জাতিসংঘের কাছে বর্তমান প্রজন্মের প্রত্যাশা

ফকির ইলিয়াস
Published : 29 Sept 2012, 06:59 AM
Updated : 29 Sept 2012, 06:59 AM

নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশন চলছে। এবারো বহুল আলোচিত মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। তাকে নিয়ে কাগজের হেডলাইন। তিনি বলেছেন- ইসরায়েলের অস্তিত্বের আর দরকার নেই! এক কথাতেই কেল্লা ফতে! ইরানিয়ানরাও বিক্ষোভ করছেন তার বিরুদ্ধে। ইরানের এই নেতা প্রতিবারই আমেরিকা আসেন। তাকে আসতে দেয়া হয়। আমেরিকান নেতারা তাকে বলেন- 'বার্কিং ডগ '।

এবারো সকল কথা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনকে ঘিরে। বিভিন্ন দেশের শতাধিক রাষ্ট্র এবং সরকার প্রধানরা এই অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য নিউইয়র্কে আসছেন। ভাষণ দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। জাতিসংঘের এই মিলনমেলাকে ঘিরে নতুনরূপে সেজেছে জাতিসংঘ চত্বর। নানা দেশের বর্ণিল পতাকায় সুশোভিত হয়েছে। ব্যানার-ফেস্টুনগুলোতে বিভিন্ন ভাষার বাণী। সুস্বাগতম, হে অতিথিবৃন্দ। অন্যদিকে এই অধিবেশনকে ঘিরে টানটান উত্তেজনা জাতিসংঘ চত্বরে লেগেই আছে।

জাতিসংঘ প্লাজার সামনেই বিভিন্ন স্পটে অনুমতি নিয়ে প্রতিবাদ প্রতিরোধে গর্জে উঠেছেন বিভিন্ন দেশের মানুষ। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র এবং সরকার প্রধানদের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ। 'তাইওয়ানকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। তাইওয়ান কোনো চীনা কলোনি নয়।'- এই ফেস্টুন লিখে সমবেত হয়েছেন তাইওয়ানের অনাবাসী মার্কিনিরা। তারা এসেছেন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছিলেন মি. জং সি জেং। তিনি জানালেন, তারা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রতি বছরই সাধারণ অধিবেশনের সময় এই প্রতিবাদ করেন। এতে কি কোনো সুফল পাচ্ছেন? মি. জেং বললেন, হ্যাঁ, সুফল তো পাচ্ছিই। বিশ্বে জনমত ক্রমশ প্রবল হচ্ছে স্বাধীন তাইওয়ানের পক্ষে। আমাদের প্রজন্মরা জানতে পারছে, আমাদের অতীত ঐতিহ্য। আমাদের বিশ্বাস, আমরা একদিন পুরোপুরিই সার্থক হবো এ আন্দোলনের মাধ্যমে।

এবারেও জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্ব ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। তাকে ঘিরে মার্কিন মিডিয়াগুলো প্রতিদিনই বিভিন্ন রিপোর্ট ছাপছে। প্রায় প্রতিবারই দাবি তোলা হয় আহমাদিনেজাদকে যেন আসতে দেয়া না হয়। কিন্তু তারপরও তিনি আসেন জাতিসংঘে। ভাষণও দেন। এ বছর তার আরো কয়েকটি স্থানে অতিথি বক্তা হিসেবে ভাষণ দেয়ার প্রোগ্রাম রয়েছে।

জাতিসংঘ অধিবেশন শুরু হলেই বিশ্বের নানা জাতি, নানাভাষী মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের দাবি নিয়ে সমবেত হন জাতিসংঘ চত্বরে। ইরানের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেও একটি বিশাল সমাবেশ করার প্রস্তুতি চলছে বেশ আগে থেকেই। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় অভিবাসী ইরানিরা প্রতি বছরই এ ধরনের সমাবেশ করে থাকেন। তিব্বত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স প্রভৃতি দেশের ছোট ছোট গোষ্ঠী সমাবেশও করছে।

প্রেসিডেন্ট ওবামা আগে থেকেই তার বিভিন্ন বক্তব্যে সন্ত্রাস দমন এবং মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাবিষয়ক মূল চেতনা তুলে ধরেছেন। তা ছাড়া অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা বিভিন্ন স্মারকে স্বাক্ষর করেছেন, করবেন। এর মধ্যে পরিবেশ রক্ষা, শিশুস্ব^াস্থ্য, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয় স্থান পাবে। একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, প্রতি বছরই জাতিসংঘের অধিবেশনে এসে রাষ্ট্রনায়করা এভাবে বুলি আওড়ান। কিন্তু তারা তাদের নিজ নিজ দেশে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার কতোটা চর্চা করেন তা প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাচ্ছে। ফলে জাতিসংঘ যে চেতনা নিয়ে জন্ম নিয়েছিল, তা অনেকটা খাঁচাবন্দীই থেকে গেছে। আর প্রজন্মরা বারবারই হচ্ছে প্রতারিত।

