মেধা-স্বত্ব আইন প্রসঙ্গে

মুহম্মদ নূরুল হুদামুহম্মদ নূরুল হুদা
Published : 28 Jan 2013, 03:15 PM
Updated : 28 Jan 2013, 03:15 PM

বর্তমান বিশ্বের একটি সর্বাধিক আলোচিত বিষয় ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি আ্যক্ট বা মেধা-স্বত্ব আইন। বাংলায় বহুলপ্রচলিত এই পারিভাষিক অভিধা 'মেধা-স্বত্ব' পাল্টে 'মনন-স্বত্ব' কথাটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। কেননা 'ইন্টেলেকচুয়াল' শব্দটির অর্থ ও ব্যঞ্জনা 'মেধা'র চেয়ে 'মনন'-এর অধিকতর নিকটবর্তী বলে মনে হয়। যা-হোক, বর্তমান আলোচনায় আমরা প্রচলিত পারিভাষিক শব্দ 'মেধা'কেই গ্রহণ করছি। মেধা হোক মননই হোক, আসলে এই হচ্ছে মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রধান উৎস ও প্রক্রিয়া।

মানুষ তার অন্তর্নিহিত স্বজ্ঞাকে ব্যবহার করে অর্জিত জ্ঞানের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটিয়ে যা অর্জন করে, তার আরেক নাম প্রজ্ঞা। স্বজ্ঞা ও প্রজ্ঞার এক রহস্যময় অন্তর্বয়নের ফলে মানুষ স্বভাবতঃই সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে। এই সৃষ্টিশীলতার মূলে রয়েছে ব্যক্তি, তারপর পরিবার, গোষ্ঠী ও বিশেষ বিশেষ মানব সম্প্রদায় বা কমিউনিটি। সৃষ্টিশীলতা ও মেধা-মনন, এ কারণে, অবিচ্ছিন্ন একটি কার্যপ্রবাহ। ব্যক্তি যা সৃষ্টি করে, তার মালিকানা তার। ব্যক্তিক সৃষ্টি যখন কালপরম্পরায় একটি সম্প্রদায় বা কমিউনিটির প্রতীক হয়ে ওঠে, তখন তার মালিকানা সামষ্টিকভাবে ওই সম্প্রদায় বা কমিউনিটির। ফলে মানুষের মেধা-মননের প্রক্রিয়াজাত সৃষ্টি – তা মূর্ত হোক বা বিমূর্তই হোক – প্রথমত ব্যক্তিস্রষ্টার মালিকানাধীন: অতঃপর তা তার গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় বা জাতির সম্পত্তি।

'সম্পত্তি' শব্দটি আক্ষরিক অর্থে ইংরেজি 'প্রপার্টি' শব্দের অনুবাদ। 'সম্পত্তি' কথাটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই যে, তা তার মালিক যেমন-খুশি তেমনভাবে ব্যবহার করতে পারে; কিন্তু অন্য কেউ তার কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্তি বা আইনসম্মত অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করতে পারে না।

