এখনো মানুষ আছে, অগণিত মানুষের ভেতর

ফকির ইলিয়াস
Published : 15 Sept 2012, 05:39 PM
Updated : 15 Sept 2012, 05:39 PM

আমি যখন ১৯৯৪ সালে আমেরিকা থেকে দেশে গিয়ে ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরে আসি, তখন সিলেটের দৈনিক পত্রিকা বিক্রেতা হকার নুরু আমাকে বলেছিল, মামা, আপনি আমাকে জানাইবেন, কোন কোন কাগজ লাগবো, আমি আপনাকে আমেরিকায় পাঠাইয়া দিমু। বলেছিল- টাকা লাগবো না মামা। আমিই খরচ দিমুনে। সেই থেকে নুরুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা অপরিসীম। নুরু কী জানে, আমেরিকায় কাগজ পাঠাতে কতো খরচ হয়? হয়তো জানে। হয়তো জানে না। তারপরও তার সাহস, শক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। নুরু আমার দীর্ঘদিনের নিয়মিত হকার। যতোবার দেশে যাই, আমি নুরুর খোঁজ করি। এবার গিয়েও করেছি। সিলেটের সুরমা মার্কেটের সামনে কিন ব্রিজ থেকে নামলেই নুরু দৌড়ে এসে আমাকে দৈনিক কাগজগুলো দিয়েছে। আসার সময় বলে এসেছি- চলে যাচ্ছি।

আমরা দেশে গিয়েছি জেনে হাওর থেকে শালুক লতা তুলে নিয়ে আমাদের দেখতে এসেছে আমার খুব প্রিয় এক অনুজ কৃষক সাইদ আলি। বলেছে, আর কী আনবো বলেন! চিংড়ি মাছ দিয়ে শালুকলতা খেতে আপনি ভালোবাসেন জানি। তাই নিয়ে এলাম। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের এই যে আন্তরিকতা, তার কোনো বিনিময় মূল্য নেই। ওরা জানে না, শেয়ারবাজারের কথা। ওরা জানে না হাওয়া ভবন কেলেঙ্কারির কথা। ওরা জানে না হলমার্ক কেলেঙ্কারির কথা। জানতে চায়ও না। অথচ এই মানুষগুলোকে গরিব থেকে গরিবতম করেই আজ দেশে চলছে লুটপাটের দৌরাত্ম্য। দেশে এখন যে জিনিষটি নেই, তা হলো আইনের শাসন। কেন নেই? মানুষ শান্তিতে থাকবে বলেই তো ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিলেন।

আমরা জানি, রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাউকে না কাউকে নিতে হয়। তা না পারার দায়ও কারো কারো থাকে। আইন থাকবে আর তার প্রয়োগ হবে না, তা কোনো রাষ্ট্রের মানুষই মেনে নিতে পারে না। নেয়ার কথাও নয়। কোনো রাষ্ট্রে যখন ঘাটে ঘাটে মুনাফাখোর, কালোবাজারি, চাঁদাবাজরা ঘাপটি মেরে থাকে তখন প্রশাসকদের সদা সতর্ক থাকতে হয়। অথবা এদের সঙ্গে আপোস করে হাত মেলাতে হয়। আর অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলানোর পরিণাম গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য অশুভ বার্তা বয়ে আনে।

বহু প্রত্যাশার পরও বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের গতি এখনো নিয়ন্ত্রিত নয়। কেন নয়? বাণিজ্যমন্ত্রী বড় বড় বুলি আওড়ালেন। কিন্তু মালপত্রের দাম কমলো না বরং বাড়লো কোনো কোনো অঞ্চলে। সদ্য শেষ হওয়া সিয়াম সাধনার মাসকে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার মাস হিসেবেই বিবেচনা করেছে। এই মানসিকতা, এই সামাজিক প্রত্যয়ের অবক্ষয় গোটা জাতি, পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্যই বেদনাদায়ক।

