ভাষা আন্দোলনের সময় নিয়ে রফিকুল ইসলামের সাক্ষাৎকার

বেবী মওদুদ
Published : 21 Feb 2011, 07:09 AM
Updated : 21 Feb 2011, 07:09 AM

[শিক্ষাবিদ ভাষাসৈনিক ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ১৯৫২ সালে কাছ থেকে ভাষা আন্দোলন দেখেছেন। ভাষা আন্দোলনের ছবি তুলেছেন প্রচুর। এই সাক্ষাৎকারে তিনি সে সময়কার কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি দুটি পর্বে শেষ হবে। সাক্ষাৎকারের সঙ্গে পরে ভিডিও লিংক যোগ করা হবে।– বি. স.]


ছবি. মুস্তাফিজ মামুন ২০১০

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: বেবী মওদুদ

বেবী মওদুদ: স্যার কেমন আছেন?

রফিকুল ইসলাম: ভালো।

বেবী মওদুদ: আপনার তো দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা। ভাষা আন্দোলন দেখেছেন, গণ আন্দোলন দেখেছেন, তার পরে ছয়দফা আন্দোলন। আপনি তো মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ঢাকায় ছিলেন এবং বোধহয় আপনাকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী জেলেও নিয়ে গেছে।

রফিকুল ইসলাম: হুমম, বন্দি ছিলাম।

বেবী মওদুদ: বন্দি ছিলেন। তো স্যার, আপনার কাছে আমরা আজ ভাষা আন্দোলনের কথা শুনবো যে আপনি ওই সময় কী দেখেছেন?

রফিকুল ইসলাম: আমি ১৯৪৩ সাল থেকে রমনায় ছিলাম। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই ছিলাম বলা যেতে পারে। সুতরাং তখন থেকে শুরু করে বিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জীবন কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এর মধ্যে যা ঘটেছে প্রায় সবই দেখেছি। ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারটা হলো '৪৮ সালে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয় তখন সে আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ফজলুল হক হল। তো '৪৮ সালের ১১ই মার্চ তোমার রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হলো, সেটা আমি দেখেছি। এই রাষ্ট্রভাষা দিবসের একটু পটভূমিকা বলা দরকার। '৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট পাকিস্তান হলো। '৪৮সালের ফ্রেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিকে করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান একটা প্রস্তাব আনলেন যে পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি এবং উর্দু ভাষা ব্যবহার করা যাবে। তখন কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তিনি প্রস্তাব আনলেন যে এর সঙ্গে বাংলাও যুক্ত করা হোক। কিন্তু এই বাংলার প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যাত হলো। যার ফলে এই খবর যখন এলো ঢাকায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু…

বেবী মওদুদ: প্রতিবাদ হয়, প্রতিবাদ হয় একটা।

রফিকুল ইসলাম: হ্যাঁ, প্রতিবাদ হয় এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন প্রথম পর্যায়টা শুরু হয়ে যায়। শুরু হয়ে যায়, ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস রূপে ঘোষিত হয় এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় (মানে পুরাতন কলাভবনে) সভার পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ফজলুল হক হলের মধ্য দিয়ে, কার্জন হলের মধ্য দিয়ে। তারপর এদিকে বর্তমান হাউজ– তখনকার চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবন ছিল। এখানে ছাত্ররা ঘেরাও করে। পুরানো হাইকোর্ট ভবন ঐটাও ঘেরাও করে। এখানে আশেপাশে মন্ত্রীদের বাড়িগুলোও ঘেরাও করে আর সচিবালয় ঘেরাও করে। এই প্রথম কিন্তু সচিবালয় ঘেড়াও হয়।

বেবী মওদুদ: প্রথম ১৯৪৮ সালে ঘেরাওটা কারা করেছিল এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা ছিল কি এর মধ্যে?