মানব সমাজে এ যাবত তিন ধরনের 'সম্পত্তি' প্রধানভাবে স্বীকৃত। প্রথমত, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেয়া যায় এমন সম্পত্তি। যেমন – ঘড়ি, কলম, জামা-কাপড় ইত্যাদি। আইনি পরিভাষায় এ ধরনের স্থানান্তরযোগ্য বা বহনযোগ্য সম্পত্তির নাম অস্থাবর সম্পত্তি। নিজের হাতঘড়ি, জামা-কাপড়, টুথব্রাশ, কলম ইত্যাদি মালিক নিজেই ব্যবহার করবেন। মালিকের বৈধ অনুমতি ছাড়া এগুলো অন্য কারুর ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় নয়। আসল কথা, অন্যের অস্থাবর সম্পত্তি বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা যায় না। যদি মালিক এগুলো ব্যবহার করার অনুমতি দেন, তাহলেও ব্যবহারবিধি বা কিছু শর্ত জুড়ে দিতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, স্থাবর সম্পত্তি। সাধারণত জমি, দালানকোঠা বা স্থানান্তরের অযোগ্য সম্পত্তি স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য। মালিক নিজেও বিশেষ ধরনের সামাজিক রীতিনীতি, প্রচলিত আইন বা বিশেষ ধরনের আইন মেনে এসব স্থাবর সম্পত্তি ব্যবহার করেন বা অন্য কাউকে ব্যবহারের বৈধ অনুমতি দেন। বলা বাহুল্য, স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির সাধারণ রুপ হচ্ছে, এগুলো মূর্ত বা টেনজিবল প্রপার্টি। প্রয়োজনে এগুলোকে ব্যক্তি বা সামষ্টিক মালিকের কাছ থেকে বিযুক্ত করা যায়।
কিন্তু তৃতীয় যে ধরনের সম্পত্তির কথা আমরা বলছি, তা সাধারণত ব্যক্তি বা সামষ্টিক মালিকের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এ ধরনের সম্পত্তির নামই হচ্ছে মেধা-স্বত্ব বা মনন সম্পদ। মানুষের মন বুদ্ধি দিয়ে, আবেগ দিয়ে বা সমরূপ অন্যকোনো অন্তর্গূঢ় সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এগুলো সৃষ্টি করে। এগুলোর মূল রূপ বিমূর্ত বা ইনটেনজিবল। তবে অধিকাংশ বিমূর্ত সৃষ্টকেও শেষ পর্যন্ত মূর্ত অভিব্যক্তি বা টেনজিবল এক্সপ্রেশনে রুপান্তর করা যায়। তখন তা বাণিজ্যিকভাবে দামি হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, একজন কবি যখন একটি কবিতা লেখেন, তখন তা সম্পূর্ণই তার মন ও মননের অরূপ সৃষ্ট। কিন্তু যখন তা প্রকাশিত হয়ে যায় এবং গ্রন্থ বা অন্য কোনো প্রকাশনা হিসেবে দেখা যায়, তখন তার আধার বস্তুরুপে গ্রাহ্য হয় এবং তা বাণিজ্যিকভাবে মূল্যবান হয়ে ওঠে। বলা চলে, বর্তমান বিশ্বে মেধামননজাত প্রতিটি সৃষ্টিরই এই দ্বৈতরুপ : বিমূর্ত ও মূর্ত। মূর্ত অভিব্যক্তিতে রূপ নেয়ার পর প্রতিটি বিমূর্ত সৃষ্টি অস্থাবর সম্পত্তি হয়ে যায়।

আবার তার আদিরূপ 'বিমূর্ত' বিধায় এটি স্রষ্টার অবিভাজ্য সম্পত্তি হয়ে থাকে। ব্যক্তিক বা সামষ্টিক স্রষ্টার কাছ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আসলে স্বজ্ঞা, প্রজ্ঞা ও অভিব্যক্তির ধারাবাহিকতায় এই সম্পত্তি তার মালিকের সৃষ্টিলোকের সঙ্গে যুক্ত এক বিশেষ দক্ষতার নাম। এই দক্ষতার মেয়াদ কমপক্ষে ব্যক্তিস্রষ্টার জীবন পর্যন্ত বলবৎ থাকলেও সামষ্টিক বা কমিউনিটি-স্রষ্টার ক্ষেত্রে তা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত ভোগ্য সম্পত্তি হিসেবে বিবেচ্য। তাই তার সুরক্ষা প্রদান করতে হয়।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রপার্টি প্রটেকশন বা নিরাপত্তাবিধানের জন্য সাধারণত ট্রেড মার্ক, সার্ভিস মার্ক, নকশা, ইত্যাদি নিবন্ধন ও পেটেন্ট করা জরুরি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশনে এসব বিষয় বিশদভাবে উল্লেখিত আছে। যুগের প্রয়োজনে এসব বিষয়ে ক্রমাগত বিবর্তনও লক্ষ্যযোগ্য। বর্তমান ব্যবসাপ্রধান বিশ্বে মেধা-স্বত্বের মালিকানা ও মেয়াদকাল এ-কারণে সমধিক গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে।


