আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যার কথা আজও মনে করে…………..

আজমাল হোসেন মামুন
Published : 10 March 2011, 07:14 AM
Updated : 10 March 2011, 07:14 AM

গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ সন্ধ্যা ৫.৫০ মিনিটে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফোরাম (এনএফওডব্লিউডি) এর সহ-সভাপতি, এশোশিয়েশন ফর দ্য ওয়েল ফেয়ার অব দি ডিজএ্যাবল্ড পিপল (এডব্লিউডিপি) এর সেক্রেটারী, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) এর সাবেক সহকারী পরিচালক বিশিষ্ট প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক উন্নয়নকমী, গবেষক এবং অনুবাদক প্রতিবন্ধীদের প্রিয় মোঃ মাহবুবুল আশরাফ ভাই । তিনি দীর্ঘ কয়েকমাস যাবৎ লিভার সিরোসিস এবং ডায়াবেটিস রোগে ভুগছিলেন। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে অকালে প্রাণ হারানো এই ব্যক্তির জন্য প্রতিবন্ধী আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

তিনি ২০০৫ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য 'স্পন্দন' নামে একটি ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছিলেন। উক্ত ম্যাগাজিনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে নানা খবর, প্রবন্ধ, ফিচারসহ অনেক তথ্যবহুল লেখা প্রকাশিত হতো বলে ম্যাগাজিনটির প্রশাংসায় পঞ্চমুখ ছিলো প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীরা। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে ৩টি গ্রন্থ অনুবাদ করেন। তাঁর মধ্যে ইউএন এসকাপ কর্তৃক গৃহীত এশীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দশক, ২০০৩-২০১২ 'বিওয়াকো মিলেনিয়াম ফ্রেমওয়ার্ক ফর একশন-এর প্রাথমিক অনুবাদ অন্যতম। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক বহু জাতীয় এবং আমত্মর্জাতিক সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক অসংখ্য প্রবন্ধ এবং ফিচার জাতীয় দৈনিক পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।
পরউপকারী, বিনয়-নম্র, শান্ত এবং মেধাবী এ মানুষটি আজীবন প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীদের জন্য কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে উনার সম্বন্ধে সবার ধারণা ছিলো ইতিবাচক। যে কোন সময় যে কোন পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীদের পক্ষে কথা বলেছেন। এগিয়ে গেছেন নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। এ ধরনের ব্যক্তি আরেকজন খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টকর।

যতটুকু প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীদের সাথে উনার ব্যাপারে কথা হয়েছে সবাই তাঁর প্রসাংশায় করেছে। উনি সব সময় উপদেশ দিতেন যে, একটা মানুষের ভাল-মন্দ উভয় দিক থাকতে পারে। তাই আপনাদের উচিত ভাল দিক আলোচনা করা। পৃথিবীতে ভাল মানুষ আছে। খুঁজতে জানলে অবশ্যই খুঁজে পাবেন। অনেক সময় রাত হলে নিজে চুলায় ভাত রান্না করে খাওয়ার পর আসতে দিতেন অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের। অথচ উনি হুইল চেয়ার ছাড়া এক পা চলাচল করতে পারতেন না। উনি সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একত্রিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। উনি বলতেন, আপনারা যে যে যেখানে কাজ করুন না কেন সবাই এক না থাকলে কিভাবে আপনাদের দাবি বাস্তবায়ন হবে। সে জন্য নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সকল সংগঠনে কর্মরত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী নারী এবং শিশু, অপ্রতিবন্ধী মানুষ যারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে সহযোগিতা করে তাদের কে সংগঠিত করে কখনও রমনা পার্কে, কখনও বোটানীকাল গার্ডেনে কখনও বা সংসদ ভবনের আশে পাশে 'গেট টুগেদার' বা বন্ধুদের মিলন মেলার আয়োজন করতো। যার নাম ছিল 'স্পন্দন ফেন্ড সার্কেল'। যেখানে প্রতিবন্ধী এবং অপ্রতিবন্ধী নারী, পুরুষ এবং শিশুরা এক সঙ্গে মিলিত হতো। বলতো সুখ-দুঃখের কথা। একদিকে প্রতিবন্ধীদের যেমন বিনোদনের ব্যবস্থা হতো তেমনি তাঁদের অধিকার বিষয়ক নানা কথা-বার্তা আলোচনা হতো। প্রতিবন্ধীরা পরিচয় হওয়ায় সুযোগ পেতো অনেক নতুন প্রতিবন্ধী এবং অপ্রতিবন্ধী বন্ধুদের সাথে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী আর কোন নেতা সে সুযোগ করে দিবে বলে মনে হয় না।

অসুস্থ্য থাকাবস্থায় যখনই ফোন দিয়েছি শুধু একটা কথা বলেছেন, আমার জন্য দোয়া করবেন। আর কোন কথা বলতেন না। আমি গত ১৭ সেপ্টেম্বর উনার বাসায় গিয়েছিলাম উনার বড় ভাইয়ের কাছে একটি বিশেষ কাজে। কিন্তু দেখলাম ঘরে তালা ঝুলানো। অথচ ওই ঘরে জীবনে অনেকদিন উনার সাথে কথা বলেছি। খাওয়া-দাওয়া করেছি। কম্পিউটারে কাজ করেছি। ঘুমিয়েছি। টিভি দেখেছি। বই পড়েছি। আবারও পূর্বের স্মৃতি মনে করে কেঁদেছি। কিন্তু উনার জন্য দোয়া করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তবে এখনও আমার মন মেনে নিতে পারছে না যে, সকলে শ্রদ্ধেয় মাহবুবুল আশরাফ ভাই দুনিয়া ছেড়ে আমাদের রেখে চলে গেছেন। বা কোন দিন আমাদের মাঝে ফিরে আসবে না। বা কোন দিন প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীদের পক্ষে কথা বলবেন না।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা মনে পড়ে যায়,

''এ অনন্ত চরাচরে
স্বর্গ মর্ত্য ছেয়ে সবচেয়ে পুরাতন কথা
সবচেয়ে জীর্ণ কথা
যেতে নাহি দিবো হায় তবু যেতে দিতে হয়
তবু চলে যায়।'' আমরা উনাকে আমাদের প্রয়োজনে যেতে দিতে না চাইলেও উনি ঠিকই চলে গেছেন আমাদের কাঁদিয়ে। আমরা উনার আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থণা করছি। পাশাপাশি সকলে ওনার জন্য দোয়া করবেন। ………………………….।

লেখক-

আজমাল হোসেন মামুন
উন্নয়নকর্মী,
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস)
মোবাইল নং-০১১৯১০৮৯০৭৫.