রফিকুল ইসলাম: তখন তো রাজনৈতিক দল বলতে মুসলিম লীগ। আওয়ামী লীগ তখনও গঠিত হয় নাই। ছাত্রলীগ গঠিত হয়েছে '৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের পরে। কিন্তু '৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের পর পর যারা ছাত্রলীগ গঠন করেছিলেন যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নাইমুদ্দিন আহমেদ, শওকত আলী, আজীজ আহমেদ–আরো অনেকে বিভিন্ন জেলা থেকে একজন একজন করে–তারা সবাই ঐ সচিবালয়ের সামনে পিকেটিং করছিলেন। তখন কিন্তু সচিবালয়ের চার দিকে এরকম দেয়াল ছিল না।

বেবী মওদুদ: ফাঁকা ছিল।

রফিকুল ইসলাম: ফাঁকা ছিল। মাঝখানে ইডেন বিল্ডিং আর কিছু টিনসেড তৈরি করা হয়েছিল।

বেবী মওদুদ: সেকেন্ড গেট যেটাকে বলা হতো।

রফিকুল ইসলাম: ওখান থেকেও ঢুকতো এবং ফার্স্ট গেট দিয়ে ঢুকতো। এই অঞ্চলটা ছাত্ররা ঘেরাও করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মূলত ছিল। সেখানে তাদের উপরে প্রচন্ড রকম লাঠি চার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়।

বেবী মওদুদ: গ্রেপ্তারও হয়।

রফিকুল ইসলাম: অসংখ্য গ্রেপ্তার হয়। এই দৃশ্যটা দূর থেকে আমি দেখি। আমি তো স্কুলের ছাত্র ছিলাম এবং যেহেতু আমার বাসা রেল কলোনিতে ছিল।

বেবী মওদুদ: আপনি এসে এখানে দেখে ছিলেন।

রফিকুল ইসলাম: হ্যাঁ আমরা দেখেছি যে ছাত্ররা কী করছে। এটা প্রচণ্ড রকম একটা কৌতূহল ছিল এবং আমি বঙ্গবন্ধুকে প্রথম ওখানেই দেখি।

বেবী মওদুদ: আপনি তখন কোথায় পড়তেন স্যার?

রফিকুল ইসলাম: আমি পড়তাম সেন্টগ্রেগরী স্কুলে। বঙ্গবন্ধুকে আমি প্রথম ওখানে দেখি। প্রথম দেখি যে প্রবেশ পথে ওরা মাটিতে শুয়ে বাধা দিচ্ছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম শুয়ে পড়তে। তখন আর একটা দৃশ্য দেখেছিলাম যে উনি একজন আহতকে রিক্সা করে মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাচ্ছেন। এই দুটো দৃশ্য আমি দেখেছিলাম এবং শুনেছিলাম নাম শেখ মুজিব। এই পর্যন্তই। এই তো গেল '৪৮ সালে।

বেবী মওদুদ: কিন্তু '৪৯ সালেও এই দিবস পালিত হয়েছে।

রফিকুল ইসলাম: আমি বলছি, তারপর তো জিন্না সাহেব এলেন। ১৯ থেকে ২১ মার্চের মধ্যে উনি রমনা রেসকোর্সে এবং পরে কার্জন হলে সংবর্ধনা উৎসবে ভাষণ দিলেন। দুই জায়গাতেই প্রতিবাদ হয়েছে। উর্দু শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাংগুয়েজ অব পাকিস্তান এবং যারা এটার বিরোধিতা করে তারা রাষ্ট্রের দুশমন। এ কথাগুলো উনি বলেছিলেন। রমনা রেসকোর্সের এত বিশাল মাঠ। মাইক্রোফোনের ব্যবহার ছিল অপ্রতুল। হৈ চৈ হওয়ায় জিন্না সাহেবের কথাও কিছু বোঝা যাচ্ছিল না।

বেবী মওদুদ: সভা ভেঙে গেল?

