অপরাধে অর্থবিদ্যা

বিন্দুবিসর্গ
Published : 1 August 2012, 06:17 AM
Updated : 1 August 2012, 06:17 AM

আমরা অনেক কিছু করি। সারা জীবন কিছু না কিছু করি। আমরা লেখাপড়া করি, চাকরী করি, খায়, ঘুমাই, ঘুরতে যায়, নাটক-সিনেমা দেখি, খেলা করি ,খেলা দেখি, বিয়ে করি, সন্তান জন্মদি, চুরি ডাকাতি করি, ঘুষ খায়, ধর্ষন করি, খুন করি, ইভ টিজিং ইত্যাদি ইত্যাদি করি। আমরা যেসকল কাজ করি তা হল ভাল কাজ (নিরাপরাধমূলক) ও খারাপ (অপরাধমূলক) কাজ। আমরা কেন এইসব করি? সাধারণভাবে বললে আমরা লাভের (Gain) আশায় করি। এই লাভ হতে পারে আর্থিক, মানসিক বা দৈহিক। আমরা যে কোন কাজ করার আগেই লাভের চিন্তাটা করি। কথায় বলে নিজের লাভ পাগলেও বুঝে। সুতরাং লাভ যেখানে আমরা সবাই সেখানে। এটি মানুষের প্রাগঐতিহাসিক সাধারন প্রবৃত্তি। এতে দোষের কিছু নেই।

আমরা অর্থনীতি বা অর্থবিদ্যাতে যখন ইনভেষ্টমেন্ট ডিসিশান নেই তখনও এই Gain বা লাভের উপর ভিত্তি করেই নেই। বিনিয়োগকারি প্রথমেই চিন্তা করে কত মুনাফা আসবে বা কত বছরে বিনিয়োগকৃত মুলধন ফেরত আসবে। তারপর চিন্তা করে এই বিনিয়োগে ঝুকি কেমন। ঝুকির পরিমান বেশি হলে বিনিয়োগে যায় না। আবার ঝুকির সংগে যদি মুনাফার পরিমান সমানতালে বৃদ্ধি পায় বা ঝুকি বৃদ্ধির চেয়ে মুনাফা বৃদ্ধি বেশি হয় তাহলে বিনিয়োগে যায়। অন্যথায় বিনিয়োগ করে না। মাদক ব্যবসায়ে ঝুকি বেশি হলেও ঝুকির তুলনায় লাভ অনেক বেশি। তাই দুর্র্বিত্তের অর্থায়ন ঘটে মাদক ব্যবসায়ে। তারা ঝুকি নেই এবং মুনাফা করে। এ ধরনের বিনিয়োগকারীকে হিসেবি বিনিয়োগকারী বলা হয়ে থাকে (হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল)। আবার কিছু বিনিয়োগকারী আছে যাদেরকে হুজুগে বিনিয়োগকারী বলা হয়ে থাকে। এরা কোন হিসাবের ধার ধারে না । কেউ বলছে অমনি ঝাপিয়ে পড়েছে। তবে এদের সংখ্যা নিতান্তই কম।

একজন অপরাধী যখন কোন অপরাধ করে বা করতে উদ্যত হয় তখন সে হিসেব করেই বের হয়। অর্থাৎ অপরাধ কর্ম থেকে তার কি লাভ হবে এবং এই লাভের বিপরীতে ঝুকি কি রকম। আমি পেশাদার অপরাধীর কথা বলছি। লাভের কথা আগেই উল্লেখ করেছি- এই লাভ হতে পারে আর্থিক, মানসিক বা দৈহিক। আর ঝুকি হল জেল,জরিমানা, পিটুনী। আর মানসম্মান। এখানে শুধুমাত্র জেল এবং জরিমানা নিয়ে কথা হবে। তাহলে আমরা মোটামুটি দুইটি উপাদান নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এক- লাভ দুই- ঝুকি (জেল, জরিমানা)

