আমি সন্তানের সঙ্গে প্রতারণা করেছি!

আবদুল লতিফ রানা_সাংবাদিক
Published : 15 Feb 2013, 07:04 PM
Updated : 15 Feb 2013, 07:04 PM

সাংবাদিকরা দেশ-জাতি-সমাজের স্বপ্নের কথা বলেন, সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। তারা গণমানুষের সুখের কথা বলেন, বলেন স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনার কথা। মানুষের অসহায়ত্ব, বঞ্চনা আর জুলুম-নির্যাতনের গল্প সাংবাদিকের কলমকে আশ্রয় করে জাগিয়ে তোলে বিবেককে। কিন্তু সাংবাদিকেরা তাদের নিজেদের সুখ-দু:খের কথা লেখেন না! তাদের কষ্টের কথা শোনারও যেন কেউ থাকে না!

কিন্তু আমি, একটি বার্তা সংস্থার রিপোর্টার, লিখছি আমার কষ্টের কথা, গ্লানির কথা। জনগণের বিবেককে জাগ্রত করার দায়িত্বে থাকা কিছু মানুষের কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করার জন্যই লিখছি আমার অপরাধের (!) কথা।

আমি প্রতারণা করেছি। প্রতারণা করেছি নিজ ঔরসজাত সন্তানের সঙ্গে। আমার ছল-চাতুরি বুঝতে পারেনি আমার এক বছর বয়সী মেয়ে। কেবল তা কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে আমাকেই।

সংবাদপত্র জগতের মুরুব্বীদের কাছে শোনা যায়, এ জগতের অভাব-অনটন আর আর্থিক কষ্টের কথা। সাংবাদিকদের চাকরিটাই হচ্ছে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। যখন তখন চাকরি হয় আর নিমিষের মধ্যেই তা চলে যায়। আবার ৯০/৯১ মাসের বেতন বকেয়ার নজিরও রয়েছে। আর এ ধরনের সমস্যার কারণেই সংবাদ-কর্মীদের পরিবার ও সন্তানদের সঙ্গে প্রতারণা করতে হয়। এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি? কিন্তু অবুঝ শিশুদের সঙ্গে প্রতারণা করাটা পৃথিবীর কেউ মানবে না। তাই আমিও মেনে নিতে পারছি না। কিন্তু চাকরি ও কতিপয় ব্যক্তির চক্রান্তের কারণে আমি আমার শিশু সন্তানের সঙ্গে প্রতারণা করতে বাধ্য হয়েছিলাম।

আমি ২০০৩ সালের দিকে দৈনিক দেশবাংলা পত্রিকায় ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করি। ততদিনে সাংবাদিকতায় ১০/১১ বছর পার করা হয়ে গেছে। দেশবাংলায় দীর্ঘ ৬ বছর কাজ করার পর হঠাৎ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। রুজি-রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। হন্যে হয়ে চাকিরর খোঁজে ঘুরতে থাকি। ২০০৯ সালের শেষের দিকে একদিন সেগুনবাগিচা এলাকায় দেখা হয় ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের অন্যতম নেতা প্রবীণ সাংবাদিক বোরহান আহমেদ ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি তখন প্রকাশিতব্য একটি দৈনিকে সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এর এক মাস পর আমি ওই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করি। তেজগাঁর বাবলি মসজিদের পাশেই ছিল পত্রিকাটির অফিস। সবাইকে একসঙ্গে দেওয়া হবে বলে আমাকেও নিয়োগপত্র দেননি বোরহান ভাই। আমি পুরোদমে ডামি সংখ্যায় কাজ করতে থাকি। তখন ছিল পবিত্র রমজান মাস। ঈদুল ফিতরের আগে মাস শেষ না হওয়ায় তিনি আমাকে ঈদের পরে বেতন নিতে বললেন। ঈদের ছুটি শেষে একদিন সকাল বেলায় প্রেসকাবে এসে সংবাদ পেলাম আমাদের প্রিয় সম্পাদক বোরহান ভাই আর নেই।

