ঢাবির উচ্চশিক্ষার মান অবনমনের নেপথ্যে এবং করনীয়…

ধ্রুপদি শামিম
Published : 20 August 2011, 02:42 PM
Updated : 20 August 2011, 02:42 PM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এক সময় যাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে ডাকা হতো, আজ শিক্ষাব্যবস্থায় সে মৃতপ্রায় । ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এশিয়ার অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । কিন্তু শিক্ষকদের রাজনীতি আর শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা আজ দেশ সেরা তো বটেই এশিয়ার সেরা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আজ হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিনত করছে ।এর সাথে যোগ হয়েছে ছাত্র রজনীতি নামক মহাব্যাধি । সবমিলিয়ে আজ এই বিদ্যাপিঠ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ।কিন্তু এর জন্য করার কি কিছুই নেই নাকি এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে মাথাব্যথা নেই ?

অথচ এই বিদ্যাপিঠের ছাত্রছাত্রীরাই আজ দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছে । তাহলে আজ এই অবস্থা কেন সে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক । বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের স্বপ্নের উচ্চশিক্ষা আজ নরকে পরিনত হয়েছে । শিক্ষকেরা ক্লাসরুমে ঠিকমত পড়ান না। ব্যাস্ত থাকেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে । আর ঢাবির শিক্ষার্থীদের শুধু টার্ম পেপার আর প্রতি ক্লাসে এসাইনমেন্ট দিয়ে ব্যাস্ত রাখেন । অনেক শিক্ষক আছেন যারা ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর সামর্থ রাখেন না । কারন তারা শিক্ষক হয়েছেন মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে খুব ভাল ফলাফল করে, আওয়ামি লীগ, বিএনপি কিংবা জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করে, অথবা শিক্ষকদের আঞ্চলিকতার প্রেক্ষিতে।।। এমন প্রমানও আছে যে তৃতীয় শ্রেনী পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন ।অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে যেন প্রতিবন্ধকতা না থাকে সেজন্য এমবিএ শেষ হওয়ার পরপরই নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার কোন কোন বিভাগে আঞ্চলিকতাও শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভুমিকা পালন করেছে । এই যদি হয় দেশের সেরা বিদ্যাপিঠের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা তাহলে তারা শিক্ষার্থীদের কি শিক্ষা দিবেন সেটাও একটা প্রশ্ন বটে ।

সিনিয়রদের কাছে আমরা শুনেছি, এমনকি আমরা বেশকয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক পেয়েছি যারা অসাধারন ক্লাস নেন, তাদের সময়কার শিক্ষকেরা কত জ্ঞানী ছিলেন । ক্লাস করার জন্য তারা ক্লাস শুরু হওয়ার অনেক আগেই কক্ষে হাজির হতেন ।শিক্ষকেরাও প্রাণবন্ত ক্লাস নিতেন, ছাত্ররা একটি ক্লাসও মিস করতো না।

আর সাম্প্রতিক সময়ে একটি খুব অদ্ভূত নিয়ম চালু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ক্লাসে ৭৪-৬০% হাজিরা থাকলে ৫০০০ টাকা জরিমানা দিয়ে পরীক্ষা দেওয়া যাবে। এর কম হলে পরীক্ষা দেওয়া যাবেনা । এক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন আমার মনে উদয় হয়েছে । প্রথমত, ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস করেনা কেন ? হয়ত ক্লাসের প্রতি তাদের কোন আকর্ষন নেই কিংবা শিক্ষকদের কাছে ছাত্রছাত্রীদেরকে ক্লাসে ধরে রাখার মত পর্যাপ্ত রসদ নেই ।কিন্তু যাচাই করলেই দেখা যাবে যে এমন অনেক শিক্ষক আছেন যাদের ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার ৯০% এর চেয়েও বেশি ।এর অন্তরালে কোন বিষয় কাজ করছে তা শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্ন করলে সহজেই জানা যাবে । দ্বিতীয়ত, জরিমানা কি কখনো ক্লাশ করার বিকল্প হতে পারে ? তার উপর অনেক শিক্ষার্থী গ্রাম থেকে আগত বলে তাদেরকে পার্ট-টাইম কোণ কাজ করে পড়াশুনার ব্যয় নির্বাহ এবং পরিবারকেও টাকা পাঠাতে হয়। যদি উপস্থিতির হার ৬০% এর কম হয় তাহলে ছাত্রত্ব বাতিল করা হবে বলা হয়েছে। যদি এটা বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে এসব দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের ভবিষ্যত কি হবে সেটাও একবারের জন্য হলেও ভেবে দেখা দরকার বলে আমি মনে করি ।

মূল আলোচনা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি । এবার দেখা যাক কি করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব…

প্রথমত, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাবস্থা করা হোক । আঞ্চলিকতার প্রাধান্য ও রাজনৈতিক বিবেচনা পরিহার করার হোক ।শুধুমাত্র একাডেমিক ভাল ফলাফলই ঢাবির শিক্ষক হওয়ার মানদণ্ড হতে পারেনা । ভাল ছাত্র সবসময় ভাল শিক্ষক হবে এমন নয় ।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষক হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫ বছর ক্লাস করানোর অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক করা হোক । শিক্ষকদের নিয়োগের পুর্বে ডেমো ক্লাশ নেওয়ার ব্যাবস্থা করা এবং শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়ে যোগ্য ব্যাক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হোক ।

তৃতীয়ত, শিক্ষকদের জন্য প্রতি সেমিস্টার শেষে শিক্ষার্থীদের মতামতের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচনের ব্যাবস্থা করা হোক ।

চতুর্থত, শিক্ষার্থীদেরকে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও দক্ষ করে তোলার উদ্যোগ গ্রহন করা হোক।

পঞ্চমত, পড়াশুনা শেষ করার পূর্বেই চাকরিগত জীবনের বাস্তবসম্মত অভিজ্ঞতার ব্যাবস্থা করা হোক । হোক সেটা অবৈতনিক তবু কাজের সম্পর্কে বাস্তব ধারনা দেওয়া হোক।

আমি জানিনা আমার এ সীমিত জ্ঞানের লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হবে কিনা। শুধু এইটুকু নিশ্চয়তা দিতে চাই, আমরা শিক্ষার্থী আমরা পড়াশুনা করতে এসেছি, আমাদের শেখার আগ্রহ আছে । কিন্তু চোখের সামনে যখন আমাদের প্রিয় এই শিক্ষাঙ্গনের এই মৃতপ্রায় রুপ দেখি তখন বুকটা দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে যায়, চোখ দিয়ে আসে অবিরাম জল। সেই অশ্রু অবিরাম বাজতে থাকে হৃদয়ের বাম অলিন্দে । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনাদের কি কোনই উদ্বেগ নেই এক সময়কার বিশ্বশ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপিঠ নিয়ে…???