সম্প্রীতিরক্ষার এসিড টেস্টে বিজেপি সরকার

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 6 July 2011, 04:57 AM
Updated : 9 Feb 2015, 08:18 AM

''মুসলিমদের অবস্থা দলিতদের চেয়েও খারাপ। ভারতীয় মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব শুধুমাত্র জেলখানাতেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রয়েছে।''

[Muslim condition is worse than that of Dalits. The only 'sector' where Indian Muslims are more than adequately represented in jail.]

ভারতের মুসলিমদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থার প্রেক্ষিতে ভারতীয় নিবন্ধকার Dr. S. Ausaf Saied Vas এর এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশের কিছু নেই।

কয়েক বছর আগে ভারতের মুসলিমদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য ভারত সরকার এক বিশেষ কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার। তাঁর নেতৃত্বে কমিটি ভারতজুড়ে ছড়িয়ে থাকা মুসলিমদের উপর বিশদ সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় যে সব ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছিল তা হল, মুসলমানরা কী ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত; তাদের বার্ষিক আয় কত; শিক্ষাগত যোগ্যতা কেমন; সরকারি চাকরিতে প্রবেশগম্যতা কেমন; সরকারি সাহায্য, ব্যাংকের ঋণপ্রাপ্তির হার; কী ধরনের আবাসিক এলাকায় থাকেন; পানি, বিদ্যুত, রাস্তাঘাটের সুবিধা কেমন পান; সম্পত্তি বা জমিজমার মালিকানার পরিমাণ কেমন ইত্যাদি।

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চালানো সমীক্ষার পর কমিটি একটি বিশদ রিপোর্ট তৈরি করে। রিপোর্টটি বেশ খুটিনাটি বিষয়ও জনসমক্ষে নিয়ে আসে। প্রায় ৪৫০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পর ভারতের সকল মহলে বেশ সাড়া পড়ে যায়। আলোচনার ঝড় উঠে দেশজুড়ে। পত্রিকাগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়ে মুসলিম বঞ্চনার কথা তুলে ধরে অনেক রিপোর্ট করে।

সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী মুসলমানদের চাকরির চিত্র–

[সূত্র:

সাচার রিপোর্ট: মুসলিমদের বঞ্চনার দলিল; সন্তোষ রাণা]

পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস যে ভারতে, তাতে মুসলিমদের সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক দৈন্যতা, কর্মসংস্থানে অস্তিত্বহীনতা এবং রাজনৈতিক শক্তিহীনতার যে চিত্র পাওয়া যায়, এর প্রেক্ষিতে অন্যান্য জন-জাতির অবস্থা কেমন তা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধর্মান্তর নিয়ে যে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে তার প্রেক্ষিতেই এই পুরোনো পরিসংখ্যানের কাসুন্দি ঘাঁটা। ধর্মান্তর বিতর্ক বিজেপি সরকারের সম্প্রীতিরক্ষার এসিড টেস্ট।

সাম্প্রতিক ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আগ্রায় ধর্মান্তরকরণের ঘটনাটি ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ৫০টির মতো অতিদরিদ্র মুসলিম পরিবার– যারা রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ কুড়িয়ে, ময়লা বেচে কায়ক্লেশে জীবিকা নির্বাহ করে– সপরিবারে প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু ধর্মে 'ফেরত এসেছে'। এখানে লক্ষ্যণীয় ফেরত আসার বিষয়টি। এর অর্থ, কোনো এক সময়ে এরা সবাই হিন্দুই ছিলেন। সম্ভবত অভাবের তাড়নাতে, একটু স্বচ্ছলতার আশায় ওরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, কিন্তু ওদের পুনঃধর্মান্তরই বলে দিচ্ছে, সে আশা পূরণ হয়নি।

ওরা যে সপরিবারে হিন্দু হলেন, সেটা মোটেও ঐহিক তাড়না ত্থেকে নয়, জাগতিক বাসনা থেকেই। ধর্মান্তরের এই কার্যক্রম বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ইত্যাদি কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন যতই 'ঘরে ফেরা' বলে এই পুনঃধর্মান্তরকরণের প্রচারের ঢাক পেটাক, আসল ঘটনা হল, ওদেরকে বিপিএল রেশন কার্ড পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কাজেই এ যদি 'ঘরে ফেরা'-ই হয়, তাহলে ওরা ঘর ছেড়েছিলেন পেটের দায়ে, আবার ফিরেও এলেন সেই পেটের দায়েই! ওদের কেউ কেউ পরে সাংবাদিকদের এমনও বলেছেন যে, ধর্মান্তরকরণের ব্যাপারটা তাদের কেউ আগে থেকে বলেনইনি। অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে বলা হয়েছিল, ওই অনুষ্ঠানে গেলে তাদের পেটপুরে খেতে দেওয়া হবে!