কিউবার শাসক ফিদেল ক্যাস্ট্রো একবার জাতিসংঘ অধিবেশনে এসে তার ভাষণে বলেছিলেন, যে ভূমিতে জাতিসংঘের সদর দপ্তর অবস্থিত, সেই রাষ্ট্রটির একক আধিপত্য এবং প্রভাবের কারণেই জাতিসংঘ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। প্রকারান্তরে তিনি আমেরিকার কথাই বলেছিলেন। তিনি বৃহৎ শক্তিগুলোর 'ভেটো' শক্তিরও তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, একটি শক্তিই অন্য বৃহৎ শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে বিশ্বে ধ্বংস এবং শান্তির ভারসাম্য এখন হুমকির মুখোমুখি।

বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নকামী দেশের জাতিসত্তা বাঁচাতে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কী ভূমিকা রাখতে পারে? এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ও রাষ্ট্র বিশেষজ্ঞরাও নানা ইতিবাচক বক্তব্য দিচ্ছেন। সুদান, সোমালিয়া, আলজেরিয়া কিংবা আজকের যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক-আফগানিস্তানে যে গোত্রগত দাঙ্গা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তা কিভাবে সামাল দেয়া যেতে পারে? এ বিষয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে জাতিসংঘ আরো সক্রিয় হতে পারে। আরো স্পষ্ট করে যদি বলা যায়, তবে তা হচ্ছে, ইরাকের শিয়া-সুন্নি কিংবা আফগানিস্তানে কুর্দিদের যে অভ্যন্তরীণ কলহ তা আগামী কয়েক দশকে কী রূপ নিতে পারে? তাহলে কি এসব সম্প্রদায় একেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দিকেই এগিয়ে যাবে কিংবা যেতে পারে? জাতিসত্তাগুলোর অভিভাবক হিসেবে জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও সদস্যদের তা নিয়ে ভাবতে হবে গভীরভাবে। এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

শেখ হাসিনা আইনের শাসনের ভিত্তিতে নিরাপদ একটি বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং এসব আইনের নিরপেক্ষ ও যথাযথ প্রয়োগে সমর্থন দিতে শক্তিধর দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সমতার নীতি নিশ্চিত করতে প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক সংস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর অধিকতর সক্রিয়তা ও প্রতিনিধিত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। আইনের শাসনের ওপর উচ্চ পর্যায়ের এক আলোচনায় এ কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন জোরদারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার তথ্য কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন, আইন কমিশন ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে শক্তিশালী করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ তার সন্ত্রাসবিরোধী ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে ১৪টি আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০২১ সাল নাগাদ প্রশাসন, চাকরি, নেতৃত্বসহ বাংলাদেশের সব কর্মক্ষেত্রের অর্ধেক প্রতিনিধিত্ব করবে নারীরা। তিনি বলেন, 'আমি সংসদে ও নেতৃত্বের সব পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ব্যাপারে অঙ্গীকার করছি।'

প্রধানমন্ত্রী 'সম-অংশীদারিত্বের ভবিষ্যৎ' শীর্ষক অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মোট জনশক্তির অর্ধেক হবে নারী এবং তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও গৃহে নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য আইন প্রয়োগের জন্য আরো ব্যবস্থা নেয়া হবে। শেখ হাসিনা বলেন, 'যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ছে; কিন্তু এখনো তা যথেষ্ট নয়।' বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই যে আশার বাণী শুনিয়েছেন, তা বাস্তবে কতোটা কাজে লাগবে, তা দেখার জন্য প্রজন্ম উদগ্রীব হয়ে থাকবে।

সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থেকে মানুষ যখন তার ন্যায্য অধিকার নিয়ে কথা বলে তখন তা ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে অন্য মানুষের কানে পৌঁছে। তাদের মনে দাগ কাটে। হয়তো সময় লাগে, কিন্তু মানুষের অধিকারের সংগ্রাম বিজয়ের উন্মুক্ত আঙিনা খুলে দেয় এক সময়। জাতিসংঘ যদি শুধু কাগুজে উপাখ্যানে বন্দী না থেকে বাস্তবতা মোকাবেলায় মানুষের সহযোগী হতো কিংবা হতে পারতো, তবে এ প্রজন্মের জন্য ক্রমশ তৈরি হতো নতুন বিশ্বলোক। এ বছরের অধিবেশন জাতিসংঘের মিলনমেলা। শুধু জলবায়ু, পরিবেশ আর নদী-সমুদ্রের গতিরেখা বিশ্লেষণে নয়, বিশ্বমানবের কল্যাণে ভূমিকা রাখুক জাতিসংঘ। এই প্রজন্ম সে প্রত্যাশাই করছে।