হায় হলমার্ক! হায় আমাদের যাপিত বিষাদ!

ফকির ইলিয়াস
Published : 9 Sept 2012, 04:15 AM
Updated : 9 Sept 2012, 04:15 AM

আমেরিকায় একটি স্টোরের নাম আছে 'হলমার্ক'। ওরা কার্ড বিক্রি করে। জন্মদিন, মৃত্যুদিন, বিয়ে, চাকরি পাওয়া কিংবা হারানোর কার্ড। আরো গিফট আইটেম। বাংলাদেশে হলমার্ক নামে একটা গ্রুপ গড়ে উঠেছে তা কস্মিনকালেও আমার জানা ছিল না। জানলাম এই সেদিন। কাগজ পড়ে। টিভি দেখে।

কী কা-ই না হয়ে যাচ্ছে দেশে! আমি একজন লেখক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীকে চিনতাম। তিনি কলাম লিখতেন। সাপ্তাহিক খবরের কাগজ-এ। সম্পাদক ছিলেন কাজী শাহেদ আহমেদ। ঐ সময় ঐ কাগজে কলাম লিখতেন- আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমান, আহমদ ছফা, তসলিমা নাসরিন, ফজলুল আলম, আকিদুল ইসলাম আরো অনেকে। আমিও লিখতাম ঐ সাপ্তাহিকে। বাহ! কী চমৎকার ছিল ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর লেখনী। সবই ন্যায়ের পক্ষে। সৎ-মহৎ কতো কথাবার্তা। চমকে উঠেছি, হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে সেই সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর নাম দেখে! কী দেখছি এসব! মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হয়েছেন তিনি এই সেদিন। দেশের মানুষ তো সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীকে একজন নীতিবান লেখক হিসেবেই জানতো। তার নাম আমরা ভুল দেখছি নাতো? কী আর বলা যাবে? হলমার্ক নিয়ে দেশে এখন অনেক কথা।

হলমার্ক গ্রুপকে ঋণ দেয়ায় অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। হলমার্ক গ্রুপকে সোনালী ব্যাংকের আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার পর বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংকের কার্যক্রমে সংসদীয় কমিটি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং সার্বিক কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে।

এদিকে অর্থ কেলেঙ্কারির কারণে সমালোচনার মুখে থাকা সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলামকে পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্প্রতি সোনালী ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সমালোচনা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তারপরও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহম্মদ আল কবির, অগ্রণী ব্যাংকের খন্দকার বজলুল হক, জনতার আবুল বারকাত, বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু এবং আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার এডমিরাল এ তাহেরের মেয়াদ বেড়েছে দুই বছর করে।

ঘটনা নিয়ে দেশে-বিদেশে তোলপাড় যখন চলছে তখন অর্থমন্ত্রী আবারো বলেছেন 'এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তারা দুষ্টু। তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।' তিনি বলেন, 'টাকা আদায় করাই মূল লক্ষ্য। তবে এটা নিয়ে হই চই না হলে টাকাটা আদায় করা সহজ হতো।' সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় প্রাথমিকভাবে দুই হাজার কোটি টাকা নিশ্চিতভাবে আদায় করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কী বলছেন এসব তিনি। মাননীয় অর্থমন্ত্রী সিলেট-১ আসনের মাননীয় সাংসদ। আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি, তার আসনে তার পায়ের নিচে মাটি নেই। তারপরও ঐ আসনে প্রার্থী তিনি দশম সংসদীয় নির্বাচনে। তিনি কি জিততে পারবেন? তিনি কি ভেবে দেখেছেন তার আসনের মানুষ কী চেয়েছিল, আর কী পেয়েছে? সোনালী ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকা কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি আবারো বলছি, চার হাজার কোটি টাকার ঘটনা তেমন কিছুই না। আমরা বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেই। এটা তার ১০ শতাংশ।' কেলেঙ্কারিকে এভাবে জায়েজ করতে চাইবেন আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী? তিনি বলেছেন, আমরা বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেই। এর মধ্যে তিন বা চার হাজার কোটি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। এটা কোনো বড় অংকের অর্থ নয় বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সোনালী ব্যাংকে হলমার্কের অর্থ জালিয়াতি প্রসঙ্গে নিয়ে হই চই করারও কিছু নেই। বরং সংবাদ মাধ্যম এটা নিয়ে অতিরিক্ত প্রচারণা করে দেশের ক্ষতি করছে। এমনভাব যেন দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ধসে গেছে। এতে আমাদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এর আগে শেয়ারবাজারে ধস কারা নামিয়েছে? সরকার ওদের মুখোশ উন্মোচন করতে পারেনি কেন? কেন এদেশে বারবার মানুষ প্রতারিত হচ্ছে? ডেসটিনি, হলমার্ক-এর মতো মাল্টি কোম্পানিগুলো দেশের মানুষকে আর কতো বোকা বানাবে?

দেশে এখন একটা বিষাদকাল চলছে। এভাবে বিষাদগ্রস্ততা চলতে পারে না। কারণ রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়, তবে কোনো জাতি দাঁড়াতে পারবে না। নির্বাচন যতোই ঘনিয়ে আসছে ততোই একের পর এক নানা রকম খাদকের আবির্ভাব হচ্ছে বাংলাদেশে। এটা শুভ লক্ষণ নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে। আরো কমবে এমনটি চলতে থাকলে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপ দরকার। মুখ চেয়ে নয়, কেউ দোষ করে থাকলে তাকে সরিয়ে দিতে হবে। অনেক হয়েছে। আর যদি দেরি করা হয় তবে আম ও ছালা দুটোই খোয়াতে হতে পারে। অতএব সাধু সাবধান!

আমার মনে হয় আমার মতো একজন নগণ্য কলাম লেখকের এর চেয়ে স্বচ্ছ করে আর কিছুই বলার নেই।