করোনাভাইরাস: বদলে যাওয়া কর্মক্ষেত্র ও কর্মীর সুরক্ষা

রামিম হাসান এবং মিফতাহুল জান্নাত
Published : 26 Jan 2012, 01:27 PM
Updated : 28 July 2020, 10:54 AM

"প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে নিয়মিতভাবে সাজাতে হবে কর্মপরিকল্পনা। একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর—সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য ঠিক করতে হবে নতুন কর্মপদ্ধতি। একটি প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান হচ্ছে মানবসম্পদ। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতেই কর্মীদের নিরাপত্তা এবং তাদের মনোভাবকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হলে পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রেখেও প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।

১৯ মার্চ, ২০২০, সকাল ৮টা ৩০ মিনিট। স্থান ৭৫ মহাখালী, ঢাকা। ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে সারি সারি যানবাহন থেকে নামছেন কর্মীরা। লিফটগুলোর সামনে লম্বা লাইন। কেউ কেউ বাইরের প্লাজায় অপেক্ষা করছেন, কখন ভিড়টা একটু কমবে। সকাল ১০টা নাগাদ প্রায় দেড় হাজার কর্মীর কর্মব্যস্ততায় মুখর হয়ে উঠল ২০তলা ভবনের প্রতিটি তলা।

রবি থেকে বৃহস্পতি—প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এটাই ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ের সামনের চিত্র।

বছরের পর বছর ধরে চলা এই দৃশ্যপটে হঠাৎ পরিবর্তন আসে ২২ মার্চ, ২০২০। সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রবিবার সকালে ব্র্যাক হেডকোয়ার্টার্সের সামনে অন্যান্য দিনের মতো কর্মীদের আনাগোনা নেই, নেই যানবাহনের সারি—অদৃশ্য কর্মব্যস্ততাও।

কোভিড সংক্রমণ ঠেকাতে প্রধান কার্যালয় বন্ধের ঘোষণা কার্যকর হয় ওই দিন থেকেই।

ঘোষণা আসে ১৭ মার্চ, বুধবার। কিন্তু বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আসার আরও আগে থেকেই নতুন বাস্তবতাকে মানিয়ে কাজ করে যাওয়ার পরিকল্পনাটা চলছিল পুরোদমে। আর তাই কর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিতে একমুহূর্তও বিলম্ব হয়নি। এমন কি সরকারিভাবে সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগেই ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ের কর্মীরা নিরাপদে ঘরে ঢুকে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু যেকোনো দুর্যোগে মানুষের পাশে থাকাই যে সংস্থার প্রধান কাজ, তারা তো আর ঘরে বসে থাকতে পারেন না।

মানুষের জন্য মাঠেই ছিলেন ব্র্যাকের ফ্রন্টলাইনাররা। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ব্র্যাকের অফিসগুলোর কার্যক্রম চালু ছিল পুরোটা সময়জুড়ে। তবে সেখানেও প্রতিটি কর্মীর বয়স ও স্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আগেই পাঠানো হয় সুরক্ষা সামগ্রী ও নির্দেশনা। কিন্তু প্রধান কার্যালয়ে যেহেতু একসঙ্গে অনেক মানুষ কাজ করেন, তাই ওই সময় হেড অফিস খোলা রাখা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাহলে প্রধান কার্যালয়ের কাজ কি এ সময়টাতে বন্ধ ছিল?

বিশ্বের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন সংস্থার এত বড় কর্মযজ্ঞ এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ রাখা সম্ভব নয় কোনোভাবেই। তাই হেড অফিস বন্ধ রেখেও যাতে সকল কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া যায়—সেই প্রস্তুতিটা শুরু হয়েছিল মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই।

শুধু ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা ঘরে বসে কাজের সংস্কৃতিকে কর্মীদের মাঝে সমৃদ্ধ করাই নয়; পুরো সময়জুড়ে নিয়মিত পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রতিটি কর্মীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিতের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল ব্র্যাকের পক্ষ থেকে। কোনো কর্মী বা তার পরিবারের সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে বা উপসর্গ দেখা দিলে তাদের জন্য টেলিমেডিসিনের পাশাপাশি ছিল করোনাভাইরাস পরীক্ষার আলাদা ব্যবস্থা। আর মানসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য ব্র্যাকের নিজস্ব সাইকোলজিস্ট দলের সমন্বয়ে তৈরি করা হয় 'মনের যত্ন মোবাইলে' নামে একটি টেলিসেবা প্ল্যাটফর্ম।