এখন আমরা বিনিয়োগ থিয়রি অনুযায়ী বলতে পারি- লাভের সমষ্টি যদি ঝুকির সমষ্টি থেকে বড় হয় তবে অপরাধীরা অপরাধ করবে। আর তা না হলে করবে না। লাভের সমষ্টি নির্ভর করে মূলত চোরাই বা ডাকাতি বা ছিনতাইকৃত পণ্যের বাজার ও চাহিদার উপর। চোরাই বা ডাকাতি বা ছিনতাইকৃত পণ্য বিক্রি করার জন্য একটি মার্কেট থাকে। যদি মার্কেটটি নিরাপদ হয় এবং ক্রেতা থাকে তবে লাভ বেশি হবে। পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই এই ধরনের মার্কেট থাকে যাকে অন্ধকার মার্কেটও বলা হয়।
অন্যদিকে ঝুকি বা জেল-জরিমানার হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হয় বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর।

একঃ প্রচলিত আইন ও তার প্রয়োগ
দুইঃ পুলিশী তদন্ত ও তার মান
তিনঃ দেশের বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থা ও তার স্বাধীনতা
চারঃ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপন

দেশে প্রচলিত আইনে সাজার পরিমান এবং অপরাধ প্রমানের সহজ ও কার্যকারী ব্যবস্থা ঝুকির পরিমান হ্রাস-বৃদ্ধি করে। সাজার পরিমান বেশি হলে এবং অপরাধ প্রমাণে জটিলতা না থাকলে ঝুকির পরিমান বৃদ্ধি পাবে। তবে সাজার পরিমান যায় থাক তা নিশ্চিত করতে পারলে অবশ্যই ঝুকি বৃদ্ধি পাবে । আর ঝুকি বৃদ্ধি করতে পারলে অপরাধ কমবে। আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা কাগজে কলমে স্বাধীন হলেও কাজে কর্মে স্বাধীন নয়। তাই বিচারও স্বাধীন নয়। তাছাড়া কিছু কিছু অসৎ বিচারকগণের কারনেও অনেক সময় সঠিক সাজা প্রদান করা যায় না। আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে অনেক প্রমানিত সত্যকে অসত্য প্রমান করে সাজা মওকুফ বা একেবারে সাজা না দেওয়া হয়ে থাকে। ফলে লাভের পরিমান নিদৃষ্ট থাকলেও ঝুকির পরিমান কমে যায়। অন্যদিকে রাজনৈতির নেতাদের হস্তক্ষেপের কারনে সঠিক তদন্ত যেমন হয় না তেমনী সঠিক বিচারও হয় না। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ উভয় দিকে অর্থাৎ পুলিশি তদন্তে ও বিচার ব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করে।

খেয়াল করলে দেখবেন উপরের আলোচনায় পুলিশি তদন্ত আলোচনা করা হয়নি। এটি আলাদাভাবে আলোচনার অর্থ হল এর ব্যাপক বিস্তার। পুলিশি তদন্ত অপরাধীকে সাজা পাওয়া না পাওয়ায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। পুলিশ হল প্রথম বিচারক। তাই প্রথম বিচারে যদি গলদ থেকে যায় তাহলে চুড়ান্ত বিচারেও গলদ থাকবে। সুতরাং পুলিশি তদন্ত সবচেয়ে নিখুত এবং প্রমানযোগ্য হতে হবে। সঠিক তদন্ত অপরাধীর সাজা নিশ্চিত করবে। পুলিশি তদন্ত নিখুত এবং প্রমানযোগ্য হতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ নিশ্চিত করতে হবে।
মেধাবী তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ
উন্নতমানের আধুনিক প্রশিক্ষন প্রদান
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত
অসৎ উদ্দেশ্য পরিহার (সুপারভাইজিং অফিসার সহ)

মোটামুটি উপরিউল্লেখিত বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলে পুলিশি তদন্ত সঠিক, নিখুত ও প্রমানযোগ্য হবে। আর এটি করতে পারলে অপারাধে ঝুকিও বৃদ্ধি পাবে। কেননা এই তদন্তের উপর ভিত্তি করেই সাজা নির্ধারিত হবে (অন্যান্য বিষয় স্থির থাকবে)

বিঃদ্রঃলেখাটি একটি প্রাথমিক গবেষণার অংশ বিশেষ যা এখনও চলমান। পাঠকদের মূল্যবান মতামত এটিকে আরো সামনে নিয়ে যেতে এবং একটি ফলপ্রসূ উপসংহারের যেতে আমাকে সাহায্য করবে বলে আমি মনে করছি।