মরণ ভাইরাস এইচআইভি/এইডস! বেশি সচেতনতা দরকার মেয়েদের

আজমাল হোসেন মামুন
Published : 18 Jan 2011, 10:00 AM
Updated : 18 Jan 2011, 10:00 AM

নাদিয়াকে (ছদ্মনাম) প্রেমিক প্রত্যাখ্যানের পর বরিশাল জেলা থেকে ঢাকা শহরে এসেছিল। লঞ্চ থেকে সদরঘাটে নেমে পরিচয় হয় এক মহিলার সঙ্গে। নাদিয়া তার কাছে সব ঘটনা খুলে বলে। মহিলা তাকে তার বাড়িতে কাজ দেবে বলে নিয়ে যায়। পরে তাকে যৌন কাজে লিপ্ত করতে বাধ্য করে। নিরাপদ যৌন কাজ সম্পর্কে তার কোনো পূর্ব ধারণা ছিল না। ক্লাইন্টরা তার সঙ্গে বিকৃতভাবে যৌনাচার করত। কাউকে কিছু বলতে পারত না। একসময় সে এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। পরে অকালে প্রাণ হারাতে হয় নাদিয়াকে। শুধু নাদিয়া নয়, অসংখ্য নারী রয়েছে যাদের এইচআইভি/এইডসে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। পরিবারকে সহ্য করতে হচ্ছে কলঙ্কের ব্যথা।

এইচআইভি/এইডস বিষয়ে সচেতনতার জন্য এবং এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে দিবসটি বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে পালিত হচ্ছে।
আমাদের বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ এ ব্যাপারে সচেতন নয়। এইচআইভি ভাইরাস ঝুঁকিতে রয়েছে আমাদের দেশের নারীরা। তবে তাদের সংখ্যা কত তা সাধারণ মানুষের অজানা। তবে প্রায় ১ হাজারের মতো এইচআইভিতে আক্রান্ত নারী রয়েছে। এইআইভি আক্রান্ত হওয়ার ৩টি কারণ দেখা যায়—সামাজিক কারণ, অর্থনৈতিক কারণ ও জৈবিক কারণ। সামাজিক কারণ হিসেবে দেখা যায়, অনেক পুরুষ প্রবাস থেকে দেশে ফিরে এবং কনডম ছাড়া স্ত্রীর সঙ্গে যৌন মিলন করে। তখন নারীরা নিরাপদ যৌন মিলনে সঙ্গীকে রাজি করতে পারে না। অন্যদিকে অনেক নারী এক শ্রেণীর নরপশুর হাতে জোরপূর্বক ধর্ষিত হয়। অর্থনৈতিক কারণ হিসেবে দেখা যায়, অধিকাংশ নারী স্বামীর ওপর নির্ভরশীল বলে স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী যৌন মিলনে স্ত্রীকে বাধ্য করে। যারা গ্রামে বসবাস করে তাদের ৭০ ভাগ নারীর স্বামীর মতামতের বিরুদ্ধে কিছু করার থাকে না। আবার কিছুসংখ্যক নারী ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মাধ্যমে যৌনকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তাদের ইচ্ছেমতো যৌনকাজে বাধ্য করা হয়। জৈবিক কারণের মধ্যে রয়েছে, জোরপূর্বক যৌন মিলনে বাধ্য করায় যৌনাঙ্গের পর্দা ছিড়ে যায় ও সংক্রামিত/ঘা হয়। এ ছাড়া সন্তানপ্রসবের সময় রক্তশূণ্যতা দেখা যায়। এতে অনেক সময় এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত নেয়। হাসপাতালে অপারেশনে যন্ত্রপাতি ভালোভাবে পরিষ্কার না করায় এইচআইভি ভাইরাস নারীর দেহে সহজে প্রবেশ করে।

