স্টিভ জবসের ক্যান্সার

ডা. শুভাগত চৌধুরী
Published : 26 Jan 2011, 09:29 AM
Updated : 13 Nov 2011, 03:33 PM

কতই বা ছিলো বয়স। মাত্র ৫৬। অ্যাপল ইনকর্পোরেটেডের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস্ যিনি প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এনেছিলেন বিপ্লব, তিনি চলে গেলেন পরলোকে। ২০০৪ সাল থেকে যে জটিল অগ্নাশয় ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছিলেন তিনি অক্টোবর ২০০১১ সালের ৫ তারিখে তাঁর মৃত্যু ঘটলো।

অ্যাপল কোম্পানি তাঁর এ মুত্যুকে কেন্দ্র করে লিখলো "অ্যাপল হারালো একজন স্বপ্নদ্রষ্টা ও সৃজনশীল প্রতিভাকে, পৃথিবী হারালো একজন বিস্ময়কর মানুষকে।

আরও কিছু মহান পুরুষ যারা ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাঁদের থেকে জবস্ ছিলেন ভিন্নতর :

অগ্নাশয় ক্যান্সার তার শরীরে চিহ্নিত হবার পর এ সম্বন্ধে বেশ কিছু কথাও বলেছিলেন তিনি।

২০১১ সালের আগস্ট মাসে তিনি কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, মৃত্যুর আসন্ন সম্ভাবনা অনুমান করেই।

"আমি সবসময় বলে এসেছি এমন কোন দিন যদি আসে যখন আমি বুঝব যে অ্যাপলের মুখ্য নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালনে অপারগ, আমি প্রথমেই আপনাদের জানাব। দুর্ভাগ্যবশত সে দিনটি আজ এসেছে।" আমি তাই অ্যাপলের মুখ্য নির্বাহী পদ থেকে পদত্যাগ করলাম।

তিনি মৃত্যু সম্বন্ধে আলোচনা করতে প্রস্তুত, ২০০৫ সালে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সূচনা ভাষণে তিনি তাই বললেন। যখন বিরল ধরনের অগ্নাশয় ক্যান্সার তার শরীরে ধরা পড়লো, তখন তিনি সবার সঙ্গে শেয়ার করতে চাইলেন নিজের অনুভব। যদিও ক্যান্সার নির্ণয় মানেই মৃত্যুর পরোয়ানা নয় তবু ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বড় বাস্তববাদী চিন্তা ছিলো তার।

"Remembering that I'll be dead soon is the most important tool I have ever encountered to help me make the big choices in life. Because almost everything.. all external expectations, all pride, all fear of embarrassment or failure…. these things just fall away in the face of death, leaving only what is truly important. Remembering that you are going to die in the best way I know to avail the trap of thinking you have something to loose. You are already walled. There is no reason not to follow your heart."

২০০৪ সালে বিরল ধবনের ক্যান্সার ধরা পড়লো, তার শরীরে অগ্নাশয়ে চিহ্নিত হলো নিউবোএনএডাক্রাইন টিউমার। অগ্নাশয়ের ক্যান্সারের মধ্যে মাত্র ৩% হলো এ ধরনের ক্যান্সার।

বিভিন্ন ধরনের অগ্নাশয়ের ক্যান্সারের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্যণীয়। সবচেয়ে সচরাচর অগ্নাশয় ক্যান্সার হলো খুব আগ্রাসী ও মারাত্মক, নিউরোএন্ডোক্রাইন ক্যান্সার অগ্রসর হয় ধীরে, চিকিৎসাযোগ্য্ও বটে। ওরেগন হেলথ এণ্ড সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জন ও নিউকেএনডোক্রাইন টিউমার বিশেষজ্ঞ ডা. রডনি প্রোমিয়ার বলেন, নিউরোএনডোক্রাইন ক্যান্সারের রোগ ভবিষ্যৎ ভালো। জবসের সার্জারি হলো ২০০৪ সালে, এরপর তিনি ফিরে এলেন কাজে।

পাঁচ বছর পর তিনি অ্যাপল থেকে মেডিকেল ছুটি নিলেন আবার। ইতিমধ্যে তিনি মেমফিসে মেথডিস্ট ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে করালেন লিভার ট্রান্সপ্লান্ট। তার রোগভোগের পুরো সময়টির বিষদ বিবরণ জনসমক্ষে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। লিভার ট্রান্সপ্লান্ট কেন করা হয়েছিলো এর কারণ কখনই প্রকাশিত হয়নি। সম্ভবত ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছিলো যকৃতে।

স্টিভ জবসের যে ধরনের অগ্নাশয় ক্যান্সার হয়েছিলো সে সম্মন্ধে বক্তব্য হলো এটি বেশ চিকিৎসাযোগ্য অবশ্য যদি এটি পুনরাবর্তন না করে।

