নারী নির্যাতন প্রতিরোধের অন্বেষাঃ চাই সমাজ মনস্তত্ত্বে পরিবর্তন

দেওয়ান মাহমুদ
Published : 7 Jan 2013, 08:34 AM
Updated : 7 Jan 2013, 08:34 AM

বিডিনিউজ২৪.কম ব্লগে আমার লেখা প্রথম পোস্টটি প্রকাশিত হয় ২রা জানুয়ারী, ২০১৩। লেখার শিরোনাম ছিলো – "কাঁদছে মানবতা, গর্জে ওঠো বাংলাদেশঃ ধর্ষনকারীদের প্রকাশ্যে ফাঁসি চাই"। এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক পাঠক লেখাটি পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন ২৩ জন পাঠক/ব্লগার। এ লেখোর শুরুতে তাঁদের সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

তবে গভীর দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে নতুন বছর ২০১৩'র দ্বিতীয় দিনে লেখাটি প্রকাশ হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত পঞ্চম দিন অতিবাহিত হলেও ধর্ষনসহ নানাবিধ নারী নির্যাতন বাংলাদেশে সামান্যতম বন্ধ তো হয়ই নি, উল্টো ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আজকের প্রথম আলোতে তিনটি ধর্ষনের এবং একটি এসিড নিক্ষেপের খবর চোখে পড়ল। উল্লেখ্য, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশের সহযোগিতা পাচ্ছেন না নির্যাতিত মেয়েটি বা তাঁর পরিবার। খবরগুলে পড়ে রাগ, ক্রোধ আর নিজের সমাজের প্রতি আক্রোশই কেবল বাড়ছে। কী করবো আমরা, জাতি হিসেবে, সমাজ হিসেবে, রাষ্ট্র হিসেবে কোথায় যাবো? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এই দেশ? ভাবতেই কেমন জানি ভয় মনে দানা বাঁধে।

বিভিন্ন মফস্বলে এবং গ্রাম এলাকাগুলোতে এসব অপরাধ তো ঘটছেই। শহরগুলোতে এমনকি খোদ রাজধানীতেও এখন প্রায়শঃই ভয়াবহ নির্যাতনের খবর দেখতে পাচ্ছি আমরা। গত শুক্রবার অর্থাৎ জানুয়ারী মাসের চার তারিখ ঢাকায় মীরপুরের শাহ আলী থানাধীন এলাকায় সন্ত্রাসী রাজু, খোকন এবং ইসমাইল মাত্র ১০ বছর বয়সী এক শিশুকন্যাকে ধর্ষনের পর হত্যা করে রেখে যায়। থানায় মামলা হলেও পুলিশ নাকি এখনো 'অপরাধীদের খুঁজে পাচ্ছে না'। এখানে যদি ঐ অপরাধীদের ধরতে পুলিশ ইচ্ছাকৃত কার্পণ্য বা শৈথিল্য করে তাহলে একথা বলতেই হবে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারাও সমান অপরাধে অপরাধী। কারণ, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে প্রশ্রয় দেয় তারা উভয়ই সমান অপরাধে অপরাধী।

