মদিনায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ কোরআন অনুবাদ ও মুদ্রণ কমপ্লেক্স

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
Published : 25 Sept 2011, 10:48 AM
Updated : 25 Sept 2011, 10:48 AM

মদিনায় অবস্থিত 'কিং ফাহাদ কোরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স' বিশ্বের সর্ববৃহত্ কোরআন অনুবাদ, তাফসির, মুদ্রণ ও বিতরণ প্রকল্প হিসেবে স্বীকৃত। পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মের প্রধান গ্রন্থ অনুবাদ, ভাষ্য তৈরি, মুদ্রণ ও বিতরণের উদ্দেশ্যে এত বিশাল প্রকল্প আছে বলে জানা নেই। এ প্রকল্প আব্বাসীয় শাসক বাদশাহ হারুনুর রশীদ কর্তৃক বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত 'বায়তুল হিকমাহ'-এর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশ্বব্যাপী পবিত্র কোরআনের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত, চর্চা ও অনুশীলন ছড়িয়ে দেয়ার এক মহত্ ব্রত নিয়ে সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহাদ ১৯৮৫ সালে মদিনায় এ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন। ৩০ জন বিদেশিসহ ১৭০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এ কমপ্লেক্সের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। একই ভাষার স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন মুফাসসিরের অনুবাদ ও তাফসির প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন ভাষার জন্য রয়েছে উচ্চপর্যায়ের শক্তিশালী সম্পাদনা বোর্ড। দুনিয়াব্যাপী কোরআনের দাওয়াত প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এ কমপ্লেক্স।

এ পর্যন্ত পৃথিবীর জীবন্ত ৫০টি ভাষায় অনুবাদসহ কোরআনের তাফসির প্রকাশ করা হয়। একই ভাষায় একাধিক অনুবাদ ও তাফসির রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত ৫০টি ভাষায় কোরআনের অনুবাদ ও তাফসিরের মধ্যে এশীয় ভাষায় ২৪টি, ইউরোপীয় ভাষায় ১২টি ও আফ্রিকান ভাষায় ১৪টি । উল্লেখযোগ্য ভাষাগুলো হচ্ছে ফ্রান্স, ইংরেজি, জাপানি, আলবেনীয়, ইন্দোনেশীয়, উর্দু, বাংলা, তুর্কি, সোমালীয়, চীনা, রুশ, জার্মান, স্পেনিশ, কোরীয়, ফার্সি, গ্রিক, ভিয়েতনামি, পর্তুগিজ, সুইডিশ, তেলেগু। বাংলা ভাষায় একখণ্ডে প্রকাশিত হয় আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফীর (রহ) মা'আরিফ আল কুরআন, যার অনুবাদক ও সম্পাদক হচ্ছেন বরেণ্য ইসলামী স্কলার মাওলানা মুহীউদ্দীন খান।

'কিং ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স'-এ অনুবাদসহ ও অনুবাদবিহীন দু'ধরনের কোরআন মুদ্রণ ও বিতরণ করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে কমপ্লেক্স ২০ কোটি কোরআন ছেপে দুনিয়াব্যাপী বিনামূল্যে বিতরণ করে। কোরআনের আয়াতগুলো সিরীয় বংশোদ্ভূত বিশ্ববিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার উসমান তাহা লিখিত। গত ১৮ বছর ধরে এ কমপ্লেক্সে কোরআন লিখন বিভাগে তিনি কর্মরত। তার হস্তলিপি ও অলঙ্করণ দৃষ্টিনন্দন, স্পষ্ট ও শিল্পসমৃদ্ধ। তার পরিচালনায় রয়েছেন একদল চৌকস ক্যালিগ্রাফার। পবিত্র কোরআন ছাড়াও এ পর্যন্ত এ কমপ্লেক্স থেকে অনুবাদ তাফসির, হাদিস, সীরাতুন্নবী গ্রন্থ বেরিয়েছে ১৬০ প্রকার। এ কমপ্লেক্সের বার্ষিক উত্পাদন ক্ষমতা ৬ কোটি কপি গ্রন্থ। মুদ্রণে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ যন্ত্রপাতির ব্যবহার বিস্ময়কয়ের উদ্রেক করে।

আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন সিম্পোজিয়ামে পঠিত ৬০ টিরও বেশি গবেষণা নিবন্ধ কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত হয়। হাফসসহ কোরআনের ৫ কিরাতের পাণ্ডুলিপি এখানে জমা আছে, যা বিশেষজ্ঞ কমিটির তত্ত্বাবধানে ক্যালিগ্রাফারদের মাধ্যমে লিখিত হয়। ২,৫০,০০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে মদিনা নগরীতে অবস্থিত এ প্রকল্পে মসজিদ, মুদ্রণ, প্রশাসন, পরিবহন, পাঠাগার, মিলনায়তন, রক্ষণাবেক্ষণ, মার্কেটিং, ক্যাফেটেরিয়া, ফার্মেসি ও প্রকৌশল বিভাগ রয়েছে। বাদশাহ আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল আযিযের নির্দেশে হজ পালন শেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকালে প্রত্যেক হাজিকে এককপি কোরআনের হাদিয়া প্রদান করা হয়। ১৪২৪-১৪২৫ হিজরি বর্ষে ২ কোটি কপি কোরআন বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া হারামাইনসহ সৌদি আরবের সব মসজিদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, বিদেশি অতিথি এবং সৌদি দূতাবাসের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে কোরআনের কপি সরবরাহ করা হয়।

এ প্রকল্পে বিশুদ্ধ তেলাওয়াতের অডিও ও ভিডিও ফর্মে কোরআনের সিডি, ডিভিডি তৈরি ও সরবরাহ করা হয়। এ পর্যন্ত ২০ লাখ মানুষ এ প্রকল্পটি পরিদর্শন করে। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ বিন সালিম বিন শাহীদ আল উফি এ কমপ্লেক্সের বর্তমান মহাসচিব। অন্ধ ব্যক্তিরা যাতে কোরআন তেলাওয়াত করতে পারেন সে জন্য প্রকাশ করা হয় Braille ভাষার সংস্করণ। হজ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৩,৬১,৪৫,৫৩৩ কপি কোরআন, ২৫,২০,৮৭৫ কপি ক্যাসেট, ২,৭৫,৯৭,৩৮৭ কপি অনুবাদ, ২,২০,০০০ কপি সীরাতুন্নবী, ৫,০৪৫,০০০ কপি অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ এ কমপ্লেক্স থেকে প্রকাশিত হয়। সৌদি সরকারের সহায়তায় দিন দিন এ প্রকল্পের কর্মপরিধি বিস্তৃতি লাভ করছে। পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় কোরআনের অনুবাদ ও তাফসির প্রকাশের লক্ষ্যে গবেষকরা কাজ করে যাচ্ছেন।