ক্ষীণদৃষ্টি প্রতিবন্ধীর ভাবনা: একদিকে প্রতিবন্ধী নারী, অন্যদিকে বস্তির মেয়ে

আজমাল হোসেন মামুন
Published : 10 August 2011, 08:20 AM
Updated : 10 August 2011, 08:20 AM

ঢাকা শহরের বস্তিতে রয়েছে প্রায় দেড় লাখ প্রতিবন্ধী নারী। এরা ভিক্ষা করে, কেউ পরের বাড়ী কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এদের নিয়ে কেউ ভাবে না। বিশেষ করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীরা খুবই অবহেলিত। তারা মাসিক ভাড়া দিয়ে বসবাস করে। অধিকাংশই অবিবাহিত। আবার অনেকে তালাক প্রাপ্তা। সকালে ঘুম থেকে উঠে কেউ একা, আবার দলবদ্ধভাবে ভিক্ষার ঝুলি ঘাড়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দিগ্বিদিক। দলবদ্ধভাবে গাইতে থাকে তাদের রচিত শে¬াক '' আমরা অন্ধ, কপাল মন্দ……………………………''। নিম্নে শুনা যাক এসব কয়েকজন বস্তির প্রতিবন্ধী নারীদের মনের কথা:

কেস স্টাডি-১: হুসনেআরা বেগম (৩৫)। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে অন্ধ। দেশের বাড়ী বরিশাল জেলায়। চার'শ মাসিক ভাড়া দিয়ে মিরপুর ১১ নং লালমাটি বস্তীতে থাকে। কেন ভিক্ষা করছে এ ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন- আমরা এক দিকে গরিব মানুষ অন্যদিক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। বরিশালে কোন ঘর-বাড়ি নেই। চোখে দেখিনা কি কাজ করমু। বাজারে নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম অনেক। ভিক্ষা ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই। সবকিছুর দাম বেশি হওয়ায় ভিক্ষার আয়ও কমে গেছে। গত বছর জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সমিতি (এনডিডিএস) নামক সংগঠনের সহযোগিতায় সরকারি ভাতা বাবদ দু'জনে পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছি। তাতে কি বছর যাবে।

কেস স্টাডি-২: মালেহা বেগম (৪০) ক্ষীণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী। এক সন্তান জন্ম হওয়ার পর স্বামী প্রায় ১০ বছর পূর্বে মারা গেছে। তিনি মিরপুর ১০ নং প্যারিসরোড বস্তীতে মাসিক পাঁচ'শ টাকায় ভাড়া থাকে। সাথে রয়েছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মা ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাই। দ্বারে-দ্বারে ভিক্ষা না করে হেঁটে হেঁটে চা, রুটি, বিস্কুট ও কলা বিক্রি করে মালেহা। তিনি জানান- চা বিক্রি করে এক থেকে দেড়শ টাকা আয় হয়। বাজারে নিত্য দরকারী জিনিসের দাম অনেক। ক্যমনে বাঁচমু বলেন স্যার! আমাদের দিকে কেউ নজর দেয় না।

কেস স্টাডি-৩: উম্মে কুলসুম (৪২) একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী থাকত ভাসানটেক ৩ নং বস্তিতে। মুন্সিগঞ্জের পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে সহায় সম্বল হারিয়ে জীবিকার তাগিদে ঢাকা শহরে এসেছে। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে এক বছর পূর্বে জায়গা নিয়েছিলো স্থানীয় এক কথিত বিএনপির নেতার নিকট। টিন দিয়ে ঘর বানিয়েছিল বহু কষ্টে। তাছাড়াও তত্তাবধায়ক সরকার ক্ষমতা ক্ষমতা গ্রহণের পর বস্তী উচ্ছেদ করে। ফলে বিপাকেও পড়তে হয়েছিলো তাদের। বর্তমানে তাকে এখন ৯ শ' টাকা মাসিক ভাড়া দিতে হয়। স্বামী নেই। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে নিয়ে সংসার। পরের বাসা বাড়িতে কাজ করে মা ও মেয়ে উভয়ে। কেমন আসেন জানতে চাওয়া হলে সে কান্নার স্বরে জানায়- ধনীর ধন আর মুরগিওয়ালার ডিম। বহু কষ্টে পাঁচ হাজার টাকা জোগাড় করে জায়গা পাবার পর ১৫ হাজার টাকা খরচ করে মাথার গুজার ঠাই করলাম। কপাল মন্দ বলে তাও চলে গেল। বাজার গেলে দাম শুইন্যা চমকে ওঠি। কেমনে বাঁচব।

কেস স্টাডি-৪: মরিয়ম বেগম (ছদ্মনাম) একজন বাক প্রতিবন্ধী নারী। পরের বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। লেখা পড়া কিছুই জানে না। ভাড়া থাকে কালশি বস্তিতে। হাতের ইশারায় জানালেন- মাত্র কয়েকশ টাকা তার মাসে জমা হয়। ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে সে শঙ্কিত। কারণ বৃদ্ধ বয়সে কে তার দেখা শোনা করবে।

বর্তমান সরকার বস্তী বাসীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেখানে প্রতিবন্ধী নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। কারণ তারা একদিকে প্রতিবন্ধী অন্যদিকে নারী। অথচ প্রতিবন্ধী নারীরা সবচেয়ে বঞ্চিত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ সনদসহ বহু আইন. দলীল এবং নীতিমালায় স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন-২০০১ এবং জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পদক্ষেপের মধ্যে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ভাতা প্রদান, প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তি প্রদান, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ ইত্যাদি। কিন্তু বস্তিতে অবস্থানকারী প্রতিবন্ধী নারীদের জীবন বৈষম্যের শেকলে বাধা। পায়নি নারী হিসেবে তাদের অধিকার। একদিকে নারী অন্যদিকে সমাজের অন্যান্য অপ্রতিবন্ধী পুরুষেরা বিয়ে করতে চায় না। যৌন নির্যাতনের ঘটনা তো ঘটেই। সেখানে বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে।

শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে রয়েছে বস্তির প্রতিবন্ধী নারীরা। বস্তিতে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নিরক্ষর নারীদের জন্য স্কুল পরিচালনা করলেও ঠাই মিলে না বস্তির প্রতিবন্ধী নারীদের। তাই সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিষয়টি মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করা উচিত।

বিশেষজ্ঞদের মতামত: ন্যাশনাল এ্যালাইয়েন্স অব ডিজএ্যাবল্ড পিপলস্ অর্গানাইজেশন (ন্যাডপো)-এর সভাপতি এবং ডিজএ্যাবল্ড পিপলস্ ইন্টারন্যাশনাল (ডিপিআই)-এর গ্লোবাল সেক্রেটারী আবদুস সাত্তার দুলাল জানান, সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিবন্ধী নারীরা সবচে অবহেলিত। তবে বস্তীর প্রতিবন্ধী নারীরা আরো অবহেলিত। এরা অপুষ্টির শিকার। এদের পুনর্বাসন করা দেশের সরকারের দায়িত্ব।