অ্যাপল কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী হিসেবে পদত্যাগের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেন নি।

তবে সম্ভাব্য একটি কারণ হলো অগ্নাশয় ক্যান্সার তার শরীরে পুনরায় ফিরে এসেছিলো।

স্টিভ জবসের সবচেয়ে সচরাচর অগ্নাশয় ক্যান্সার অর্থাৎ 'এডিনোকর্ন্সনোমা' যদি হতো তাহলে সম্ভবত ২০০৩ সালে রোগ নির্ণয়ের কিছু দিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করতে হতো তাঁকে।

পরে জবস্ যা বললেন, তাঁর হয়েছিলো বিরল ধরনের অগ্নাশয় ক্যান্সার।

নিউরোএনএডাক্রাইন টিউমার বা আইলেট সেল কার্সিনোমা'।

২০০৪ সালে, ক্যান্সার নির্ণয়ের ন'মাস পর অপারেশন করে সরানো হল টিউমার। ২০০৯ সালে তাঁর হলো লিভার ট্রান্সপ্লান্ট।

এই ক্যান্সার সম্বন্ধে কিছু কথা। এটি কি নিরাময়যোগ্য? যদি এটি ফিরে আসে? কী তাহলে নিউরোএনডোক্রাইন টিউমার?

অগ্নাশয় ক্যান্সার চিহ্নিত হলে এর ভবিষ্য ভালো নয়। তবে আইলেট্ সেল ক্যার্সিনোমা হল বিরল ধরনের অগ্নাশয় টিউমার।

আইলেট কোষ হলো অগ্নাশয় গ্রন্থির হরমোন নি:সরণকারী কোষ। তবে এধরনের ক্যান্সার বিরল হলেও চিকিৎসাসাধ্য।

কোন্ কোষগুলো ক্যান্সার আক্রান্ত হলো এর উপর নির্ভর করে বোনের অগ্রগতি :
কখনও কখনও টিউমার কোষগুলো যখন সংখ্যায় বাড়ে, তখন এরা নি:সরণ করে নানা রকমের হরমোন। অদ্ভূত পরিনতি হতে পারে এই নি:সরণের জন্য। এসব হরমোন নি:সারী টিউমার প্রায়শ: নিরীহ।

কখনও আইলেট কোষ টিউমারে হরমোন নি:সরণ হয় না। এখন তেমন অদ্ভুত ফলাফলও দেখা যায় না। তবে ৯০% এধরনের টিউমার প্রানঘাতী অর্থাৎ চিকিৎসা ফলাফল মারাত্মক।

চিকিৎসা সাধ্য কি?

মিয়ামি মিলার স্কুল অব মেডিসিনের ক্লিনিক্যাল সার্জারির অধ্যাপক ডেভিড লেডি বলেন, আইলেট সেল কার্সিনোমার প্রথম চিকিৎসা হলো সার্জারি। তবে তিনি জবসের চিকিৎসা করেন নি। তিনি দিয়েছেন বোন সম্বন্ধে সাধারণ বক্তব্য।

সার্জারি দ্বারা চিকিৎসা সম্ভব না হলে বিকল্প হলো কেমোথেরাপি ও অন্যান্য বিকল্প। কোনও কোনও ক্যান্সার নিরাময় হয়না, বছরের পর বছর চিকিৎসায় ভালো থাকে। জবসকে এক 'হুইপল পদ্ধতিতে' অপারেশন করা হয়েছিলো। আইলেট সেল টিউমার অগ্নাশয়ের মাথায় থাকলে এ পদ্ধতিটি বেশ ফলপ্রসূ। অগ্নাশয়ের শীর্ষদেশ (মাথা) সরানো হয়। পিওনলের কিছু অংশ পিত্তথলি এবং ক্ষুদ্রান্দ্রের প্রথম অংশ। কখনও পাকস্থলীর কিছু অংশও সরানো হয়। এরপর এসব যন্ত্রের অবশিষ্ট অংশ যুক্ত করা হয় ক্ষুদ্রান্ত্রের সঙ্গে। আমেরিকার টেনেসিতে জবসের লিভার ট্রান্সপ্লাট হয়েছিলো বলে জানা যায় ।

কিন্তু কেন তা স্পষ্ট নয়। হয়ত ক্যান্সার সেখানে ছড়িয়ে পড়ার জন্য করা হয়েছিলো। তা একান্ত ডাক্তারি সিদ্ধান্ত ও ক্লিনিক্যাল বিবেচনার বিষয়।

লিভার ট্রান্সপ্লান্টের পরও ক্যান্সার পুনরায় ফিরে আসতে পারে। পুনরায় ফিরে এলে তা হয়ে যায় প্রাণঘাতী।

স্টিভ জবস্ তেমনই এক দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছিলেন হয়তোবা।

ডা. শুভাগত চৌধুরী: চিকিৎসক, অধ্যাপক ও লেখক।