মেধাস্বত্ব সাধারণত দুই শাখায় বিভক্ত : 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল' প্রপার্টি বা শিল্প-সম্পত্তি এবং কপিরাইট বা গ্রন্থ-স্বত্ব। বিশ্ব মেধা-স্বত্ব সংস্থা বা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ওয়াইপো) ১৯৬৭ সালের ১৪ জুলাই তারিখে স্টকহোমে গৃহীত একটি কনভেনশনে নিম্নলিখিত বিষয়াবলীকে মেধা-স্বত্বের আওতাধীন বলে ঘোষণা করেছে: ১. শিল্প-সাহিত্য ও বিজ্ঞান-কর্ম ২. শিল্পী, ফোনোগ্রাম ও বেতারের অনুষ্ঠানাদি ৩. সব মানবিক সাধনা থেকে অর্জিত আবিষ্কার ৪. বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ৫. শিল্পসংক্রান্ত নকশা বা ডিজাইন ৬. ট্রেডমার্কস, সার্ভিস মার্কস, বাণিজ্যিক নাম ও পদবি ৭. অবৈধ প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা এবং ৮. মেধা-মননের কর্মসঞ্জাত শিল্প, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও নান্দনিক ক্ষেত্রে যাবতীয় সৃষ্টি। কনভেশনে এই শ্রেণীকরণ বিধৃত হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, 'বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার' মেধা-স্বত্বের আওতায় আনা বিধেয় নয়। তবে ইনভেনশন বা বিশেষ কারিগরি সমস্যার সম্পূর্ণ নতুন সমাধান মেধা-স্বত্বের পর্যায়ভূক্ত হতে পারে। ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল প্রপার্টি বা শিল্প-সম্পত্তি শীর্ষক অভিব্যক্তি নিয়ে প্রায়শ ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির পার্থক্য নির্ণয় সন্দেহাতীত নয়। কিন্তু যেহেতু শিল্প-সম্পত্তি এক ধরনের নতুন আবিষ্কার, সেহেতু তা মানব মনের সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে সংযুক্ত। সাধারণত উদ্ভাবন, নবাবিষ্কার, নকশা ও ডিজাইন বা এ ধরনের সৃষ্টির স্বত্ব লেখকের বা স্রষ্টার জীবৎকাল এবং তৎপরবর্তী ৫০ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমানে এটি ক্ষেত্রবিশেষে ষাট-সত্তুর বছর পর্যন্তও প্রসারিত করা হয়েছে। কপিরাইটের ক্ষেত্রে বর্তমানে নানা সীমাবদ্ধতার প্রধানটি হচ্ছে, এটি সামষ্টিক বা দলবদ্ধ সৃষ্টির স্বত্ব সংরক্ষণ করতে নানা জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে। উপরন্তু কপিরাইট লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রতিকার না চাইলে এর কোনো সহজ প্রতিকারেরও উপায় নেই।

সম্পত্তির অধিকার বা মালিকানা সংরক্ষণের রীতি সুপ্রাচীন; কিন্তু মেধা-স্বত্ব আইনের প্রণয়ন ও প্রয়োগ মধ্যযুগ থেকেই শুরু হয়েছে। রাণী প্রথম এলিজাবেথের সময় প্রথম প্রেটেন্ট পদ্ধতি চালু হয়েছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতেও এর প্রচলন দেখা যায়। পেটেন্টসহ ইন্ডাস্ট্রিয়াল কপিরাইটের বাস্তবায়ন একটি সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখে। বর্তমান বিশ্বে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ ছাড়াও স্বল্পোন্নত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মেধা-স্বত্ব আইনের প্রণয়ন ও প্রয়োগ বিশিষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যান্য অনেক কিছুর মতো এই উপমহাদেশে ইংরেজ আমলেই কপিরাইট আ্যক্ট, প্যাট্রেন্ট আ্যন্ড ডিজাইন আ্যক্ট ট্রেড মার্ক আ্যক্ট, পিউর ফুড অর্ডিন্যান্স, মার্কেন্টাইল মার্ক আ্যাক্ট, ইত্যাদির প্রচলন হয়। ১৮৮৯ সালে প্রবর্তিত হয় দ্য মার্কেন্ডাইজ মার্কস আ্যক্ট। ১৯১১ সালে প্রবর্তিত হয়েছিল প্যাটেন্ট অ্যাক্ট ও ডিজাইন আ্যক্ট। ১৯৪০ সালে প্রবর্তিত হয় দ্য ট্রেড মার্কস আ্যক্ট। ১৯৫৯ সালে প্রবর্তিত হয় দ্য পিউর ফুড অর্ডিন্যান্স। বাংলাদেশ আমলে পরিবর্তিত ও পুনঃপ্রবর্তিত হয়েছে কপিরাইট আ্যক্ট। কপিরাইট আ্যক্ট-২০০০ সালের ২৮ নং আইন। ২০০৫ সালে এই আইনের খসড়া ও বিষয়বস্তুর পরিধি পুনরায় কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে তা আরো সময়োপযোগী করার জন্যে সংশোধন করা হচ্ছে। আসলে জ্ঞানবিজ্ঞানের নিয়ত নবায়নের ফলে কপিরাইটও প্রতিনিয়ত নবায়নযোগ্য। জাপানে প্রায় প্রতি বছর এই আইনে সংশোধনী আনা হয়। জাপানের প্রধানমন্ত্রী নিজে মেধাস্বত্ব পরিচালনা বোর্ডের প্রধান এবং মন্ত্রীবর্গ সদস্য।