পূর্বেকার লেখাটির উপর করা কয়েকটি মন্তব্য পড়ে খুব দুঃখ পেয়েছি এই কারণে যে বিডিনিউজ২৪.কম ব্লগের সচেতন পাঠক বা ব্লগারদের (মন্তব্যকারীদের) কেউ কেউ মনে করছেন যে এসব জঘন্য অপরাধ বা নারী নির্যাতনের জন্য কেবল পুরুষরাই দায়ী নয়। কয়েকজনের মন্তব্যে দেখলাম নারী যদি ঠিকমতো পর্দা করে তাহলে, তাঁদের ভাষায়, এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে না। বলা বাহুল্য, এসব মন্তব্য যাঁরা করেছেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নারীও আছেন। ভাবতে অবাক লাগে এই কারণে যে একটি সাধারণ বিষয় এখনো সবার কাছে পরিস্কার নয়। যে ছেলেটি বা পুরুষটি কোন মেয়েকে ধর্ষন করার মতো হীন, জঘন্য ও বর্বর মানসিকতা পোষণ করে সে যে কোন অবস্থায়, বা মেয়েটি যে কোন পোশাকেই থাকুক না কেন, তাকে ধর্ষন করবে। ২০০০ সালের কোন এক সময়ে ঢাকা সফররত এক জার্মান বন্ধুকে সতর্বক করতে গিয়ে বলেছিলাম, "ঢাকার রাস্তায় রাতের বেলা একা ঘোরাফেরা করছো, কিন্তু এরকম ইউরোপীয় কায়দায় কেবল জীন্স আর ফতুয়া পড়ে থেকোনা, অন্ততপক্ষে একটি ওড়না ব্যবহার করো।" জবাবে ঐ তরুণী জার্মান বন্ধুটি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, "ইজ ইট ওনলি বিক'জ দে (মেল) কান্ট সি মাই ব্রেস্ট? উইল ইট প্রটেক্ট মি ফ্রম বিং রেপড?" পাল্টা এ প্রশ্নের আর কোন প্রতুত্যর আমি দিতে পারিনি। মনে পড়ছে, তার কাছে হয়ত ঐ তথ্যটি ছিলো যে, ঢাকায় একবার ভ্যানিটি ব্যাগ চুরি হবার বিষয়ে পুলিশে ডায়েরী করতে গিয়ে এক বৃটিশ তরুণী গুলশান থানায় এক পুলিশ কর্তৃক ধর্ষনের শিকার হয়েছিলেন। সাহসী ঐ ইংরেজ নারী তৎকালীন বৃটিশ হাই কমিশনারের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ মহলে অভিযোগ জানানোতে বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে আসে। বিবিসি খবরটি ফলাও করে প্রচার করেছিল। কালপ্রিট ঐ পুলিশের কী হয়েছিল, বা আদৌ তার কোন শাস্তি হয়েছিল কি না তা জানা যায়নি। হয়ে থাকলেও হয়তো তা গোপন রাখা হয়েছিল।

ঠিক এভাবেই, বারংবার ধর্ষনকারীদের অপরাধকে ছোট হিসেবে দেখে আমরা, এ সমাজ, এ রাষ্ট্র এইসব জঘন্য অপরাধ সংঘটনে পরোক্ষভাবে মদদ যোগানোর অপরাধ করি। যদি ঐ পুলিশের প্রকাশ্যে ফাঁসি হতো আর রাষ্ট্র তা ফলাও করে প্রচার করতো, তাহলে হয়তো এ ধরনের অপরাধ সংঘটনে পুলিশ কেন, এদেশের কেউই আর সাহস পেতো না। কিন্তু মনে করে দেখুন, দিনাজপুরের ইয়াসমীন, চট্টগ্রামের সীমাসহ কত অসহায় মেয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাঝে লুক্কায়িত ধর্ষনকারীদের শিকার হয়েছে। তাদের কারোই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। দু-একটি ক্ষেত্রে মামলা প্রমাণ হলেও তা হতে বছরের পর বছর পেরিয়ে গেছে। জনমত, আন্দোলন, নারী অধিকার গ্রুপ, সিভিল সোসাইটি সবাই ধীরে ধীরে ভুলে গেছে ঐ সব জঘন্য অপরাধীদের কথা। তাদের কেউ কেউ হয়তো আইনের ফাঁক-ফোকর গলে জামিনে বেরিয়ে এসে বা বিচারে খালাস পেয়ে প্রকাশ্যে আবার বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো আবার কোন নারীর সর্বনাশ করছে। আর এ সমাজে, এ রাষ্ট্রে প্রতিনিয়িত অসংখ্য ঘটনার ভিড়ে চাপা পড়ছে তাদের অপকীর্তির খবরগুলো। আজ গার্মেন্টেসে আগুন, শেয়ার বাজার লোপাট, হলমার্ক কেলেংকারী, পদ্মা সেতুর বলির পাঁঠারা গ্রেপ্তার, স্কাইপি কেলেংকারী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফোনরঙ্গ, কাল হরতাল, পরশু কুপিয়ে বিশ্বজিৎ হত্যা, তারপরদিন ইলিয়াস আলী গুম, এরপর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশকে নিয়ে উপহাস করা মন্তব্য, মুসা বা ওয়াসফিয়ার পর্বতারোহন, ডেসটিনির প্রতারণা, উদ্ভট নায়ক অনন্ত জলিলের কিম্ভুতকিমাকার সাক্ষাৎকার, জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধি, সরকারের চার বছরপূর্তি, কৃষিতে সাফল্য, পাটের জীন গবেষণা, ঈদে দেশজুড়ে ভয়াবহ ট্র্যাফিক জ্যাম, এরপর আবার মেঘনায় নৌকাডুবিতে ১৫০ জনের প্রাণহানি – এসকল বিভিন্ন খবরের আড়ালে চাপা পড়ে যাবে 'কয়েকজন' নারীর উপর নির্যাতনের খবর। সবাই ভুলে যাবে কী বিভৎস ও নির্মমভাবে পাষন্ড নরপশু রাজু, খোকন, ইসমাইলেরা নির্যাতনের পর হত্যা করেছে মিরপুরের ঐ ছোট্ট দশ বছরের মেয়েটিকে আর কতো অসহায় হয়ে তার মা-বাবা আজ পুলিশ থেকে শুরু করে সমাজের প্রভাবশালীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ন্যায়বিচার পাবার আশায়। সবাই হয়তো ক'দিন পরই ভুলে যাবে কতটা পাশবিক আর ভয়্ংকর নির্যাতনের শিকার হয়েছে টাঙ্গাইলের নবম শ্রেণীর ঐ স্কুলছাত্রী যে এখন ডিএমসি'র ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে লড়ছে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, যার মানসিক অবস্থা প্রায় বিকল হয়ে যেতে বসেছে। কিংবা চিন্তা করে দেখুন এখন কি আমরা কেউ ভেবে দেখছি বা আলোচনা করছি কি না, কতোটা বর্বরতার শিকার হয়েছিলো ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের ঐ কোমলমতি ছাত্রীটি, যে পরিমল জয়ধর নামক এক শিক্ষকরূপী নরপশুর লাম্পট্যের, বর্বরতার আর ইন্টারনেট কুপ্রচারের শিকার হয়ে সর্বস্বাস্ত হয়ে বিচারের জন্য লড়ছে।

