ক্ষমতায়নের পার্থক্য ও দরজার তালা

ফকির ইলিয়াস
Published : 25 August 2012, 04:24 AM
Updated : 25 August 2012, 04:24 AM

ছয় সপ্তাহ দেশে কাটিয়ে আবার নিউইয়র্কে ফিরে এলাম। ১২ আগস্টের ভোরে যখন ঢাকা ছাড়ছিলাম, তখন পাঁজর কেঁপে উঠছিল। চোখে ছিল অশ্রু। এই মাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি। হায় স্বদেশ, আবার কবে দেখবো তোমায়! মনে পড়ছিল স্বজনদের কথা। যারা আমাদের এই ছয়টি সপ্তাহ অনেক প্রীতি দিয়েছেন। তবু যেতে হয়! অভিবাসী জীবনের এই যে নিয়তি। দেশকে পেছনে ফেলে এসেছি ঠিকই। কিন্তু মননে থেকেই গেছে বাংলাদেশ।

এবার দেশে যে বিষয়টি লক্ষ করেছি তা হচ্ছে, মানুষ নিজ গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের বিষয়ে বেশ সচেতন হয়েছেন। ভালোমন্দ বুঝতে শিখছেন। দেখেছি, বাংলাদেশে ভোটের হাওয়া যেন বইতে শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-এমপিরা শুরু করেছেন দৌড়ঝাঁপ।

একটি রাষ্ট্রে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করলে আমরা দুটি বিষয় খুব গভীরভাবে লক্ষ করি। প্রথমটি হচ্ছে, জনগণের প্রত্যাশা। জনগণ মনে করেন তাদের ভোট প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আরেকটি পরিবর্তন সাধিত হবে। তারা শান্তির কাক্সিক্ষত আশ্রয় খুঁজে পাবেন। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, রাজনীতিকদের ক্ষমতায় যাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তারা অপেক্ষায় থাকেন, ক্ষমতা তাদের দখলে আসবে। এতোদিনের রাজনীতি করার ফসলটি ঘরে উঠবে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, জনগণের প্রত্যাশা এবং রাজনীতিকদের ক্ষমতায় যাওয়া এই দুটি স্বপ্নের সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায়। ধরা যাক, চলতি বছরে আমেরিকার নির্বাচনের কথা। বারাক ওবামা ও মিট রমনি লড়ছেন। জনজরিপে ওবামা এগিয়ে। ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানরা এখন তীব্র স্নায়ুযুদ্ধ চালাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিংহভাগ মানুষই চাইছেন আবারো ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতায় আসুক। কারণ ওবামা তার কাজ শেষ করতে পারেননি এমন আপিলটি বেশ কাজে লাগছে বলেই অনুমান করছি।

না, হিলারি ক্লিনটন আর থাকছেন না। অবসরে যাবেন তিনি। এই যে স্থান ছেড়ে দেয়া এর নামই প্রকৃত রাজনীতি। ওবামা আবার ডেমোক্রেটদের নমিনেশন পাবেন কিনা তা নিয়েও জল্পনা ছিল। তা কেটে গেছে। এখন তার পাস করার পালা।

তারপর ফলাফল কী হবে? জনগণের পরিবর্তনের প্রত্যাশা পূর্ণ হবে কি? নাকি আবারো ইরান-সিরিয়ায় যুদ্ধের দামামা বাজাবেন ২০১৩ এর নয়া প্রেসিডেন্ট? এসব প্রশ্ন নিয়েই কাল যাপন করছে যুক্তরাষ্ট্র। জনগণের শেষ ভরসা হচ্ছে এই- ক্ষমতায় যে পার্টিই আসুক না কেন, চরম অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে কাজ করে যাবেন শক্ত হাতে।

এটাই হচ্ছে ক্ষমতায়নের পার্থক্য। কেউ ভোগের জন্য ক্ষমতা চান। আর কেউ সেবার জন্য ক্ষমতা চান।