প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস সম্পত্তি আইনগুলো সংশোধনের কাজও প্রক্রিয়াধীন। জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন আইন, লোকসংস্কৃতি সুরক্ষা আইনও অতি জরুরিভাবে প্রণয়নযোগ্য। এগুলো সময়োপযোগীভাবে সংশোধিত হওয়াও অত্যাবশ্যক।


মেধা-স্বত্ব আইনের বিশেষভাবে উল্লেখ্য অংশের নাম কপিরাইট। এটি সাধারণত নান্দনিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সৃষ্টি, যথা কবিতা, কথাসাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রশিল্প চলচ্চিত্র ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির যুগে রেডিও-টিভি ওয়েবসাইটসহ সব অত্যাধুনিক ডিজিটাল সৃষ্টিকর্ম এর সঙ্গে যুক্ত। ইংরেজি ব্যতীত অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় কপিরাইট অর্থ অথারস রাইট বা গ্রন্থকারের স্বত্ব। গ্রন্থকার বলতে যে কোনো শিল্পকর্মের স্রষ্টাকেই বোঝায়।
একটি গ্রন্থ বা তদ্রুপ অন্য কোনো সৃষ্টির একাধিক কপি বা নকল করার ক্ষেত্রে কপিরাইট আইন প্রযুক্ত হয়। এখানে গ্রন্থে বা কর্মে উপস্থাপিত বিষয় বা ভাবসমূহ নয়, বরং রচয়িতা বা স্রষ্টার অভিব্যাক্তি ও শৈলীই বিশষভাবে সংরক্ষিত হয়ে থাকে। অন্য কেউ একজন লেখকের লেখার ভাব বা বিষয় নিজের মতো করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারবে। কিন্তু লেখকের কোনো রচনা হুবুহু পুনর্মুদ্রণ বা নকল করতে পারে না। তেমন ঘটনা ঘটলে কপিরাইট লঙ্ঘিত হয়েছে বলে ধরা হয়। কোনো সৃষ্টিকর্মের মৌলিকতাই হচ্ছে ওই সৃষ্টিকর্মের কপিরাইট সংরক্ষিত হওয়ার ন্যূনতম শর্ত। এটি প্রকাশিত হলো কিনা তা বড় বিষয় নয়। রচনার মানও এক্ষেত্রে তেমন ধর্তব্য নয়। গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের মালিকানার প্রতি শ্রদ্ধ্রাশীল হওয়া কপিরাইটের মূল প্রতিপাদ্য হলেও এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে কপিরাইট হোল্ডারের আর্থিক লাভও নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। ফলে কপিরাইটের বাণিজ্যিক দিকটা মোটেও হেলাফেলার নয়। বরং বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে এর গুরুত্ব বৈশ্বিক পরিপেক্ষিতে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তবে কপিরইট সাধারণত একটি বিশেষ মেয়াদে বন্দি। বার্ন কনভেনশন অনুযায়ী কপিরাইট ওয়ার্লড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও) এবং ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ওয়াইপে) বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতকে পটভূমিকায় রেখে তাবৎ উন্নত উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের মেধা-স্বত্ব আইন হালনাগাদ করার ব্যাপক কার্যক্রম শুরুু করেছে। এক্ষেত্রে সব থেকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলো। এসব দেশে প্রশিক্ষিত জনশক্তির পাশাপাশি সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠানের বড় অভাব।