ধর্মান্তর শুধু মুসলিমদেরই ঘটেনি, অন্যান্য ক্ষুদ্র জনজাতির ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ধর্মীয় জাগরণ বিভাগ রীতিমতো ঘোষণা দেয়, যেসব দলিত এক সময় হিন্দু ছিলেন তাদের আবার নিজ ধর্মে, অর্থাৎ হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনা হবে। এ জন্য উত্তর প্রদেশের আলীগড় থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে একটি শহরের চার্চকে রাতারাতি শিবমন্দিরে পরিণত করে ৭২ জন দলিত বাল্মীকী সম্প্রদায়ের মানুষকে 'শুদ্ধিকরণ' অনুষ্ঠানের দ্বারা আবার হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনা হয়। চার্চ থেকে পবিত্র ক্রুশ চিহ্ন খুলে নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় শিব মন্দির।

'আরএসএস' প্রধান মোহন ভগত গত আগস্ট মাসে মহারাষ্ট্রের কটকে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন: ''ভারত একটি হিন্দু দেশ এবং এর পরিচিতি 'হিন্দুত্ব'। একমাত্র হিন্দুত্ববাদের মধ্যেই সব ধর্মকে সমন্বিত করা সম্ভব।''

ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা যদি 'ইংলিশ', জার্মানির অধিবাসীরা 'জার্মান' এবং যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরা 'আমেরিকান' হিসেবে পরিচিত হতে পারে, তাহলে হিন্দুস্তানের অধিবাসীরা 'হিন্দু' হিসেবে পরিচিত হতে পারবে না কেন এই প্রশ্ন তিনি তুলেছেন। তার মতে, হিন্দুত্বই ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখার একমাত্র ভিত্তি। তিনি আগামী পাঁচ বছরে হিন্দুদের সমতা বিধানের লক্ষ্যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মসূচির উল্লেখ করে আরও বলেছেন, এই সংগঠন হিন্দুদের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করবে। সব হিন্দু এক জায়গায় পানি পান করবে। এক স্থানে বাজার করবে এবং মৃত্যুর পর তাদের দেহ দাহ করা হবে এক জায়গায়।

ধর্মীয় জাগরণ বিভাগের প্রধান খেম চন্দ্র সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, হিন্দু সমাজকে আমরা ছিন্নভিন্ন হতে দিতে পারি না। শক্ত করে আগলে রাখতে চাই। তথাকথিত 'শুদ্ধিকরণ' অনুষ্ঠানে জড়ো হওয়া একজন দলিত বাল্মীকী সংবাদমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেন, বাস্তবিকই তারা আগে ছিলেন দলিত হিন্দু। কিন্তু হিন্দু সমাজে জাত-পাতের লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে তারা খ্রিস্টান হয়েছিল নিজেদের ভাগ্যোন্নতির আশায়। সেটা না হওয়ায় আবার তারা হিন্দুত্বে ফিরে এসেছেন।

ধর্মান্তর কোনো নতুন বিষয় নয় এই উপমহাদেশে। মধ্যযুগের ইতিহাসে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ধর্মান্তররের ভুরি ভুরি উদাহরণ দেখা যায়। ইতিহাসের ভাষ্য এই যে, কখনও নিজ ধর্মে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বা প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে কিংবা ঐহিক দারিদ্র থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার আশায় অথবা পারমার্থিক মোক্ষলাভের প্রত্যাশায় মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছে। আবার স্বেচ্ছায় পরধর্ম গ্রহণের পাশাপাশি অনেক বেশি মাত্রায় ঘটেছে বলপূর্বক ধর্মান্তর। তাতে রক্তক্ষরণও ঘটেছে। মধ্যযুগের জীবন আমরা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। কিন্তু ধর্মান্তরের ইতিহাস খুব বদলায়নি।