নির্বাচনী হাওয়া ক্রমশ সরগরম করে তুলছে বাংলাদেশের মাটিও। তবে পার্থক্য হচ্ছে, রাজনীতিকরা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। জনগণ পরিবর্তনের কোনো বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছেন না। এর প্রধান যে কারণটি গোটা জাতিকে সংশয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে তা হচ্ছে নির্বাচন আদৌ হবে কিনা। হলে তা সুষ্ঠু হবে কিনা। বড় বড় দলগুলো তাতে অংশ নেবে কিনা।

একটি খবর ছেপেছে নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ঠিকানা। খালেদা প্রধানমন্ত্রী, ইউনূস রাষ্ট্রপতি! এমন সমীকরণ নাকি চাইছেন বিদেশী মুরুব্বিরা। বিএনপি এর মাঝেই আন্দোলনের হুমকি, ধমকিও দিতে শুরু করেছে। পুরোনো মিত্রও খুঁজছে। অন্যদিকে সৈয়দ আশরাফ-মাহবুবুল হানিফরা বলছেন সংলাপ হবে। বিএনপিকে নিয়েই নির্বাচন হবে।

যদি সংলাপ ব্যর্থ হয়, যদি প্রধান দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তা হলে অবস্থা কী দাঁড়াবে? এখানে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট তা হচ্ছে বড় দলগুলো দুটি দাবি ক্রমশ জোরালো করছে। এক হচ্ছে, তাদের শীর্ষ নেতানেত্রীদের মুক্তি। আর দুই হচ্ছে, নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গিয়ে নেতানেত্রীদের কারগার থেকে বের করে আনা। বিদেশে থাকা নেতাদের ফিরিয়ে আনা। কিন্তু পরিস্থিতির বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে এই সত্য স্পষ্ট হচ্ছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা এই দুই দাবি কিংবা পরিকল্পনার কোনোটাই বাস্তবায়িত হতে দেবে না। যারা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে রাজনীতি থেকে মাইনাস হবেন তারা যেমন রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারবেন না, তেমনি দল ভেঙেও নির্বাচনে নেয়ার মহড়া চলছে। অন্যদিকে পদ্মা সেতু, শেয়ারবাজার, দুর্নীতি নিয়ে বিএনপি বড় আন্দোলনের মওকা খুঁজছে। যা ক্রমশ জটিল হয়ে রাজনীতির বাতাসকে উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। এই বৈরী পরিবেশকে মোকাবেলার জন্য কী শক্তি কিংবা কৌশল বর্তমান ক্ষমতাসীনদের কাছে রয়েছে তা এখনো বুঝা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশে ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন যখন বলেন, ঢাকার মানুষ যেন দরজায় তালা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে যান, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না দেশ এখন কতোটা অরক্ষিত। আর তালা ভেঙে যে কতো অঘটনই ঘটাচ্ছে সন্ত্রাসীরা তা তো মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। তারপরও তিনি এমন কথা কেন বলছেন?

জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে জনগণের ক্ষমতাই সকল উৎস- এই তত্ত্বে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা বুলি আওড়ালেও তারা তার চর্চা থেকে বিরত থেকেছেন বারবার। বরং তারা জনগণের ক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করেছেন বিভিন্নভাবে। বিশেষ করে বাংলাদেশে 'প্রাথমিক পর্যায়ে প্রার্থী নির্বাচন' পদ্ধতি না থাকায় দলই প্রার্থী চাপিয়ে দিয়েছে জনগণের ওপর। মন্ত্রী, শীর্ষ নেতানেত্রীদের প্রিয়ভাজন যারা হতে পেরেছেন তারাই নমিনেশন পেয়েছেন। একটি দেশের পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বন্দী করে রেখে দেয়া হয়েছে শীর্ষদের হাতের মুঠোয়। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্যায়নই করা হয়নি অধিক ক্ষেত্রে।

বিশেষ করে যেসব দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি জাতিকে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল তার সিংহভাগই ঘটেছিল চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। একটি খুন চেপে দেবার জন্য যে দেশের স্বয়ং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর কোটি কোটি টাকা উৎকোচ লেনদেন করতে পারেন সে দেশের ভবিষ্যৎ বলতে আর কী থাকতে পারে?

ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, কাগজে বর্তমান ক্ষমতাসীন কারো কারো দুর্নীতির খবর দেখে মানুষজন নিকট অতীতকে মিলিয়ে দেখছেন। যা কোনোমতেই শুভ সংবাদ নয়।

বাংলাদেশের মানুষ দেখেছেন, চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে 'হাওয়া ভবন' নামক একটি ভবনের শক্তি এবং নেপথ্য শক্তিরা দেশে একটি প্যারালাল সরকার গড়ে তুলেছিল। সবকিছু তাদের অঙ্গুলি নির্দেশেই পরিচালিত হতো। এমনকি শীর্ষ মন্ত্রীরা পর্যন্ত ভয়ে তটস্থ থাকতেন ওই ভবনের কর্মকর্তাদের। এসব বিষয় কি বেগম জিয়ার অজানা ছিল? না অজানা ছিল না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী চাইলে রাষ্ট্রকে এই রাহুর কবল থেকে মুক্ত রাখতে পারতেন। একইভাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কাউকে কাউকে বাঁচাতে চাইছেন কিনা, তাও চাউর হচ্ছে সর্বত্র।

ওয়ান ইলেভেনের যাঁতাকলের শিকার কিছু রাজনীতিবিদের মুখে একটি কথা শোনা যাচ্ছে এখনো। আর তা হলো- তারা নাকি দেশের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। আমি বলি, তারা যা করেছেন তা হয়েছে রাষ্ট্রের জনগণের কর্মযজ্ঞ এবং চাপের মুখে। ষোলআনা কাজের ছয়আনা সম্পূর্ণ করে বাকি দশআনা হজম করে নিয়েছেন বিভিন্ন মেয়াদের ক্ষমতালোভী রাজনীতিক বেনিয়ারা। আর সেই জঞ্জালই আজ দেশকে ঠেলে দিয়েছে আরেকটি অনিশ্চিত যাত্রার দিকে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য ভোটের কোনো বিকল্প নেই। একটি বৈধ সংসদই দিতে পারে রাষ্ট্রকে চলার পথদিশা। কিন্তু যোগ্য লোকের বদলে, ব্যক্তিগত প্রিয়ভাজনদের নির্বাচিত করার নামে সংসদ যদি রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয় তবে সব আশা-আকাঙ্খাই বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। বাংলাদেশে সে কারণেই মহাজোট সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও ভালো কাজগুলো করতে পারলো না। দেশে এবারে গিয়ে মানুষের সেই দীর্ঘশ্বাস খুব ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছি।

কোনো দেশে লোভী বুর্জোয়া শ্রেণী যখন তীব্র ভোগবাদী হয়ে সব কিছু গ্রাস করতে তৎপর হয় তখন কাউকে না কাউকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। মাত্র কবছর আগে ওয়ান ইলেভেন তেমনি একটি পরিস্থিতিতেই সৃষ্টি হতে বাধ্য করা হয়েছে বাংলাদেশে।

এমন পরিস্থিতি আবারো বংলাদেশে তৈরি হয় কিনা- এমন শঙ্কা প্রকাশ করছেন কিছু ইউরোপীয় এমপি, মার্কিনি সিনেটর-কংগ্রেসম্যানরাও। ভোটের রাজনীতি ও গণমানুষের ক্ষমতায়নের প্রয়োজনে যে পরিবর্তন প্রত্যাশা করা হচ্ছে তা যদি পূর্ণাঙ্গ রূপ ভালো করতে না পারে তবে জাতির দুর্ভোগ কখনই শেষ হবে না। আশার কথা, এই তরুণ প্রজন্ম মুক্তির দাবি জোরালো করছে, সেই আভাস আমি এবার দেশে লক্ষ করেছি।