আশঙ্কাটা তখনই বুকে দানা বাধে। নিয়োগপত্র নেই। চাকরি নিয়ে বেশ ঝামেলা হবে। আমার বেতনটাও মনে হয় পাবো না। হলোও ঠিক তাই। বোরহান ভাই মারা যাওয়ার পর বড় বড় সাংবাদিকরা সেখানে যোগদান করেন। শুরু হয় সাংবাদিকদের দলাদলি। সেখানে আরো প্রায় দেড় মাস কাজ করার পর আমাকে ১০ হাজার টাকার একটি চেক দেওয়া হলো। চেকটি পাওয়ার পর মনে করেছিলাম প্রথম মাসের বেতনটা না পেলেও চাকরিটা মনে হয় পাকা হলো। কিন্তু না, তা হলো না। পরের দিন এক 'বড় ভাই' আঙ্গুলের ইশারায় চেয়ার থেকে আমাকে উঠিয়ে দিলেন। ঘটনাটি পরিবারকে প্রায় ১৫ দিন জানাতে পারেনি। প্রতিদিন চাকরির জন্য বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকি। কয়েকজন শুভাকাঙ্খিও আমার জন্য চেষ্টা করেন।

একপর্যায়ে সাংবাদিক আয়াতউল্লাহ ভাই বিকেলে প্রকাশ হয়, এমন একটি পত্রিকায় পাঠান। সেখানে কিছু দিন কাজ করার পরই দৈনিক ভোরের ডাক পত্রিকায় চাকরি হয়। ভোরের ডাক পত্রিকায় সুন্দরভাবে কাজ করছিলাম। আমার কাজে মালিকপও খুশি ছিলেন। প্রতি মাসে নিয়মিত যা বেতন দেওয়া হতো, তা দিয়েই আমার ছোট্ট সংসারটি চলছিল।

বেশ চলছিল। হঠাৎ একদিন শ্রদ্ধেয় এক সাংবাদিক ভাই আমাকে ফোন করে জানান, তোমার আগের পত্রিকায় (তখনো বাজারে আসেনি) লোক নেওয়া হবে। তুমি আগামিকাল সকালে বোরাক টাওয়ারে যাও। তার কথা মতো পরের দিন রমনাস্থ বোরাক টাওয়ারে গিয়ে দেখি সাংবাদিকদের ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর আমাকে ডাকা হলো। এরপর আমি ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে যাওয়ার পর প্রবীণ সাংবাদিক ও দেশের সুনামধণ্য ব্যক্তিগণ বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসার পর আমার ডিমান্ড কি জানতে চান। একপর্যায়ে ওয়েজ বোর্ড মোতাবেক আমাকে বেতন দেওয়ার কথা বলে ওই মাসের শেষের দিকে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে তারা জানান। পরের মাসের প্রথম দিন পত্রিকায় যোগদান করতে বলেন। আর আগের কর্মস্থল দৈনিক ভোরের ডাক পত্রিকা থেকে ইস্তফা দিতে বলা হলো। ইন্টারভিউ বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের আশ্বাসের প্রেেিত আমি ভোরের ডাকের সম্পাদককে বলি যে, সামনের মাসে আমি একটি নতুন দৈনিকে যোগদান করছি।

এই আমার কাল হল। দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিকদের কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করে ভোরের ডাকে ইস্তফা দিলাম। কিন্তু এক তারিখে কর্তৃপক্ষে সমস্যার কারণে ওই মাসের ১৫ তারিখে পত্রিকাটি দ্বিতীয় বারের মতো যোগদান করলাম। এবার এক সপ্তাহ পর নিয়োগপত্র দেওয়ার কথা বলা হলো। সেখানে যোগদানের এক সপ্তাহের মধ্যেই বুঝতে পারলাম কয়েকজন সহকর্মী আমার যোগদানকে মেনে নিতে পারছেন না। এমনকি হাজিরা খাতায় আমার নামটা পর্যন্ত তুলতে তারা কার্পণ্য করলেন। মাস শেষে সবার বেতন হলো, কিন্তু আমার বেতন হলো না। দ্বিতীয় মাসের শেষের দিকে এক কর্মকর্তা জানালেন, চলতি মাসের বেতনের সঙ্গে আগের মাসের বেতন দেওয়া হবে। ব্যাংকে একাউন্ট করার জন্য আমার এবং আমার স্ত্রীর ছবি নেওয়া হলো।