ধরা যাক এক ট্রাক কাঁচা শাক-সবজির কথা। বাংলাদেশের কোনো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে এই ট্রাকটি কোনো প্রধান শহরে এসে পৌঁছতে কয়েকবার চাঁদাবাজদের মুখোমুখি হয়। ফলে শহরে পৌঁছে এক কেজি টম্যাটোর মূল্য বেড়ে যায় পাঁচগুণ। এই যে চাঁদাবাজ এরা কারা? এরা কি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দ্বারাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে লালিত? তা দেখার জন্যও একটি মনিটরিং টিম সরকারের থাকা উচিত ছিল। কিন্তু মহাজোট সরকার তা পারেনি।

আমরা প্রতিদিনই টিভিতে দেখছি দেশের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা নানা আশার বাণী শোনাচ্ছেন। কিন্তু সে আশার বাণী কি আইনসিদ্ধভাবে প্রয়োগের ব্যবস্থা হচ্ছে? না, হচ্ছে না। যদি হতো তবে ঈদ কিংবা পূজাকে পুঁজি করে বাজার দখলের অপতৎপরতা চালাতো না একটি চক্র। সামনে দুর্গাপূজাকে উপলক্ষ করে একটি চক্র দেশজুড়েই সক্রিয় হয়ে উঠতে চাইছে।

প্রতিটি অঞ্চলে কারা কালোবাজারি, কারা মজুতদার, কারা বাজার সিন্ডিকেটের হোতা তা সরকার যেমন জানে, তেমনি জানে জনগণও। জনগণ সুবিচার পায় না বলেই ফরিয়াদ করা থেকে বিরত থাকে। সামাজিক অবক্ষয় রোধে তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারকে মাঠ পর্যায়ে উদ্যোগী হতে হবে।

বর্তমান মহাজোট সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল, ঘরপ্রতি একজন করে বেকার মানুষকে চাকরি প্রদান করা। এর কতোটা বাস্তবায়িত হয়েছে, এর কোনো সঠিক হদিস নেই। ইতোমধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে যারা যাকরি পেয়েছে, তারা নাকি সবই সরকারদলীয় সমর্থক। বিরোধী দলের কেউ কেউ এমন অপপ্রচার চালাতে শুরু করেছে যে, রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয়রা নিজেদের লোকদেরই চাকরি দিচ্ছেন! তারা প্রশাসনেও রদবদল করছেন ইচ্ছেমতো। বিএনপি-জামাত জোট সরকার দেশের বিভিন্ন সেক্টরে নিজেদের পোষ্য-অনুগতদের চাকরি দিয়ে রেকর্ড স্থাপন করেছিল। পুলিশ বিভাগে তারা নিজেদের ক্যাডারদের নিয়োগ দিয়েছিল ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য। সেই চক্রটিই এখন মহাজোট সরকারের বিভিন্ন নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

লাখো শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার সমান। এমন একটি বুলি আমরা রাজনীতিকদের মুখে প্রায়ই শুনি। কিন্তু আসলে এই দেশে সব মানুষের অধিকার কি সমান? না, সমান নয়। উচ্চবিত্তের মানুষরা সব সময়ই বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন। আর নিম্নবিত্তের মানুষরা পান চরম দুর্ভোগ। এই যে শ্রেণী বৈষম্য তা স্বাধীন বাংলাদেশে কমার কথা থাকলেও তা বেড়েছে বহুগুণ। আর এজন্য প্রধানত দায়ী দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি।

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে এক জনসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, 'পশ্চিমা শোষকরা আমাদের সব নিয়ে গেছে। কিন্তু এই দুর্নীতিবাজ, চোর, বাটপারগুলো রেখে গেছে আমার জন্য!' বঙ্গবন্ধু ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এই তস্কর শ্রেণীর দানবদের সামাল দিতে না পারলে প্রকৃত সোনার বাংলা গড়া সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুকে ডুবাতে সেই পা-চাটা দুর্নীতিবাজরা তৎপর ছিল সব সময়। তারা বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃত অবস্থা জানতে দেয়নি কখনই। শাক দিয়ে মাছ ঢেকে বঙ্গবন্ধুকে বুঝাতে চেয়েছে, সবই ঠিক আছে। আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা অনুধাবন করতে পারছেন তো? তাকে সবকিছু ঠিকঠাক মতো জানানো হচ্ছে তো? নাকি তোষামোদীর দেয়াল তৈরি করে তাকে আড়াল করে রাখা হচ্ছে প্রকৃত অবস্থা।