ধর্মান্তরের এই উথাল পাতাল ডামাডোলে আর্চবিশপ অনিল জে টি কাউটো ২৪ ডিসেম্বর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রদেশে খ্রিস্টান ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজনকে যেভাবে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে, তাতে তাঁরা প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন। তাঁরা বলেন, বেশ কিছু উগ্র হিন্দু সংগঠন ধর্মান্তরকরণের এই কর্মসূচির নাম দিয়েছেন 'ঘর ওয়াপসি' বা আপন ঘরে ফেরা। নানা প্রলোভন দেখিয়ে গরিব মানুষদের তারা হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনছে। এর ফলে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে তাঁরা বলেন, শিগগিরই কোনো পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে।

ধর্মান্তরকরণ নিয়ে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের শেষ সপ্তাহে রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রীর নিরবতায় সংসদের কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটায়। সংসদে কেন তিনি মৌন ছিলেন, আর্চবিশপ ও তাঁর সঙ্গীরা তা জানতে চাইলে মোদী তাদের বলেন, তিনি অন্য প্রধানমন্ত্রীদের থেকে ভিন্ন। তিনি জানান, আপনাদের পছন্দ হোক না হোক, সবাইকে নিয়ে সবার জন্য আমি কাজ করে যাব। আর এটা বড় কোনো সমস্যা নয় বলেও তিনি প্রতিনিধিদের আশস্ত করেন।

কিন্তু ভারতের বাস্তবতা ভিন্ন। এই ধর্মান্তর কার্যক্রমের পিছনে রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। উত্তর প্রদেশে ডজন খানেক বিধানসভা আসনে উপ-নির্বাচন কিছু দিন পরেই। এরপর, ২০১৭ সালে বিধানসভা নির্বাচন। হিন্দু ভোট ধরে রাখতে ধর্মীয় মেরুকরণই বিজেপির স্ট্র্যাটেজি। ধর্মীয় জাগরণ বিভাগের প্রতিনিধি জানান, পশ্চিম উত্তর প্রদেশে দলিতদের সংখ্যা বেশি– যেমন, আলীগড়, আগ্রা, মিরাট ও মুজফ্ফরনগরে তারা বেশি সক্রিয়। দলিত জনগোষ্ঠীতে পড়ে চামার, বাল্মীকী, মেথর ও অন্যান্য নিচু জন-জাতি। এদের সবাইকে বিজেপির ছাতার নিচে আনতে পারলে দলিত ভোট বিজেপির ঝুলিতে আনা সম্ভব হবে।

এতে এক ঢিলে অনেক পাখি মারা যাবে; মুলায়েম সিং-এর সমাজবাদী পার্টি এবং মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি। মায়াবতীর দলিত পার্টি বহুজন সমাজ পার্টি হালের সাধারণ নির্বাচনে পানি পায়নি। রাজ্যে তার দলের অবস্থান কার্যত ধুয়ে মুছে গেছে। দলিত ভোট ব্যাংকে যাতে বিজেপি ভাগ বসাতে না পারে তার জন্য গৈরিক ব্রিগেডকে আটকাতে মায়বতী নিজের দলীয় নেতাদের সতর্ক থাকতে বলেছেন। বলেছেন, দলিত ভোট ভাগ করে হাতছাড়া হতে দেওয়া হবে না।

আবহমানকাল ধরে ভারতে হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্য বহুত্ববাদের মধ্যে নিহিত। সম্রাট আকবরের দীন-ই-ইলাহী থেকে শুরু করে সম্রাট অশোকের সর্বধর্ম সমন্বয়ের মতাদর্শ ভারতীয় ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসছে। এই অঞ্চলে আর্যরা আসার আগে থেকেই ভারতীয় সভ্যতা ছিল বলে জানিয়েছেন ক্ষিতিমোহন সেনের মতো দার্শনিক। আর্যরা আসার পরে নানা সংমিশ্রণ, সংযোজন হয়েছে। বর্তমান ভারতে রাজনৈতিক একদলীয় শাসন হলেও ভারতীয় সমাজের সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ কিন্তু থেকেই গিয়েছে। তাই হিন্দু সত্তাকে একটি একক সত্তা হিসেবে গ্রহণের প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে সে সন্দেহ থেকেই যায়।

বরং যদি সময়ের হাত ধরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি বদলানো সম্ভব হয়, সর্বধর্ম সমন্বয়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, তাতে হয়তো হিন্দু জাতীয়তাবাদেরও অস্তিত্ব সুরক্ষিত হবে, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুসংহত করবে ।

এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।