রফিকুল ইসলাম: না সভা ভেঙে যায় নাই, সভা শেষ হয়েছে। উনি ওনার বক্তৃতায় যখন রাষ্ট্রভাষার কথা বলেছিলেন তখন ছাত্ররা 'নো' 'নো' ধ্বনি দিয়ে তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু কার্জন হলে যেটা হলো, তখনকার দিনে কিন্তু সিকিউরিটি এ রকম ছিল না। কার্জন হলে তো নিচতলায় সভা হতো। আমরা ওপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।

বেবী মওদুদ: আপনি ঢুকতে পেরেছিলেন?

রফিকুল ইসলাম: ভেতরে তো এদিক দিয়ে ঢুকিনি, অন্য রাস্তা দিয়ে ঢুকেছি। দোতলা, তিনতলা যে রেলিংগুলো ছিল ওখান থেকে। ওখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্ররাও ছিল। নিচে ছিল সমবেত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা আর দর্শকরা ছিল দোতলায় আর তিন তলায়। জিন্নাহ্ সাহেব যখন ইংরেজি ভাষায় তার উর্দু ভাষা সম্পর্কে বক্তব্য দিলেন যে, উর্দু শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গোয়েজ অব পাকিস্তান। এবং যারা এটার বিরোধিতা করে তারা ভারতের চর–ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন কার্জন হলে সম্বর্ধনা উৎসবে 'নো' 'নো' বলাটাই যথেষ্ট ছিল। এই নয় যে এখান থেকে তারা উঠে চলে আসতে পেরেছিল, কিন্তু প্রতিবাদটা ছিল। এটা গেল '৪৮ সাল ও তারপরে আর একটা জিনিস হলো সেটাও '৪৮সালের ঘটনা। জিন্নাহ্ সাহেব আসবার আগে ছাত্ররা যাতে আন্দোলন থামায় সেই জন্য খাজা নাজিমউদ্দিন রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সঙ্গে একটা ৯ দফা না ১১ দফা চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেছিলেন যে, পূর্ববাংলা আইন সভায় সুপারিশ করা হবে পাকিস্তান গণপরিষদের কাছে যাতে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয়। কিন্তু জিন্নাহ্ সাহেবের এই ঘোষণায় ঐ চুক্তিটা নাকচ হয়ে গেল, অর্থহীন হয়ে গেল। তবে ঐ চুক্তির ফলে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য ছাত্রনেতা যারা বন্দি হয়েছিল তাদের মুক্তি দেয়া হলো। মুক্তি পেয়েই বঙ্গবন্ধু করলেন কী বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ আছে না, ওখানে একটা পুকুর ছিল–এই পুকুর পারে তিনি একটা ছাত্রসভা করলেন। আমার এখনও মনে আছে এবং তিনি বললেন এই চুক্তি যেটা হয়েছে এটা মানবো না। এটা আন্দোলন থামাবার জন্য। আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো। সভাশেষে ডিসিশান নিয়ে… জগন্নাথ হল মিলনায়তনে আইনসভার বৈঠক চলছিল এবং সেখানেও কিন্তু প্রচণ্ড লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস মেরে… এবং তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হলো। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় কিন্তু তিনি দু'বার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। একবার তো ১১ই মার্চ, এর পরে আর একবার।

বেবী মওদুদ: '৪৯ সালে মনে হয়।

রফিকুল ইসলাম: না ঐ সময়ই দু'বার তিনি গ্রেপ্তার হন। '৪৯ সালে যেটা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নকর্মচারীদের একটা আন্দোলন ছিল সেখানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের জরিমানা করা হয়। শেখ মুজিব জরিমানা দিতে অস্বীকার করেন ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বহিষ্কৃত এবং আবার গ্রেপ্তার হন। '৪৮/'৪৯ সালের মধ্যে তিনি কিন্তু তিন বার গ্রেপ্তার হয়েছেন। দু'বার ছাড়া পেয়েছেন। কিন্তু ৪৯ সালের গ্রেপ্তার হওয়ার পরে আর ছাড়া পাননি। একেবারে '৫২সালে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে গিয়ে ছাড়া পান।