প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে বিশ্বের ও দেশের সার্বিক করোনাভাইরাস পরিস্থিতি। ই-মেইলের মাধ্যমে সিচ্যুয়েশন রিপোর্ট নিয়মিত সরবরাহ করা হয়েছে কর্মীদেরকে। অভ্যন্তরীণ জরিপ ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মীদের চাহিদা, সমস্যা ও সমাধানের উপায় চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাধ্যতামূলক কাজে নিয়জিত যেসব কর্মীদের শারীরিক উপস্থিতি জরুরি, তাদের জন্য অফিসের নিজস্ব যানবাহন থেকে শুরু করে ছিল সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ব্র্যাকের সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের কর্মকর্তারা নিয়মিত লাইভ ভিডিও স্ট্রিমের মাধ্যমে কর্মীদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন, খোলা মনে দিয়েছেন বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর।

দীর্ঘ সাড়ে তিন মাসের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, কর্মীর স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিতে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাতে সার্বিকভাবে সংস্থাটির পরিচালন ব্যয় কিছু ক্ষেত্রে বাড়লেও অনেক ক্ষেত্রে আবার কমেছেও। পাশাপাশি প্রধান কার্যালয় বন্ধ রেখে কর্মীদেরকে ঘরে থেকে কাজ করতে অভ্যস্ত করানোর প্রক্রিয়ায় সার্বিকভাবে কাজের পরিমাণ বা মান কোনোটাতেই খুব একটা ঘাটতি দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে ব্র্যাকের প্রশাসন বিভাগের পরিচালক আহমেদ নাজমুল হুসেইন বলেন, 'প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে নিয়মিতভাবে কর্মপরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য ঠিক করা হয়েছে নতুন কর্মপদ্ধতি। একটি প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান হচ্ছে মানবসম্পদ। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতেই কর্মীদের নিরাপত্তা এবং তাদের মনোভাবকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য নিশ্চিত করার।'

মূলত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অফিস কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জোরোসোরে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে ব্র্যাকের প্রশাসন বিভাগ। এক্ষেত্রে তারা মোটাদাগে পাঁচটি ধাপ অনুসরণ করেছিলেন নতুন কর্মপদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য।

১. আলোচনা: পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন ব্র্যাকের প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তারা। প্রধান কার্যালয় বন্ধ থাকলেও প্রতিদিনই পরিস্থিতির সবশেষ অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন দলগতভাবে। কোভিড সংক্রমণে সামনের সারির দেশগুলোর অভিজ্ঞতাগুলোর দিকে নজর রেখে পর্যালোচনা করেছেন দেশীয় বাস্তবতা। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছেন। খোলামনে নিজেদের মধ্যে সেসব বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা চালিয়ে গেছেন।

২. সমস্যা নির্ধারণ: সার্বক্ষণিকভাবে সুচারু বিশ্লেষণের পর নির্ধারণ করেছেন দেশের পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রে কী কী চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। সময়ের আগেই উদ্ভুত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টায় নজরদারি করা হয়েছে সব সময়। প্রতিটি সমস্যাকে ডকুমেন্টেশনের পাশাপাশি বহির্বিশ্বের দেশগুলো তা সমাধানে কী কী উপায় অবলম্বন করছে তা খুব গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

৩. সিদ্ধান্ত গ্রহণ: সমস্যা চিহ্নিত করার পর সমাধানের উপায় খোঁজা হয়েছে। এক্ষেত্রে অনলাইন জরিপ করে কর্মীদের মতামত নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রোগ্রামের সমন্বয়ে গঠিত ক্রসফাংশনাল কমিটির মাধ্যমে সমাধানের জন্য গ্রহণ করা হয় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত।

৪. বাস্তবায়ন: যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে রিহার্সালের মাধ্যমে তা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে আসলেই বাস্তবায়ন যোগ্য কি না।

