বেসরকারী হাসপাতালে টাকার জন্য মুমুর্ষ রোগী বন্দী

আবদুল লতিফ রানা_সাংবাদিক
Published : 3 July 2012, 10:28 AM
Updated : 3 July 2012, 10:28 AM

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি প্রাইভেট হাসপাতালের অতিরঞ্জিত বিল পরিশোধ করতে না পারায় চিকিৎসাহীন অবস্থায় কিনিকে ১৫ দিন ধরে ইমরান খান (৪০) এক মুমূর্ষু রোগীকে বন্দী করে রাখা হয়েছে । সরকারি হাসপাতাল থেকে কিনিকে রোগী বিক্রি বা ভাগানো সংক্রান্ত সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এই নির্মম নিষ্ঠুর ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে।
সিএনজি দুর্ঘটনায় আহত রোগী ইমানকে রাজধানীর উপকণ্ঠ কেরাণীগঞ্জের একটি কিনিকে ভর্তি করা হয়। এরপর ওই কিনিক কর্তৃপ নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে রোগিকে মোহাম্মদপুরস্থ কেয়ার স্পেশালাইজড হাসপাতাল এন্ড রিসার্চ সেন্টার নামের চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তির জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। অপরদিকে কিনিক নামের জেল হতে তাকে মুক্ত করতে ধার- দেনা রস্তায় নেমেছেন তার স্বজনরা। হতভাগ্য ইমরানের স্ত্রী শিরীন আক্তার গহনা আর ভিটে বিক্রি করে ইতোমধ্যেই এক লাখ টাকার বেশি হাসপাতাল কর্তৃপরে হাতে তুলে দিয়েছেন। তবুও কিনিক কর্তৃপ দাবি করছে আরও দেড় লাখ টাকা। কিনিকে মুমূর্ষু স্বজনকে রেখে পথে পথে চোখের পানি ফেলছেন তার অসহায় স্বজনরা। এ টাকার জন্য আর কতদিন তাকে নিষ্ঠুর কিনিকে বন্দী থাকতে হবে তা এখনও অনিশ্চিত। মৃত্যুর আগে তিনি কিনিক থেকে ছাড়া পাবেন কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। ইমরানের স্ত্রী শীরিন আক্তার জানান, গত ১৬ জুন বিকালে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের রাজেন্দ্রপুরে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হন সিএনজি চালক ইমরান খান ও সিএনজির দু'যাত্রী। স্থানীয়রা গুরুতর আহত অবস্থায় ইমরানকে কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন।
হাসপাতালে স্বজনরা পৌঁছার আগেই হাসপাতালের লোকজন ইমরানকে ওই দিন রাতে মোহাম্মদপুরস্থ কেয়ার স্পেশালাইজড হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। পরদিন ১৭ জুন ইমরানের স্বজনরা কেয়ার নামের কিনিকে গিয়ে রোগী সরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করতে চাইলে মাত্র ১০ ঘন্টার ব্যবধানে কিনিকের লোকজন ৩৬ হাজার টাকা দাবি করেন। ওই মুহূর্তে তারা এতো টাকা পরিশোধ করতে না পারায় রোগী আটক রাখা হয়। পরদিন রোগীর স্ত্রী গহনা ও বাড়ির আংশিক জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসলেও নতুন ফন্দি বের করে কিনিক কর্তৃপ। এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপ রোগীর দ্রুত অপারেশন না করলে বাঁচানো যাবে না বলে স্বজনদের জানায়। এরপর তাৎণিক অপারেশনের জন্য দু'দফায় ৩০ হাজার টাকা তুলে দেয়া হয়। অপারেশন শেষ হয়েছে জানিয়ে কিনিকের লোকজন স্বজনদের বলেন, রোগী বাঁচাতে হলে ২৪ ঘন্টা লাইফ সাপোর্ট দিয়ে আইসিইউতে রাখতে হবে। এ অবস্থায় রোগী অন্যত্র স্থানান্তর করা যাবে না। কিনিকের কথামতই চলছে ইমরানের অসহায় স্বজন। পরদিন স্বজনরা আবার ইমরানকে অন্যত্র নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপ রোগী নিতে হলে এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা দাবি করেন। কিন্তু সিএনজি চালকের স্ত্রীর পে এ টাকা যোগাড় করা সম্ভব না হওয়ায় কিনিকেই বন্দী থাকতে হয় ইমরানকে। একপর্যায়ে বাড়ির অবশিষ্ট জমি বিক্রি করে ও আত্মীদের কাছ থেকে ধার করে এক লাখ টাকা কিনিকে জমা দেন। কিন্ত তাদের ইমরানের মুক্তি হলো না। হাসপাতাল কর্তৃপ রোগীর মাথায় গুরুতর অপারেশন করতে হয়েছে বলে আরও এক লাখ ৩৩ হাজার টাকা দাবি করেছে।
এ অবস্থায় ইমরানকে বন্দী রেখেই স্বজনরা ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। ইমরানের বোন জামাই আকবর হোসেন জানান, একদিন অতিবাহিত হলেই পুরনো বিলের সাথে আরও ১৫ হাজার টাকা করে কিনিকের সিট ভাড়া যোগ করা হয়। এ অবস্থায় তারা কি করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি জানান, রোগী এখনও মুমূর্ষু। কথা বলতে পারে না। কেউ কাছে গেলে মাঝেমধ্যে চোখ মেলে তাকায়। কিন্তু কিছুই খেতে পারছে না। এ অবস্থায় প্রতিদিন ১৪শ টাকা রোগীর খাবার বিল ধরা হচ্ছে। পরীা-নিরীার বিল ধরা হয়েছে ১৪ হাজার টাকা, ৫দিন আইসিইউতে রাখার বিল ৫৯ হাজার টাকা, ওষুধ ৩৩ হাজার টাকা, সিট ভাড়া ৬৬ হাজার টাকা, অপারেশন চার্জ ৮৩ হাজার টাকা নির্ধারন করেছে ক্লিনিকের হিসাব রক্ষক।

উক্ত কিনিকের এক সূত্র জানায়, রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন কিনিক পূর্ব নির্ধারিত কমিশনের বিণিময়ে রোগী ঢাকার কিনিকে পাঠায়। আর রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালগুলো থেকেও এক শ্রেণীর দালাল রোগী ভাগিয়ে প্রাইভেট কিনিকে নিয়ে ভর্তি করানো হয়ে থাকে। এধরণের অভিযোগের ভিত্ততে মোহাম্মদপুর কেয়ার স্পেশালাইজড হাসপাতালের পাশের দু'টি কিনিকে গত শনিবার র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান চালায়। সেখানে চিকিৎসক সেজে ব্যবস্থাপত্র দেয়াসহ নানা প্রতারণার অভিযোগে ৯ জনকে সাজা দেন আদালত। উক্ত কিনিকটিতেও একই ধরনের অনিয়ম ও চিকিৎসা বাণিজ্য চালানো হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।