বেবী মওদুদ: অনশন করছিলেন ঐ সময়।

রফিকুল ইসলাম:এটা হচ্ছে যে খাজা নাজিমউদ্দিন সাহেব প্রথম তো তিনি পূর্ববাংলার চিফ মিনিস্টার ছিলেন। জিন্নাহ্ সাহেব মারা যাওয়ার পর তিনি গভর্নর জেনারেল হলেন। তবে লিয়াকত আলী সাহেব নিহত হওয়ার পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ঢাকার পুরানা পল্টনে মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনের যে জনসভা হয়, সেখানে তিনি আবার ঘোষণা দিলেন যে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। যার ফলে ঐ ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি প্রথমে আমরা আমতলায় সভা করলাম। বঙ্গবন্ধু কিন্তু তখন জেলখানায়। সভা করলাম এবং সারা ঢাকার শহর আমরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে প্রদক্ষিণ করলাম।

বেবী মওদুদ: তখন তো আপনি কলেজে চলে এসেছেন।

রফিকুল ইসলাম: '৫২তে আমি ঢাকা ইউনিভারসিটির ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র এবং ঐ দিনই ৪ তারিখে ঘোষণা করা হলো যে ২১ তারিখে পূর্ববাংলার আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন হবে। ঐ দিন আমরা ২১ তারিখে রাষ্ট্রভাষা দিবসরূপে পালন করবো এবং ঐ আইনসভায় গিয়ে আমরা স্মারকলিপি দেব। আমাদের এই কর্মসূচিকে সফল করার জন্য ১০ কি ১১ই ফেব্রুয়ারি আমরা পতাকা দিবস পালন করলাম এবং আবার সমস্ত ঢাকা শহরে আমরা স্কুল, কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করলাম। বঙ্গবন্ধু ১৫ তারিখ থেকে অনশন করলেন জেলখানায়।

বেবী মওদুদ: না স্যার, আমার মনে হয় উনি হাসপাতালে যখন ছিলেন চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয় তখন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে দেখাও করেছেন। তার পরে সরকার তাকে আবার হাসপাতালে থেকে জেলে নিল। উনি যখন অনশন করলেন তখন ওনাকে ফরিদপুর জেলে পাঠিয়ে দেয়।

রফিকুল ইসলাম: যাতে ২১ তারিখে এখানে না থাকতে পারে।

বেবী আপা: তখন তো উনি অনশনে খুব কাহিল হয়ে গিয়েছিলেন।

রফিকুল ইসলাম: যাই হোক, তো '৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনটা মূলতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা করেছেন। কিন্তু '৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা যোগ দিয়েছেন। তখন সর্বস্তরের অংশগ্রহণ ছিল না। সর্বস্তরের ছিল ২১ ফেব্রুয়ারির গুলি চলার পর।