আমরা একটি কথা জানি বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে দলের যারা রাষ্ট্র চালান তারা দল চালান না। দল জয়ী হলে একটি টিম সিলেক্ট করে দেয়। সেই টিম রাষ্ট্র চালায়। দল চালান অন্য অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা। তারা সরকারকে হুঁশিয়ার করে দেন। গাইডলাইন তৈরি করে দেন। বাংলাদেশে সে ব্যবস্থা নেই। দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী বিধায় মূল কর্তৃত্বের শক্তিটি তার হাতেই। ফলে এই মূল শক্তির চারপাশে চাটুকার তৈরি হয় খুব সহজে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে শেখ মুজিব, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার তিনটি নির্বাচিত সরকারই সব সময় থেকেছে সেই তোষামোদকারীদের তৈরি দেয়াল বেষ্টিত। সামরিক শাসক জিয়া এবং এরশাদ প্রথম দিকে সামরিক শক্তির জোরে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে সচেষ্ট হলেও পরে এরা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন অধিক হারে। এর অন্যতম কারণ ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকা। গণতন্ত্রকে হত্যার মাধ্যমে হলেও।

বর্তমান মহাজোট সরকারের মন্ত্রীরা কথায় ও কাজে কতোটা সঙ্গতি রেখে চলছেন এর মূল্যায়ন সব সময়ই করা দরকার প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। কারণ রাষ্ট্রের মানুষ অনেক প্রত্যাশা নিয়ে এই মহাজোট সরকারকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছিল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদে তরুণদের স্থান দিয়ে ও দলের কাউন্সিলে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বের প্রাধান্য দিয়ে চমক সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু মনে রাখা উচিত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতারও একটি বিশেষ মূল্য রয়েছে। দীর্ঘদিনের অর্জিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং মেধার মূল্যায়নও হওয়া উচিত ছিল। যা এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কোনো কালো শক্তির তাঁবেদার হয়ে যে মন্ত্রিত্ব করা যায় না, সে প্রমাণ শুরুতেই দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদপ্রাপ্ত তরুণ রাজনীতিক তানজিম আহমদ সোহেল তাজ এমপি। এখন অনেকেই জানেন, তিনি অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করতে না পেরেই পদত্যাগ করেছিলেন। কোনো রাষ্ট্রে নাগরিক দুর্ভোগ বাড়লে এর দাবদাহ ক্ষমতাসীনদের গায়ে লাগে। তাই সরকারের উচিত ছিল জনতার প্রত্যাশা-প্রাপ্তির বিষয়ে সচেতন থাকা। তা হয়নি। সময় আর মাত্র দেড় বছর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি দেয়ালঘেরা তোষামোদকারীদের বেষ্টনীতে থাকেন তবে তিনি ভুল করবেন। গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণে তাকেই সক্রিয় থাকতে হবে সবচেয়ে বেশি।

দুর্ভাগ্য, আমরা এমন লক্ষণ দেখছি না। আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি, দুর্নীতিবাজ উপদেষ্টা, মন্ত্রী, আমলাদের সরিয়ে দিলে সরকার টলে না। বরং দুর্নীতির বরপুত্রদের ম" দিলেই সরকারের পতন হয় বেদনার সঙ্গে। শুরুতেই বলেছি, এদেশে এখনো মানুষের ভেতরের মনুষ্য রূপটি খুব জ্যোতির্ময়। রাজনীতিকরা তাদের কাজে লাগাতে পারলেন না! যদি পারতেন এই দেশটি অন্যরকম হতো।