বাংলাদেশে কপিরাইট ও ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল প্রপার্টি ব্যবস্থাপনার জন্য দুটি প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং প্রাক্-জ্ঞানের অপ্রতুলতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম যেমন সীমিত, তেমনি দায়সারা গোছের। এক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাগ্রসর জাপান, যারা নিজেদের মেধাস্বত্ববান জাতি হিসেবে ঘোষণা করেছে। বলা বাহুল্য, এই মেধাস্বত্বকেই তারা তাদের সাম্প্রতিক অগ্রগতির মূল নিয়ামক বলে মনে করে। জাপান ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া এ-ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অগ্রসর। জাপানের কপিরাইট ব্যবস্থাপনা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কিপো বা কোরিয়ান ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল, স্বল্পোন্নত ও অনুন্নত দেশের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে। বাংলাদেশের কপিরাইট অফিস এবং প্যাটেন্ট ডিজাইন দেখাশোনাকারী অফিসকে সমন্বিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়। সঙ্গে সঙ্গে মেয়াদ, স্বত্বসহ আইনের নিত্যবিবর্তিত ও সম্প্রসারিত নতুন এলাকার দিকেও সতর্ক নজর দেয়া আবশ্যক।
মেধা-স্বত্ব আইনের সর্বশেষ সম্প্রসারিত এলাকা আপাতত ট্র্যডিশনাল নলেজ (লোকজ্ঞান) এবং ট্র্যাডিশনাল কালচারাল এক্স্রপ্রেশন্স বা লোক-সাংস্কৃতির অভিব্যক্তি, যার অন্য নাম ফোকলোর। এ দুটি ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রচলিত তাবৎ মেধা-স্বত্ব আইন-কাঠামোর আওতাবহির্ভূত। এর মূল কারণ, লোকজ্ঞান বা লোকসাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি সামবায়িক সৃষ্টি, যেখানে ব্যক্তির চেয়ে উৎস-সমাজ ও ব্যবহারকারী সমাজের মালিকানাই বিশেষভাবে গ্রাহ্য। সামষ্টিক সম্প্রদায় ও সমাজ যেহেতু বিবর্তনশীল হয়েও বিলয়হীন, সেহেতু একটি সমাজের সামষ্টিক লোকসৃষ্টির মালিকানা ওই সমাজের সমান-বয়সী। তার মেয়াদ অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত। বাংলার বাউল ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি-মৃৎশিল্প-নকশিকাঁথা-হস্তশিল্প-লোকচিত্রকলা ইত্যাদি এই জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক সমাজ, বিশেষয়িত সমাজ ও লোকস্রষ্টার মালিকানাধীন। এই মূর্ত ও অমূর্ত লোক-সাংস্কৃতিক পণ্যের ব্যবসায়িক মূল্যও আমাদের ধারণার বাইরে। সম্প্রতি (২০০৫-৬) একটি জরিপে এই মূল্যমান বাৎসরিক সাড়ে বারো হাজার কোটি টাকা বলে অনুমিত হয়েছে। কাজেই আজ লোকসৃষ্টিকলা যতখানি নান্দনিক, ব্যবসায়িক দিক থেকেও ততখানি সম্ভাবনাময়। এর যথাযথ ফল ভোগ করতে হলে আঞ্চলিক, জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে সচেতনতার পাশাপাশি বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি, কিংবা তারও আগে দেশের ক্ষুদ্রজনগোষ্ঠী ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে শ্রদ্ধ্রা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সমানতালে এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সংস্কৃতিক অভিব্যক্তি শনাক্তকরণ, মূল্যমান নির্ধরণ, দলিলীকরণ ও বিলুপ্তির হাত থেকে উদ্ধারের জন্য কমিউনিটি মিউজিয়াম বা সমাজ জাদুঘর স্থাপন অতি জরুরি। আর তাকে বাস্তব রুপ দিতে হলে জাতির সকল স্তরের মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে প্রচলিত মেধা-স্বত্ব আইনের যুগোপযোগী হালতকরণও আশু কর্তব্য। তা না হলে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের থাবায় আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অচিরেই হারিয়ে বসব। তার ফলে বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতাও কার্যত মূল্যহীন হয়ে দাঁড়াতে পারে।

পরিমার্জিত জানুয়ারি ২০১৩

মুহম্মদ নূরুল হুদা: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।