এই সব ঘটনা কেবলই প্রমাণ করে যে এ সমাজ নষ্ট হবার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে – যে সমাজে নির্যাতিত নারী লজ্জিত হয়ে কুঁকড়িয়ে চলে, আর মুখ গুঁজে ডুকরে কাঁদে বিচারের জন্য। এ সেই সমাজ যে সমাজের বিরাট অংশের অভিভাবকরা মনে করেন, তাঁদের মেয়েরা পর্দানশীল নয় বলেই ছেলেদের টিটকারী খায় বা বেশী ফাস্ট বলেই ধর্ষনের শিকার হয়। এ সমাজ সেই সমাজ, যে সমাজে বাবা ও মায়েরা তাদের পুরুষ সন্তানদের মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখান না, কেবল মেয়েদেরই সৎ 'উপদেশ' দেন বা শাসান, "বাইরে যেও না, ছেলেদের নজর লাগবে।" কিন্তু একবারও এসব পিতা-মাতারা/অভিভাবকরা চিন্তা করেন না, তাঁদের গুণধর ছেলেটিই পাড়ার আর কয়েকজন বখাটে ছেলের সাথে মিশে দোকানের সামনে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হয়তো অন্য কোন বাড়ীর স্কুল পড়ুয়া মেয়েটিকে উত্যক্ত করছে, অশ্লীল ভঙ্গিমায় গান গাইছে। হয়তো সুযোগ পেলে সেও ধর্ষনকারীর মূর্তি নিয়ে আবির্ভুত হবে অন্য কোন মা-বাবার কন্যা সন্তানের উপর। ই সমাজের পরিণতি কী হবে তা অনুমান করতে পিএইচডি ডিগ্রীর দরকার আছে কি?

এইসব দুর্বত্ত-সন্ত্রাসী রাজু, খোকন, ইসমাইলের মতো ভয়ন্কর অপরাধীরা, এইসব পরিমল জয়ধর নামক নরপশুরা, এইসব পুলিশের পোশাক পরা হায়েনারা (সকল পুলিশ নয়, অপরাধী পুলিশ সদস্যদের বলা হচ্ছে মাত্র) আমাদের সমাজের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে। তাই প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষনের মতো ভয়াবহ অপরাধ ঘটেই চলেছে। এদের কঠোরতম শাস্তির পাশাপাশি সমাজের চিন্তা-ধারায়, কথায় ও কাজে, ব্যবহারে আমুল সংস্কার না আসলে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।