বেবী মওদুদ: ১৯৫২ সালে তো ঢাকার শহরের সব ছাত্র-ছাত্রীই ছিল।

রফিকুল ইসলাম: ছিল এবং নুরুল আমিন সরকার তখন ক্ষমতায়। তারা ২০শে ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা ১৪৪ ধারা জারি করলো। পর দিন থেকে অর্থাৎ একমাস পর্যন্ত কোনো সভা শোভাযাত্রা বিক্ষোভ কোনো কিছু করা যাবে না। আমরা কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুর রেস্টুরেন্টে বসে ঐ ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বললাম যে, আমরা ১৪৪ ধারা মানি না। আমরা তখনই একটা ছোট-খাটো শোভাযাত্রা করে ফেললাম এবং শুধু রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটা সমস্যা হলো ওরা সর্বদলীয় বৈঠক করে তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে রাজি হল না। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তখন তারা কী করতো কি না করতো ওইটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের '৫২ সালের ভাষা আন্দোলনটা কিন্তু শুরু হলো একেবারেই ছাত্র-ছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক নেতারা কি নিচ্ছেন বা নিচ্ছেন না এ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কারণ আমরা ডিসাইড করে ফেললাম যে পরদিন আমরা ভঙ্গ করবো এবং সারা রাত ঢাকা হলের একটা রুমে বসে আমরা নানা রকম ফেসটুন ব্যানার এগুলো তৈরি করলাম। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'রাজ বন্দীদের মুক্তি চাই', '১৪৪ ধারা মানি না' ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা সারা রাত জেগে তৈরি করলাম। সকাল থেকে বিভিন্ন স্কুল কলেজে গিয়ে যেহেতু ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে এবং কলা ভবনের প্রবেশের দ্বার বন্ধ তালা মারা… পেছনের দেয়াল টপকে টপকে ছেলে-মেয়েদের সবাইকে নিয়ে আসা হলো। আর ঢাকা ইউনিভার্সিটি আর মেডিকেল কলেজের মাঝখানে একটা ফেনসিং ছিল ঐটা আমরা তুলে ফেললাম। ফলে হলো কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পর্যন্ত অর্থাৎ জগন্নাথ হলের উল্টোদিক পর্যন্ত আমাদের যাতায়াত রাস্তা পুরোটা ব্লক–পুলিশ ইপিআর ইত্যাদি ইত্যাদি দ্বারা। কিন্তু এ দিকে ২১ তারিখ সকালে যখন আমাদের সভা শুরু হলো গাজীউল হক সাহেবের সভাপতিত্বে তখন ঐ কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ থেকে শামছুল হক (আওয়ামী মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারী ছিলেন) এবং তার সঙ্গে ছিল খন্দকার মোস্তাক (বঙ্গবন্ধুর খুনী) এই দুইজন ঐ মিটিং-এ এলেন। শামছুল হক বক্তৃতা করলেন যে, আমরা যেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করি এবং শান্তিপূর্ণভাবে যেন আন্দোলন চালিয়ে যাই। আমরা 'নো' 'নো' করে তাদের বের করে দিলাম মিটিং থেকে। দুজনই ওখান থেকে কলা ভবনের ভেতরে চলে গেল। ওখানে সিদ্ধান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০ জন ১০ জন করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হতে শুরু করলো। তার পর লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস ও গ্রেপ্তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে অনেক জনতা এসে গেছে। ওরা ঐদিক থেকে পুলিশের উপর ইট পাটকেল ছুড়ছে। তার মানে হচ্ছে একটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ পুরো এলাকাটা একদিকে ছাত্র-জনতা অন্যদিক পুলিশ আর ইপিআর।

বেবী মওদুদ: একদম মুখোমুখি?

রফিকুল ইসলাম: একদম মুখিমুখি সারাদিন ধরে যুদ্ধ চলছে। ওরা যে টিয়ার গ্যাস মারছে তখন কিন্তু বন্দুক দিয়ে মারতো না। আমরা ধরে ধরে এগুলো উল্টো ওদের ওপরে মারতাম। এগুলো সারা দিন চলছে। এর পরে কলা ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়লো। ওরা লাঠি চার্জ করছে, কাঁদানে গ্যাস মারছে, তারপর তোমার গ্রেপ্তারও করেছে।

বেবী মওদুদ: তো স্যার ঐ যে ১০জন ১০জন করে বের হচ্ছিল ঐ দৃশ্যগুলো তো আপনি দেখেছেন?