৫. পর্যালোচনা: সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে তো বটেই, বাস্তবায়নের পরও বারবার গৃহীত সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে। প্রতিটি নতুন বিষয়ের কার্যকরিতা পর্যালোচনা করতে মনিটরিং টুলস, অনলাইন সার্ভে ও সরাসরি মতামত গ্রহণসহ অবলম্বন করা হয় বিভিন্ন পন্থা।

আহমেদ নাজমুল হুসেইন জানান, গত চার মাসের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন— এই প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে নতুন বাস্তবতাতে এসে এখনো পর্যন্ত বড় কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। পাশাপাশি সরকারি নির্দেশনা শতভাগ মেনেই প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে।

একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে গত ৫ জুলাই থেকে হেড অফিস খোলার সিদ্ধান্ত নেয় ব্র্যাক। সেক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি সুচারুভাবে বিশ্লেষণের পর নতুন পৃথিবীর জন্য নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে পরিচালন ব্যবস্থা। যথারীতি কর্মীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। ব্র্যাকের হেড অব সিকিউরিটি মেসবাহ-উন নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তুলে ধরা হলো নতুন বাস্তবতায় অফিস কার্যক্রম শুরুর জন্য নেওয়া উদ্যোগগুলো।

রোটেশনাল ডিউটি

প্রতিটি ফ্লোরের ধারণক্ষমতা বিবেচনা করে কাজের সময় সর্বোচ্চ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে চালু করা হয়েছে রোটেশনাল ডিউটি। এই প্রক্রিয়ায় প্রধান কার্যালয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭৫ শতাংশ কর্মীর উপস্থিতি কমিয়ে রোটেশন ভাগ করে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কর্মী একদিনে অফিসে আসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যাতে কাজ করার সময় কর্মীরা কোনোভাবেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে না পড়েন। বাকি ৭৫ শতাংশ বাসা থেকে নিয়মিত কাজ করে যাবেন। এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক কর্মীরা ছাড়া বাকিরা সপ্তাহে সর্বোচ্চ তিন দিন অফিসে আসতে পারবেন। এ লক্ষ্যে অফিস শুরুর প্রায় দুসপ্তাহ আগে থেকেই প্রত্যেক কর্মীর মতামতের ভিত্তিতে প্রোগ্রামগুলো নিজেদের ডিউটি রোস্টার তৈরি করে। এছাড়া যাদের বয়স ৫০-এর ওপরে অথবা কোভিড-১৯-এর লক্ষণ আছে, শিশুকে বুকের দুধ পান করাচ্ছেন—এমন মায়েরা বা বাসা লকডাউন এলাকার মধ্যে এমন কর্মীরা অফিসে না গিয়েও কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন আগের নিয়মেই।

ট্রান্সপোর্ট

কোনো কর্মীকে অফিসে আসতে যেন গণপরিবহন ব্যবহার করতে না হয়, এ জন্য আগেই অনলাইন জরিপের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে কারা অফিস ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করবেন আর কারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অফিসে আসতে চান। সেক্ষেত্রে প্রতিটি গাড়ির চালককে আগেই প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ব্যবহারকারীদের জন্যও তৈরি করা হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। যেমন, গাড়িতে উঠে প্রত্যেককে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। গাড়ির ভেতরে যদি কেউ বসার জায়গা বা অন্য কোথাও স্পর্শ করেন, সেজন্য প্রতিটি গাড়িতে সরবরাহ করা হয়েছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। প্রতি ট্রিপের পর গাড়ি ধুয়ে-মুছে জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সব গাড়ি একই সময় যেন হেড অফিসে এসে না পড়ে সেজন্য আলাদা আলাদা সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে; যাতে অফিসের সামনে নামার পর কর্মীদের জটলা তৈরি না হয়।

ভবনে প্রবেশ

কার্যালয়ের প্রবেশমুখেই তৈরি করা হয়েছে জীবাণনাশক গালিচা। যেটির ওপর দিয়ে হেঁটে গেলে জুতা জীবাণুমুক্ত হয়ে যাবে। অফিসের যারা প্রবেশ করবেন তাদের প্রত্যেকের শরীরের তাপমাত্রা মাপার জন্য থার্মালগান নিয়ে সর্বদা উপস্থিত আছেন সুরক্ষাকর্মীরা। এই সব নিয়মকানুন মেনে একজন কর্মী লিফটের সামনে পৌঁছবেন।

