হিন্দু-মুসলিম দুই স্ত্রীর মামলায় ৩০ মাস ধরে মর্গে পড়ে আছে উজ্জলের লাশ

আবদুল লতিফ রানা_সাংবাদিক
Published : 11 May 2012, 03:17 PM
Updated : 11 May 2012, 03:17 PM

হিন্দু-মুসলিম, দুই ধর্মের দুই স্ত্রীর মামলা ৩০ মাস ধরে মর্গের মরচুয়ারিতে পড়ে আছে চন্দন চক্রবর্তী ওরফে উজ্জলের লাশ। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর দুই স্ত্রীর মামলার কারণে চন্দন চক্রবর্তী ওরফে সাজ্জাদ হোসেনের লাশ দীর্ঘ দুই বছর ধরে ঢামেক হাসপাাতাল মর্গে পড়ে আছে। এই চাঞ্চল্যকর মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। চন্দনের ধর্ম নিশ্চিত না হওয়ার কারণে তার লাশ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগকে দান করতে নিম্ন আদালতের আদেশও কার্যকর করা যাচ্ছে না। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দুই ধর্মের চন্দনের ২স্ত্রী মহানগর আদালতে আপিল করেছেন। খিলগাঁও আইডিয়াল সিটি কলেজের শিক চন্দন চক্রবর্তী ওরফে সাজ্জাদ হোসেন গত ২০০৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। তার এ খুনের ব্যাপারে খিলগাঁও থানায় পুলিশ বাদি হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ ২ বছরেও তার খুনের ব্যাপারে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার বা আটক করতে পারেনি পুলিশ। তবে নারী ঘটিত কারণে তিনি খুন হয়েছেন বলে পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, চন্দন চক্রবর্তী ওরফে সাজ্জাদ হোসেন কলেজের শিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র ছাত্রীদের বাসায় টিউশনি ও কোচিং কাশে পড়াতেন। এছাড়া মানিকগঞ্জে ইটের বাটা ও ফলের ব্যবসা করতেন। সাভার এলাকায় ১৫/২০ বিঘা জমি ছাড়াও একটি বাড়ি রয়েছে। খিলগাঁওয়ে ফাট, ইয়ারপোর্ট এলাকায় ১০ কাঠা জমি রয়েছে তার। ১৯৯৮ সাল থেকে খিলগাঁও এলাকায় পলি আক্তার নামের এক মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতেন। ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম পরিবর্তন করে চন্দন চক্রবর্তী সাজ্জাদ হোসেন নাম গ্রহণ করেন। ২০০৫ সালের ২১জুন তিনি পলি আক্তারকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর মালিবাগের ডিআইটি রোড এলাকায় একটি বাড়িতে সাবলেটে ভাড়ায় ওঠেন।