অপরদিকে প্রতিদিন সংবাদ সংগ্রহের জন্য কঠোর পরিশ্রম ছাড়াও ২০০/৩০০ টাকা ব্যয় হতে থাকলো। মারাত্মক আর্থিক সমস্যায় নিপতিত হলাম। বাড়ি ভাড়া, বাচ্চার দুধ, বাজার এরকম নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যাপারে আমার অক্ষমতা, আমার অসহায়ত্ব মাথাটা হেট করে দিল। পরিবারের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি হতো লাগলো।

এ পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষরে কাছে বিষয়টি জানালাম। তারা বেতন না পাওয়ার বিষয়টি পরের দিন ঠিক করে দেওয়ার আশ্বাস দিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য ডেন আমার পিছু ছাড়ছিল না। পরের দিন আমাকে ডেকে নিয়ে কর্তপক্ষ বললেন, এক মাস পরে তোমাকে নিয়োগপত্র দেওয়া হবে এবং তখন যোগদান করলে পূর্বের বেতন একসঙ্গে দেওয়া হবে। ঠিক তার কয়েক মিনিট পরেই বাসা থেকে ফোনে বলা হলো আমার বাচ্চার জন্য দুধ নিতে হবে। কিন্তু তখন আমার কাছে টাকা ছিল না।

আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। সেখান থেকে বাইতুল মোক্কাররমে এসে এশার নামাজ আদায় করলাম। এর পর রাত ৯টার দিকে এক শুভাকাঙ্খি ফোন করে বার্তা সংস্থা ফোকাস বাংলায় যেতে বলেন। সেখানে যাওয়ার পর চাকরি পেয়ে গেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করলাম। কাজ শেষ করে রাত ১২টার দিকে বাসায় ফিরে দেখি আমার শিশু বাচ্চাটি ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু ওর জন্য দুধ নিতে পারিনি। গভীর রাতে ুধার তাড়নায় সে ঘুম থেকে উঠে চিৎকার শুরু করলো। এ সময় আমার সহধর্মিনী ুব্ধকণ্ঠে আমাকে শিশুর চিৎকার থামাতে বলেন। আমি অনেক চেষ্টা করলাম। পারলাম না।

অভাব মানুষকে অসৎ করে তোলে। কিন্তু এতটা, বুঝিনি কোনদিন। আমি যেন আর পারছিলাম না। এক পর্যায়ে রান্নাঘরে গিয়ে একটু পানি হালকা গরম করে চিনি মিশিয়ে ফিডারে ভরে মেয়ের মুখে তুলে দিই। দুধের বাচ্চা বুঝলো না পৃথিবীর অসহায় পিতার ছল-চাতুরি। ুধার চোটে চো চো করেই খেল তা। খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। আর আমার শুরু হলো এক নির্ঘুম রাত। কষ্টের রাত। হেরে যাওয়ার রাত। আমি যেন এক ব্যর্থ পুরুষ। যে পারেনি তার সন্তানের মুখে দুধ তুলে দিতে।

আমি প্রতারণা করতে বাধ্য হলাম। আমার মেয়ের চিৎকার থেমে গিয়েছে। কিন্তু রাতের আকাশে-বাতাসে যেন তার সেই চিৎকার অনুরণিত হতে থাকলো। ুধার্ত শিশুর চিৎকার থেমে গেলেও আমার বিবেকের চিৎকার, কান্না থামেনি আজো। কেন? অন্য বিবেকদের কাছে প্রশ্ন রইল …..।

আব্দুল লতিফ রানা
প্রশিণ ও গবেষনা সম্পাদক
বাংলাদেশ CRIME রিপোর্টার এসোসিয়েশন (ক্র্যাব)