বনদেবী চাকমা (৪৯) একজন উপজাতি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী। চোখে কালো চশমা না দিলে হয়ত: অপরিচিত মানুষ বুঝতে পারবে না যে বনদেবী চাকমা জন্ম থেকে দুনিয়ার আলো ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে নি। তবে সে দুনিয়ার আলো না দেখলেও হৃদয়ের আলোতে আলোকিত। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার সদর উপজেলার পৌর এলাকার দক্ষিণ কালিন্দীপুর গ্রামে টিনের ঘরে ভাই ও বোনদের সাথে বসবাস করে।
তার ও পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, বনদেবীর বয়স যখন ৫ বছর, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শরীরে পানি শূন্যতা দেখা দেয়। এতে আস্তে আস্তে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। হঠাৎ সম্পূর্ণ দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে প্রতিবিন্ধিতার শিকার হন। পরবর্তীতে বহু চিকিৎসার পরও দৃষ্টি শক্তি ফিরানো সম্ভব হয়নি। তখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাব্যবস্থা না থাকায় লেখা-পড়া করা সম্ভব হয় নি। ফলে বাড়িতে বসে জীবনের প্রায় ৫০ বছর অতিবাহিত করে। ১৯৯১ সালে বাবা রমনী মহন চাকমা মারা গেলে ভাইদের তত্ত্বাবধানে চলতে হয় তাকে।
সেই বেশি দিনের কথা নয়, ২০০৫ সালে তার মাথায় চিন্তা আসে কিছু করার। ফলে মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে গিয়ে মনে হয় যে, মাজন তৈরি করা খুব কঠিন কাজ নয়। বাজারের সবচেয়ে বেশি দামী ও ভালো মাজন কিনে বোতলে লাগানো লিফলেটে মাজন তৈরির উপকরণগুলো ভাতিজার মাধ্যমে শুনে। মাজন তৈরির উপকরণ বাজার থেকে কিনে নিজেই প্রাথমিকভাবে ২০০৫ সালে দাঁতের মাজন তৈরি করা আরম্ভ করে। বর্তমানে মাসিক ১ হাজার পিস মাজন তৈরি করে থাকে। মাজনের বোতল ১২০ টাকা দরে প্রতি গ্রস রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা শহর থেকে ক্রয় করে। বনদেবী তৈরিকৃত দাঁতের মাজন ঢাকা ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বিভিন্ন এলাকার মুদি দোকান গুলোতে পাইকারী দামে সাপ¬াই দিয়ে থাকে। যাবতীয় সামগ্রী ক্রয়ে সহযোগিতা করে ছোট ভাই।
২০০৫ ইং সাল থেকে সে উন্নয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তৃণমূল সংগঠনের সভাপতি, প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন কমিটির সদস্য ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পিএসআইডি সেন্টারের সাধারণ পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। সে 'উন্নয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্ব-উদ্যোগ (পিএসআইডি)' এপ্রোচের অনুকুলে স্ব-আস্থা জাগরণ' নারী-পুরুষ সমতায়ন, উন্নয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তৃণমূল সংগঠন উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি(বিপিকেএস) নামক একটি বে-সরকারি সংগঠনের নিকট থেকে। এতে তার আত্ম বিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে। বনদেবী চাকমা রান্না-বান্না থেকে শুরু করে নিজের যাবতীয় কাজ-কর্ম সে নিজেই করতে পারে।
এছাড়াও সে মোমবাতি তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছে। সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে বা অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পেলে ভবিষ্যতে একটি মোমবাতি তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করবে বলে জানান।
ইতোপূর্বে সে ২০০৬ সালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে ১৫ হাজার টাকা ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পিএসআইডি সেন্টার থেকে ৩ হাজার ঋণ নিয়েছে। বিদায়কালে সে জানাল, মুই কান প্রতিবন্ধী অলেও কারেরি (বুঝা নয়) গাই-গাই মাজন বানে গাই-গাই খানা খেইবার মুয়ার গড়ং।'' অর্থাঃ আমি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হলেও কারো বোঝা নয়। নিজে মাজন তৈরি করে বিক্রি করে নিজের খাবার যোগাড় করি। ভবিষ্যতে মাশরুমের ওপর প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী।
(ফটোগ্রাফি: আজমাল হোসেন মামুন)