তবে একথা ঠিক, এদের বিষয়ে অভিভাবকদের সজাগ থাকতে হবে। বিশেষ করে কন্যাশিশুর পিতা-মাতা ও অভিভাবকবৃন্দকে অনুরোধ জানাবো আপনার আপনাদের কন্যাকে বাড়ীতে একা রেখে কোথাও যাবেন না। দূরে কোথাও বা চোখের আড়ালে একা খেলতে যেতে দিবেন না। এমনকি ঘনিষ্ঠতম বান্ধবীর বাড়ীতেও না। বলা যায় না, কোথায় গিয়ে কোন্‌ পুরুষের নির্মমতার শিকার হবে কন্যা-শিশুটি ! তাই সতর্কতার পাশাপাশি আত্মরক্ষার কৌশলও শেখান মেয়ে শিশুদের। ছোটবেলা থেকেই তাদের মার্শাল আর্ট শিখতে পাঠান। প্রয়োজনে হাতে বা ব্যাগে ক্ষুদ্র অস্ত্র রাখতে বলুন সব সময়, যেন প্রয়োজনের সময় তথা কোন পুরুষরূপী পশু কর্তৃক আক্রান্ত বা ধর্ষিত হবার আশংকা থাকলে বা হামলার শিকার হলে তাকে প্রত্যাঘাত করে প্রতিহত করতে পারে।

সেই সাথে পুত্র সন্তানের পিতা-মাতাদের প্রতি অনুরোধঃ আপনারা আপনাদের গুণধর পুত্রদের অন্যের বোন, ক্লাশরুমের সহপাঠিনী বা পাড়ার অন্য সকল মেয়েদের বা রাস্তায় হাঁটা নারীদের, বাসের সহযাত্রী মহিলা বা ছাত্রীদের তথা সার্বিকভাবে নারীদের সম্মান করতে শিখান, একেবারে শিশুকাল থেকেই। তাহলে ছোট থেকে বড় হবার সময় থেকেই সমাজের পুরুষরা নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখবে। তাদের বিরূদ্ধে অনর্থক কটুমন্তব্য করা, বা সকল ক্ষেত্রে নারীকে প্রতিপক্ষ ভাবা থেকে বিরত থাকতে শিখবে। নারীর বিরূদ্ধে এসব ভয়ন্কর অপরাধ হয়তো কিছুটা কমবে তাতে। আর আইন প্রণেতা, সমাজের নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধিগণ, পুলিশ, বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অনুরোধ রাখছি – ধর্ষনকারীদের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করুন আপনারা। একবার চিন্তা করে দেখুন ঐ অসহায় মেয়েটি তো আপনার মেয়েও হতে পারতো। জঘন্য, হীন ও বর্বর এ সকল পুরুষ বা যুবক বা বালক (সে যে বয়সেরই হোক না কেন, ধর্ষনকারী ধর্ষনকারীই, তার কোন বয়সভিত্তিক আলাদা পরিচিতি থাকতে পারে না) ধর্ষনকারী একবার আপনার কণ্যাকে একলা বা অরক্ষিত অবস্থায় পেলে তার উপরও নির্যাতন করবে। কেড়ে নেবে তার নারীত্বের সর্বোচ্চ অহংকার। ধ্বংস করবে তার মানবিক মর্যাদা। সুতরাং কোন ধর্ষনকারীকেই আপনারা গুরুত্বহীন দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন না। তাদের কঠোরতম ও নির্মম শাস্তি প্রদান কীভাবে করা যায় সে পথ বের করুন। দরকার হলে আইন পরিবর্তন করুন। প্রকাশ্যে সে আইন কার্যকর করুন। শুধু ধর্ষন কেন, রাস্তা-ঘাটে মেয়েদের টিটকারী মারার মতো ঘটনাও যারা ঘটাচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রেও কঠোর হোন আপনারা।

আর ধর্ষনের অভিযোগের ক্ষেত্রে অভিযুক্তর বয়স যদি ১৮'র নীচে হয়, অর্থাৎ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বা শিশু আইনের কারণে সে 'শিশু' বলে গণ্য হয়, তবে সেই সব 'শিশু' পুরুষদের বয়স আইন সংশোধন করে ১৮ থেকে নামিয়ে ১০ বছর করার প্রস্তাব রাখছি। কেননা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে উঠতি বয়সী বালক বা কিশোর ছেলেরা ধর্ষনকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। কিন্তু বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ১৮ বছরের নিচে বয়স হওয়াতে এরা শিশু আইনের সুবিধা নিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। সমাজের মনে রাখা প্রয়োজেন, যে ছেলেটি আজ বালক বা কিশোর বয়সে কোন ছোট মেয়ে বা কিশোরী বা বালিকার সর্বনাশ করার মতো ভয়াবহ মনোবৃত্তি নিয়ে বড় হচ্ছে, সেই ছেলেটি প্রকৃত বিচারে তো শিশু নয়, বালক নয়, সে একজন ভয়ন্কর অপরাধীর ক্ষুদ্ররূপ মাত্র; একটি বিষবৃক্ষের চারাগাছ মাত্র। তাই তাকে শুরুতেই বিনাশ না করতে পারলে বড় হলে সে একই অপরাধ আবারো করবে এবং আর ভয়ন্কর ভাবে নারীর অধিকার লঙ্ঘন করবে। ধর্ষনের পর নারীকে হত্যার মতো আরও বীভৎস অপরাধ করতে উদ্যত হবে। তাই কোন ধর্ষনকারীকেই ছাড় না দিয়ে তাদের বিরূদ্ধে সামাজিক, আইনগত, বিচারিক ও রাজনৈতিক – এক সর্বব্যাপী উদ্যোগ আমাদের নিতে হবে।