লিফটের ব্যবহার

স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি লিফটের ধারণক্ষমতা ১৬ জন। কিন্তু এই সময়ে প্রতিবারে লিফটে চার জনের বেশি উঠতে পারবেন না। সামাজিক দূরত্ব বাড়াতে আপাতত কোনো লিফটম্যান থাকছেন না। যারা লিফট ব্যবহার করবেন, তারা লিফটের ফ্লোরে আঁকা চিহ্ন অনুযায়ী দাঁড়াবেন, যেন দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি একে অন্যের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ তৈরি না হয়। প্রতিবার লিফট ব্যবহারের পর সুরক্ষাকর্মীরা লিফটের বাটন ও ফ্লোর ডিজইনফেক্ট করতে থাকবেন।

ফ্লোরে প্রবেশ

লিফট থেকে নামান পর প্রতি ফ্লোরের প্রবেশ দ্বারে রাখা আছে জীবাণুনাশক ট্রে। যার ওপরে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢুকলে জুতা থেকে জীবাণু ছড়ানোর আশংকা আরও কমে যাবে। প্রতিটি ফ্লোরে কর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা আছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। যাতে কিছুক্ষণ পর পর কর্মীরা হাত জীবাণুমুক্ত করে নিতে পারেন।

কর্মীদের জন্য নির্দেশনা

অফিসে প্রত্যেক কর্মী নির্ধারিত স্থানে বসে কাজ করার সময় মাস্ক পরে থাকবেন। নতুন নিয়মকানুন সম্পর্কে কর্মীদের অবগত করতে অনলাইন ওয়ার্কপ্লেসে তৈরি করা হয়েছে নির্দেশনা সংবলিত ভিডিও কনটেন্ট। যা থেকে প্রত্যেকে সুরক্ষা নির্দেশনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন। এছাড়া সেন্ট্রাল অডিও সিস্টেমের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় নির্দেশনাগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলা ও ইংরেজিতে প্রচার করা হয় ফ্লোরেগুলোতে।

সুরক্ষা সামগ্রী

অফিস থেকেই সবার জন্য নিয়মিতভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বাধ্যতামূলক সুরক্ষাসামগ্রী।

মিটিং

এই সময়টাতে কোনো কর্মী অফিসে গেলেও এক জায়গায় অনেকে বসে মিটিং করতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষ প্রয়োজনে ফোনে বা অনলাইনেই মিটিং চলছে নিয়মিতভাবে।

খাবারের ব্যবস্থা

দুপুরে খাবারের জন্য ক্যান্টিন পরিচালনার ক্ষেত্রেও আনা হয়েছে পরিবর্তন। ক্যান্টিনে ভিড় কমাতে খাবার সরবরাহের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে এবং সেখানেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য নেওয়া হয়েছে নানা ব্যবস্থা। প্লেটের বদলে ডিসপোজেবল বক্স ব্যবহার করা হচ্ছে খাবার পরিবেশনের জন্য। খাবারের ধরনের মধ্যেও আনা হয়েছে পরিবর্তন। রেগুলার খাবার যেমন- ভাত, মাছ, মাংস ও সবজির পাশাপাশি বার্গার, স্যান্ডউইচ-এর মতো ফাস্টফুড সংযোজন করা হয়েছে মেন্যুতে। এমন কি বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো কর্মী চাইলে খাবার অর্ডার করতে পারবেন এবং খেতে পারবেন কাজের জায়গাতে বসেই। এজন্য একটি সফটওয়্যার ইন্সটল করা হয়েছে, যার মাধ্যমে কর্মীরা ওয়ার্কপ্লেসে ঢুকে অনলাইনেই খাবারের টোকেন কিনতে পারবেন।