গত ২০০৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হওয়ার পর তিথি চক্রবর্তী নামের যুবতী তার প্রথম স্ত্রী হিসেবে পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ভারতে ছিলেন। দেশে এসে তার স্বামীর লাশ দাবি করেন। পরে দুই স্ত্রী দুই ধর্মের কারণে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতে দীর্ঘ শুনানির পর ধর্ম নির্ধারণ না করতে পেরে আদালত ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগকে জনকল্যাণে দেয়ার জন্য আদেশ দেন। পরে তিথি চক্রবর্তী ঢাকার জজ আদালতে আপিল করে ভারতে এমফিল পরীা দিতে ভারতে চলে যান। তিনি তার আইনজীবীদের সাথে যোগাযোগ করে আসছেন। অপর দিকে চন্দনের দ্বিতীয় স্ত্রী পলি আক্তারও আদালতে আইনজীবীদের কাছে ধর্না দিচ্ছেন। এতো কিছুর পরও চন্দনের লাশ নিয়ে কোন প্রকার সুরাহা হচ্ছে না। ফলে বিপাকে পড়েছেন, ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপ। মর্গ সূত্র জানায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের মরচ্যুয়ারিতে অজ্ঞাতনামা লাশগুলো তাদের পরিচয় পাওয়ার জন্য ৩ থেকে সবোর্চ্চ ৬ দিন পর্যন্ত রাখা হয়। এরপর লাশের পরিচয় পাওয়া না গেলে লাশগুলো আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামকে দাফনের জন্য দেওয়া হয়। মর্গ সহকারী মোঃ সেকান্দার আলী জানান, চন্দন চক্রবর্তী ওরফে সাজ্জাদের লাশ নিয়ে তাদের অনেক হিমশিম খেতে হচ্ছে। এক দিকে প্রদণ্ড গরম্। অপর দিকে বিদ্যুৎ থাকে না। ফলে লাশ দিয়ে দুগন্ধ বের হতে থাকে। প্রতি দিনই লাশটি মরচ্যুয়ারি থেকে নামিয়ে বের করে কিছুণ বাহিরে রাখার পর পুনরায় সেখানে রাখতে হয়। এতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আদালতের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত লাশটি কাউকে দেয়া যাচ্ছে না। আর বিষয়টি খুবই জটিল হয়েছে ধর্ম নিয়ে। অপর দিকে চন্দন চক্রবর্তীর স্ত্রী পলি আক্তারের ভাই গোলাম সরোয়ার জানিয়েছেন, তার ভগ্নিপতির লাশ দাফনের জন্য তারাই পাবেন। কারণ তিনি এফিডেভিডের মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মোসলমান হয়েছেন। এছাড়া ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক তার বোন পলিকে বিয়ে করেছেন। আদালতে ওই কাজীকে উপস্থিত করা হয়েছিল। তার পরও আদালত যে রায় দিবেন তাই তাদের মানতে হবে। পলি আক্তারের আইনজীবী আবু আব্দুল্লাহর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, চন্দন চক্রবর্তী আদালতের মাধমেই হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ছিলেন। এছাড়া তিনি এফিডেভিয়েটের মাধ্যমে চন্দন চক্রবর্তী বাদ দিযে সাজ্জাদ হোসেন নাম গ্রহণ করেন। এর দীর্ঘ দিন পরে পলি আক্তারকে ইসলাম ধর্মের রীতি মোতাবেক বিয়ে করেছেন। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তার মক্কেল পলি আক্তার আপিল করেছেন। আগামি ১ জুন মামলাটির শুনানি হবে।

আইন মোতাবেক তার মক্কেল পলি আক্তার সাজ্জাদ হোসেনের লাশ দাফনের জন্য অনুমতি পাবেন। চন্দন চক্রবর্তী ওরফে সাজ্জাদ হোসেন হত্যা মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা পি এস আই আসলাম হোসেন জানিয়েছেন, চন্দন চক্রবর্তীর রহস্যময় জীবন। কলেজে শিক্ষার পাশাপাশি টিউশনি ও কোচিং ব্যাবসা ছাড়া মানিকগঞ্জে ইটের ভাটা ছাড়াও ফলের ব্যবসা করতেন। তিনি তার ছাত্রীদের কাছে অবিবাহিত পরিচয় দিয়ে বিয়ের জন্য ছাত্রীর অভিভাবকদের কাছে পাত্রী দেখার জন্য বলতেন। অনেক ছাত্রীর মায়েরা তাদের মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্যই প্রস্তুত হতেন। কিন্তু তার প্রতি সন্দেহের কারণে তাদের মেয়েদের বিয়ে দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। খিলগাঁও রামপুরা এলাকায় এ ধরণের একাধিক ঘটনা তার জীবনে ঘটেছে। তার ছাত্রী পলি আক্তারকে বিয়ের সময় তিনি অবিবাহিত পরিচয় দিয়েছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর তার প্রথম স্ত্রীর সন্ধান পাওয়া যায়। তাছাড়া এক মেয়ের পরিবার জানিয়েছেন, তাদের মেয়ের সাথে সাজ্জাদ হোসেনের বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল। ঘটনাটি পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর তারা বিষয়টি গোপন রেখেছেন। হত্যা মামলায় এখনো কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। লাশটির সমাধান হওয়ার পরই অপরাধীদের গ্রেফতার করা হবে। অযথা কেউ যাতে হয়রানীর শিকার না হন, সেজন্যই কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি বলে মামলার অপর এক তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন। মামলাটি বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা অফিসে তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মাসুদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাহিরে আছেন, পরে যোগাযোগ করতে বলেছেন।