রাজশাহী বেতারের জন্মলগ্ন থেকে পল্লীগীতির একজন নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। মা মরহুমা সালেহা বেগম ছিলেন একজন নিটল গৃহিনী। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে কণ্ঠশিল্পী দিলরুবা খান সৈয়দ নাজাত হোসেনের একমাত্র বোন।

১৯৮৫ সালে বাবা-মা'র পছন্দে সৈয়দ নাজাত হোসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিয়ে করেন। ৪ ছেলে দিগন্ত, আইন বিষয়ে পড়াশুনা শেষ করেছে। মেজ ও সেজ ছেলে অনন্ত ও প্রান্ত সিএসসি ও আইটিতে পড়াশুনা করছে। সবছোট ছেলে দুরন্ত এবার জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।

তিনি অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করেননি। সাংবাদিকতা জীবনে বিভিন্ন হুমকি ধামকি সহ্য করেছেন। এমনকি একাধিক মামলা মোকাদ্দমা দিয়েও তাকে ঘায়েল করতে গিয়ে প্রতিপক্ষ গোষ্ঠি ব্যর্থ হয়েছে। সৈয়দ নাজাত হোসেনের সাথে আমার পরিচয় ২০০০ সালের দিকে। আমি তখন তাঁর সম্পাদিত একমাত্র জেলার দৈনিক পত্রিকা দৈনিক নবাব নামক স্থানীয় পত্রিকায় শিবগঞ্জ সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করি। পরবর্তীতে তাঁর কাছ থেকে শিখেছি প্রতিবেদন লেখার নিয়ম। শিখেছি অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা। বিপদে ধৈর্য্য ধারণ করা। তিনি আমার সাংবাদিকতার গুরু। ফলে তাঁর উৎসাহে আমি দেশের প্রথম শ্রেণির দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক আজকের কাগজ, দৈনিক আমার দেশ, দৈনিক জনতা, দৈনিক ডেসটিনি, দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ও ডেইলি ইনডিপেনডেন্টসহ বিভিন্ন দৈনিকে নারী ও শিশু, প্রতিবন্ধিতাসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে প্রায় আড়াই শত ফিচার লিখেছি। এখনও মাঝে মধ্যে লিখে থাকি। ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার আগের দিন আমি তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছি। কথাও হয়েছে। তিনি আমাকে আত্মজীবনীমূলক একটি পান্ডুলিপিও দিয়েছেন পেন ড্রাইভে। ভারত থেকে ফেরার পরও ফোনে কথা হয়েছে। তিনি শুধু বলেছেন, আমার জন্য তোমরা দোয়া কর। এরই মধ্যে গত ৬ ডিসেম্বর দুপুর ১টার দিকে গাজী টিভির চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি ইমতিয়ার ফেরদৌস সুইটের কাছে শুনলাম আমার সাংবাদিকতা জীবনের গুরু সৈয়দ নাজাত হোসেন গুরুতর অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকা গেছেন। আমি তাঁর আত্মীয়ের কাছ থেকে খোঁজ-খবর নিয়েছি। হঠাৎ ৭ ডিসেম্বর বেলা ২টার দিকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খবর এলো আমাদের সবার প্রিয় সৈয়দ নাজাত হোসেন আর নেই। মৃত্যুর সংবাদ শুনার পর মনে হলো আকাশ যেন আমার মাথার ওপর ভেঙ্গে পড়লো। আমাদেরকে তাঁর অনেককিছু দেওয়ার ছিলো। কিন্তু তার আয়ু শেষ হওয়ায় সৃষ্টিকর্তা তাঁকে নিয়ে নিলেন। পরিশেষে বলতে চাই, সৈয়দ নাজাত হোসেন ভাই! আপনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও আপনার কর্ম ও সৃষ্টিশীল লেখনি আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আমরা যুগ যুগ ধরে আপনাকে স্মরণ করবো। কারণ, আপনার কাছ থেকে অসংখ্য সাংবাদিক হাতে খড়ি নিয়ে দেশের জনপ্রিয় প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সুনামের সাথে সাংবাদিকতা করছে। আপনাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জান্নাতবাসী করুন। আমীন।

লেখক
আজমাল হোসেন মামুন
শিক্ষক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
মোবাইল নং-০১৭০৪২৪৪০৮৯