ওয়াশরুম ব্যবহার

কর্মীদের কাজের জায়গায় বসার আগে সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসার জন্য নির্দেশনার মাধ্যমে উৎসাহিত করা হচ্ছে। নিয়মিত সুরক্ষা কর্মীর মাধ্যমে ডিজইনফেক্ট করার পরও ওয়াশরুমগুলোতে রাখা হয়েছে জীবাণুনাশক স্প্রে। যাতে কেউ চাইলে ওয়াশরুম ব্যবহারের আগে ও পরে নিজেই স্প্রে করে সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে নিতে পারেন।

সুরক্ষাকর্মী নিয়োগ

ভবন ও প্রতি ফ্লোরের জন্য রয়েছেন নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রশিক্ষিত সুরক্ষাকর্মী। যারা প্রতিনিয়ত নিশ্চিত করছেন স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ। কর্মীরা ফ্লোরে বা ভবনে প্রবেশের আগে পরে তো বটেই এমনকি অফিস চলাকালীন সময়েও কিছুক্ষণ পরপর জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে ডেস্ক, দরজার হাতল, ফ্লোর ও লিফটের বাটন থেকে শুরু করে কর্মীদের সংস্পর্শে আসতে পারে এমন সম্ভাব্য প্রতিটি বস্তু ও স্থান।

মনিটরিং

নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়। যেমন: প্রতিটি ফ্লোর ও প্রোগ্রামগুলোতে কর্মীদের উপস্থিতি অফিস নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করছে কিনা—তা মনিটর করতে প্রধান কার্যালয়ে প্রতিদিন স্টাফ অ্যাটেনডেন্স স্টেটমেন্ট তৈরি করা হয়। এছাড়া অফিস চলাকালীন সময়ে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবিধিসমূহ সঠিকভাবে মেনে চলা হচ্ছে কিনা—সে বিষয়টি সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে রয়েছে একটি বিশেষ সারভেইলেন্স টিম।

বিশেষ পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনা 

প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য হেড অফিসে সব ধরনের লজিস্টিকের পাশাপাশি ৬০ সদস্য বিশিষ্ট একটি দল ২৪ ঘন্টা প্রস্তুত থাকে। কোনো কারণে হেডকোয়ার্টার্স সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী রেড জোন এলাকার মধ্যে পড়ে গেলে ভবনের অপরিহার্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এই টিমটির থাকা, খাওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে প্রধান কার্যালয়ের মধ্যেই।

সরকারি নির্দেশনা

অফিস খোলা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা ও সরকারি বিধিনিষেধ মানা হচ্ছে কঠোরভাবে। পাশাপাশি ব্র্যাকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, বিশেষজ্ঞদের মতামত ও দেশীয় বাস্তবতায় উপযোগী বৈশ্বিক চর্চাগুলোকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

কর্মীর মতামত

কর্মীর মতামতকে অগ্রাধিকার দিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত প্রণয়নের আগেই অনলাইন জরিপের মাধ্যমে সবার মতামত নেওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগের মতামতের ভিত্তিতেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে নতুন নিয়ম। এমনকি খাবারের মেন্যু নির্ধারণের মতো ছোট-ছোট সিদ্ধান্তগুলোর জন্যও কর্মীদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব কিছু বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। গত তিন-চার মাসে অন্তত এ বিষয়টি বুঝে গেছে বাংলাদেশের মানুষ। করোনাভাইরাসকে ভয় করলে চলবে না। আবার অসতর্ক থেকে জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলারও সুযোগ নেই। 'নিউ নরমাল' যুগে কাজের জন্য তৈরি হয়েছে নতুন বাস্তবতা, নতুন পরিবেশ। তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রয়োজন হবে উদ্ভাবনী মনোভাব এবং নতুন-নতুন পদ্ধতির। আর সেই পদ্ধতিগুলো খুঁজে বের করতে হবে সম্মিলিত ভাবেই। প্রতিনিয়ত বাস্তবতাকে বুঝে, করোনাভাইরাসকে জয় করার উপায় বের করতে হবে আমাদেরকেই। পুরো বিশ্বই সে চেষ্টা করছে, বাংলাদেশকেও শামিল হতে হবে একই প্রচেষ্টায়। এক্ষেত্রে শুধু সরকার বা ব্যক্তি পর্যায়েই নয়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে স্ব-স্বমহিমায়।