পত্র-পত্রিকা রেডিও-টিভি, ইন্টারন্টেভিত্তিক সংবাদ সংস্থা, ই্উটিউব এবঙ ব্লগসহ সর্বপ্রকার গণমাধ্যমের প্রতি অনুরোধ, আপনারা ধর্ষণকারীদের ছবিসহ বিস্তারিত নাম-পরিচিতি প্রকাশ করুন। কেউ কেউ হয়তো এ প্রস্তাবের সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন এই যুক্তিতে যে সঠিক অপরাধীর পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে তার ছবি/পরিচিতি প্রকাশ যথাযথ বা সাংবাদিকতার নীতিসম্মত হবে কি না। এ যুক্তির প্রেক্ষিতে জবাব হচ্ছে – আসলে যখন প্রথম আলো বা বিডিনিউজ২৪.কম পর্যায়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ধর্ষনের মত ভয়াবহ অপরাধগুলোর খবর প্রকাশিত হয় তখন নিশ্চয়ই একাধিক সূত্র থেকে যাচাই করে নিশ্চিত হয়েই সে ঘটনাটি একটি সংবাদ আইটেম হিসেবে সমাজ বা রাষ্ট্রের বা জনমানসের নজরে আনা হয়। তাই একজন ধর্ষনের অভিযোগে অভিযুক্ত বলে যদি তার নাম লেখা যায়, তাহলে তার ছবি প্রকাশ করতে অসুবিধা কোথায়? এ পর্যন্ত তা করা হয়নি বলেই ধর্ষন যে একটি বর্বরতম ও জঘন্য অপরাধ এ ধারনাটি আমাদের সমাজে ততোটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারেনি। আর একই কারণে এ অপরাধ বারংবার করার পরও এ সমাজে নিন্দিত ও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি ধর্ষনকারীদের। বরং হয়ছে উল্টোটা, ধর্ষনের শিকার অসহায় নারী বা তাঁর পরিবারকেই সামাজিক নিগৃহের শিকার এবং অপদস্থ হতে হয়েছে পদে পদে, অপদস্থ হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সুতরাং ধর্ষনকারীদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করে নাম, ছবি, তার কোন এলাকায় থাকে, কোথায় ও কাদের সাথে ওঠাবসা করে বা কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকে এসব বিস্তারিত প্রচার করা সম্ভব হলে সকলে এদের চিনতে এবং সামাজিকভাবে বয়কট করতে পারবেন। সাবধানও হতে পারবেন। সমাজে এ ভয়াবহ ব্যধি নির্মূল করতে হলে বা অন্ততঃ কমিয়ে আনতে হলে এটিও একান্ত প্রয়োজন।

আরো একবার, সকল ধর্ষনকারীর প্রকাশ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রত্যাশা করছি। বাংলাদেশ নামের এ অভাগা জনপদসহ দক্ষিণ এশিয়া এবং সমগ্র বিশ্ব ধর্ষনের মতো ভয়াল ব্যধি থেকে মুক্তি পাবে – এ কামনা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে রইলো। একই সাথে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য ও অত্যাচার-নির্যাতনের চির অবসান কামনা করছি। পুরুষতন্ত্রের চাপে পিষ্ট এ সমাজ প্রকৃতই মানুষের সমাজে রূপান্তরিত হবে, সকলে, বিশেষতঃ নারীরা ফিরে পাবেন ন্যায্য অধিকার, নিরাপত্তা ও যথাযথ মানবিক মর্যাদা – এ প্রত্যাশায় আজকের লেখার ইতি টানছি।

– দেওয়ান মাহমুদ
[অটোয়া, কানাডা থেকে
০৭ জানুয়ারী, ২০১৩]।