এতে করে নারীরা এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এইচআইভ/এইডস নিয়ে কর্মরত একটি বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েটস ইন ট্রেনিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনে (অ্যাইটাম) কর্মরত ডা. ফওজিয়া বলেন, এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ ঘন ঘন ছেড়ে ছেড়ে জ্বর আসা, ৬ মাসের মধ্যে ১০ ভাগ ওজন কমে যাওয়া, ঘন ঘন ডায়রিয়া হওয়া এবং তা ওষুধ সেবনের পরও না কমা, জরায়ুর মুখে ক্যান্সার হওয়া, স্মৃতি বিলোপ হওয়াসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়।

গ্রামাঞ্চলের নারীরা নাজুক স্বভাবের। শিক্ষার দিক থেকেও শহুরে নারীদের তুলনায় পিছিয়ে। এইচআইভি সম্পর্কে অজ্ঞ। শিক্ষার আলো বঞ্চিত গ্রাম্য নারীরা বাল্যবিবাহের শিকার হন। যৌনমিলনের ক্ষেত্রে তাদের কোনো বলার সুযোগ থাকে না, তাদের মতামতের কোনো গুরুত্বই দেয় না। সব সময় স্বামীর মতামতকে গুরুত্ব দেয়। পুরুষেরা কনডম ছাড়া যৌনমিলনে বেশি আগ্রহী। নারীরা যদি কনডম ব্যবহার করার জন্য স্বামীকে বলে, তাহলে স্বামী স্ত্রীর সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে—এ আশঙ্কায় নারীরাও স্বামীকে সচেতন করে না বললেও স্বামীরা শোনে না।

গ্রামের অধিকাংশ কৃষক ও নিরক্ষর দিনমজুরের জন্য একমাত্র বিনোদন হচ্ছে যৌনমিলন। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি করে রাতে স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে ঘুমানোকে স্বর্গের মতো মনে করে। তারা বাজারে কম যায় বলে কনডম ব্যতীত যৌনমিলনে লিপ্ত হয়। অনেক সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদোন্নতির লোভ দেখিয়ে কনডম ছাড়া যৌন কাজ করে। মাদকদ্রব্য ও ওষুধ সেবনে অজ্ঞান করে অনিরাপদ যৌন কাজ করে। সেখানে নারীরা অসহায় থাকে। লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারে না। এক সময় নারীরা এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এইচআইভি ভাইরাস ঝুঁকিতে রয়েছে, সূঁই বা সিরিঞ্জের মাধ্যমে নেশাগ্রহণকারী, যৌনকর্মী, বহুগামী পুরুষ ও নারী, সমকামী নারী ও পুরুষ, যৌনরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, যৌনকর্মীদের সঙ্গে নিয়মবহির্ভূত অবাধ মেলামেশা ও পথশিশু। তবে নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে এবং আছে।

আমাদের দেশে নারীরা এইচআইভি/এইডসের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন নয়। অথচ প্রতিটি জেলা হাসপাতালে বিনামূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা করা যায়। এ ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে বিভাগীয় শহরে রয়েছে। রাজধানী ঢাকা শহরে যেসব স্থান বা প্রতিষ্ঠানে এইচআইভি বিনামূল্যে পরীক্ষা করা হয় তা হলো, ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ (আইপিএইচ), মহাখালী, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, মহাখালী, জাগরণী, ভাইরোলজি ও ল্যাবরেটরি ডিভিশন, আইসিডিডিআরবি, মহাখালী, আর্মড ফোর্সেস প্যাথলজি ল্যাবরেটরি, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, রেড ক্রিসেন্ট রক্তদান কেন্দ্র, ৭/৫, আওরঙ্গজেব রোড, মোহাম্মদপুর, ভাইরোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ এবং ক্যাপ বাংলাদেশ, ৬৩/ডি, রোড-১৫, বনানী। আসুন আমরা এইচআইভি/এইডস থেকে বাঁচতে পরীক্ষা করি। লজ্জার কারণে হয়ত অকালে জীবন হারাতে হতে পারে। এ ছাড়া ধর্মীয় অনুশাসন মেনে বিবাহবহির্ভূত যৌন কাজ থেকে দূরে থাকলে মরণব্যাধি এইচআইভি/এইডস থেকে বাঁচা সম্ভব। বিষয়টি সবার জানা ও মানা অবশ্যই জরুরি।