রফিকুল ইসলাম: দেখেছি মানে, আমি ছিলাম ছবি তোলার জন্য। তখন তো আর এখনকার মত মানুষের কাছে ক্যামেরা ছিল না। আমার কাছে একটা ক্যামেরা ছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল ক্যামেরায় মাত্র ৮টা ছবি একবারে তোলা যেত। তার পরে রোল চেঞ্জ করতে হতো। ফলে আমাকে একটা অন্ধকার জায়গায় যেতে হতো। তখন আমি ছবি নিচু থেকে তুললাম তারপর দেখলাম যে ১৪৪ দ্বারা ভঙ্গ করতে যাচ্ছে, তখন আমি করলাম কী কলাভবনটা দোতলা ছিল। কিন্তু ঐ দোতলার ছাদে যাবার কোনো সিঁড়ি ছিল না। একটা ফোকোট ছিল ঐটা দিয়ে ঠেলে আমার বন্ধুরা আমাকে উপরে তুলে দিল। আমি উপর থেকে কিছু ছবি তুললাম। খুব বেশি ছবি যে সেদিন তুলতে পেরেছিলাম তা নয়। কারণ যখন গুলি চলে তখন আমার ফিল্ম শেষ। ৮টা ও ৮টা ষোলটা ফিল্ম তোলা… ষোলটার বেশি ছবি তুলতে পারি নাই। যার ফলে গুলি চলার পরে প্রথম যে লাশটা মেডিকেল কলেজের ওয়ার্ডবয়রা এনে রাখলো, সেটা রফিকউদ্দিন আহমেদের লাশ। তার মাথা থেকে মগজ বের হয়ে আসছিল আর বুলেটের সেই ছবিটা আমি তুলতে পারি নাই। সেই ছবিটা আমানুল হক সাহেব তুলেছেন। কিন্তু ঐ লাশটা ওরা গুম করে ফেলে। আবুল বরকত যখন গুলি খায় ওকে আমরা ধরাধরি করে জরুরী বিভাগে নিয়ে এসেছিলাম। ও সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় নি। ও রাত্রে অপারেশন থিয়েটারে মারা গেছে এবং ও বলছিল যে পুরানা পল্টনে বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে খবর দেন। ওখানে আমার বোন আর ভগ্নিপতি থাকে। ও কিন্তু ঐ বাড়িতেই থাকতো। আমি কার একটা সাইকেল নিয়ে সেই বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে গিয়ে দেখি যে ওর ভগ্নিপতি নাই। সে অফিসে। ওর বোনের সঙ্গে আমি দেখা করে আমি বাড়িতে খবরটা দিলাম। খবরটা পেয়ে ওর ভগ্নিপতি এসেছিলেন এবং রাত্রে অপারেশন থিয়েটারে বরকত মারা যায়। এবং লাশটা ওরা পেয়েছে যার ফলে বরকতের কবরটা আছে। রফিকউদ্দিনের কবর এবং প্রথম দিন অন্যান্য যারা মারা গিয়েছিল কারো কবর নাই। সব লাশ গুম করে ফেলেছে। একটা রিক্সাওয়ালা মারা গিয়েছিল একটা কৃষক মারা গিয়েছিল। এদের লাশ পাওয়া যায় নি। তো '৫২ সালে এই দিনে একদিকে পুলিশ ই পি আর আর একদিকে ছাত্র-জনতা–এর মধ্যে সারা দিনই ছিলাম। এমন একটা অবস্থা তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ভাষার দাবির জন্য গুলি চলতে পারে এটা আমাদের ধারণার অতীত ছিল।

বেবী মওদুদ: মানে এইভাবে যে গুলি চালিয়ে ছাত্রদের হত্যা করবে এটা তো ভাবার বিষয় ছিল না।

রফিকুল ইসলাম: এটা কল্পনার অতীত ছিল এবং কোনো রকম সতর্কীকরণ না কিছু না। গুলিটা করছিল ওরা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের যে মোড়টা ওখান থেকে। তার কারণ হচ্ছে যে অপরাহ্ণে বাজেট অধিবেশন বসার কথা জগন্নাথ হল মিলনায়তনে।

(পরের কিস্তিতে সমাপ্য)