সাইবার ক্রাইম ঠেকাতে না পারলে

ফকির ইলিয়াস
Published : 21 April 2014, 03:29 AM
Updated : 21 April 2014, 03:29 AM

সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এগোচ্ছে প্রযুক্তি নির্ভরতা। এর পাশাপাশি বাড়ছে প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট অপরাধ প্রবণতা। হাতের মুঠোয় এখন ইন্টারনেট। তা দিয়ে চাইলে যে কাউকেই আক্রমণ করা যায়! মুহূর্তে ছড়িয়ে দেয়া যায় নানা গুজব! একজন মানুষ যদি একশত জন মানুষকে এসএমএস করে একটি সংবাদ দেয়, সেই একশজন যদি জনপ্রতি আরো একশজনকে সংবাদটি পৌঁছায়- তাহলে তা কতো জনের কাছে পৌঁছছে? এভাবে চক্রবৃদ্ধি হারে তা ছড়াতে সময় লাগতে পারে মাত্র কয়েক মিনিট।
এছাড়াও সাইবার ক্রাইমের রয়েছে আরো অনেক রকম ধরন। একটি পুরোনো ঘটনা বলি। সংবাদটি ছিল নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। পল হিনক্লে নামের ৬৯ বছর বয়স্ক এক মার্কিনিকে গোয়েন্দারা গুরুতর অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার করেছিল। তার অপরাধ সে ইন্টারনেটে চ্যাটিং করে কেসি নামে ১১ বছরের এক বালিকা এবং ওই বালিকার ২৯ বছর বয়স্ক মা শেরিলের সঙ্গে অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল মাইকেল গার্সিয়ার অফিস থেকে জানানো হয়, 'সল্টিঅল্ড সেইলর ২০০২৬৯' এই স্ক্রিন নামে পল হিনক্লে গত জানুয়ারি '০৭ থেকে কেসি ও শেরিলের সঙ্গে ইন্টারনেটে আলাপ করে আসছিল। মূলত ১১ বছরের বালিকা কেসি ও তার মা শেরিলের ছদ্মনামে চ্যাটিং করেছিল দুজন মহিলা গোয়েন্দা।

পল হিনক্লে নিউইয়র্কের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালট্যান্ট বিজনেস ফার্মের প্রতিষ্ঠাতা ও ধনকুবের। তার কোম্পানির নাম জেএমজে এন্টারপ্রাইজেস। ৬৯ বছরের বৃদ্ধ পল এক পর্যায়ে ১১ বছরের বালিকা ও তার মায়ের সঙ্গে ফোনালাপেও রত হয়। গোয়েন্দারা সব ফোনালাপ রেকর্ড করে। মা ও মেয়েকে নিউইয়র্কে আসার আমন্ত্রণ জানায় পল। ছদ্মবেশী গোয়েন্দারা মা ও মেয়ে সেজে জানায়, তারা কলরাডো অঙ্গরাজ্য থেকে নির্দিষ্ট দিনে এসে নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টে অবতরণ করবে। বৃদ্ধ পল জানায়, সে হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছে। এবং সেই 'গ্লোরিয়াস নাইট'-এর জন্য অপেক্ষা আর সইছে না।

এয়ারপোর্টে অপেক্ষারত অবস্থায়ই গেলো ১৬ জুলাই '০৭ সোমবার গোয়েন্দারা পলকে গ্রেপ্তার করে। পলের গাড়ি থেকে রশি, মাদকদ্রব্য, কনডমস ও ভায়াগ্রা উদ্ধার করা হয়। পলের বক্তব্য থেকে জানা যায়, সে ১১ বছর বয়সী বালিকার প্রতি এতোই আসক্ত হয়ে পড়েছিল যে, যৌনাচারের প্রয়োজনে রশি ব্যবহারের জন্য সে তা গাড়িতে রেখেছিল। তার পরিকল্পনা ছিল প্রয়োজনে রশি দিয়ে বালিকাটির হাত-পা বেঁধে ফেলবে। ইউএস অ্যাটর্নির দপ্তর থেকে বলা হয়েছে এই জঘন্য, হীন মানসিকতা পোষণ এবং নাবালিকার প্রতি এমন আচরণের প্রস্তুতির জন্য পলের সর্বনিম্ন ৩০ বছর জেল হতে পারে। সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদ-। তার জামিন নামঞ্জুর করে আদালত ইতোমধ্যেই তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। গেলো ১৮ জুলাই '০৭ বুধবার এই সংবাদটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অনেক জাতীয় দৈনিকের অন্যতম শিরোনাম। এরকম অনেক ঘটনা বিশ্বে প্রতিদিন ঘটছে।

সুপ্রিয় পাঠক-পাঠিকা, সভ্য বিশ্বের জন্য, পরিশীলিত মানব সমাজের জন্য এ সংবাদটি বেদনাদায়ক অবশ্যই। প্রযুক্তির দরজা যখন উন্মুক্ত হয়ে মানবকুলকে সৃজনের পথে আহ্বান জানাচ্ছে তখন পাশাপাশি এই ভাবনাও আসছে, প্রযুক্তির নেগেটিভ দিকগুলো কী কী? এগুলো থেকে মানব সমাজকে কীভাবে বাঁচানো যায়।

ইন্টারনেট প্রযুক্তিটি পুরোদমে চালু হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনগত কঠোরতা বেড়েছে। হ্যাকিং করে অন্যের ব্যাংকের অর্থ, বিভিন্ন তথ্যসহ বায়োডাটা কিংবা অন্যান্য জরুরি ডাটা চুরির প্রবণতা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে গোটা বিশ্বে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ, খুনখারাবি, ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষণ, ব্যভিচার, সন্ত্রাসসহ নানা চরম, হীন কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে তো বটেই, প্রাচ্যের ভারত, ফিলিপিন্স, শ্রীলঙ্কায়ও সাইবার অপরাধ দমনে বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী 'অপরাধ দমন স্কোয়াড' গঠন করা হচ্ছে। মানুষকে সচেতন করে গড়ে তুলতে নানা কর্মশালা পরিচালিত হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে একটি সামাজিক সচেতনতার বিজ্ঞাপন জনমনে খুবই নাড়া দেয়। রাত এখন ৯টা। 'আপনি জানেন কি আপনার সন্তান এখন কোথায়? আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আপনার হাতে।' এই বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি এখন যুক্ত হয়েছে নতুন একটি সামাজিক বিজ্ঞাপন। 'আপনার সন্তান ইন্টারনেট জগতে ঢোকার আগে, আপনি সে জগৎ ভালো করে রপ্ত করে নিন।' 'প্যারেন্টাল কন্ট্রোল' ধাপগুলো ভালো করে জানুন। লক্ষ রাখুন, ইন্টারনেটে আপনার সন্তান কী করছে।

এক সময় ছিল যখন ইউরোপ-আমেরিকা অভিবাসী অভিভাবকরা গর্ব করে বলতেন, আমার ছেলেমেয়ে খুব ভালো ইংরেজি জানে। অথচ তারা ভুলে যেতেন একটি প্রজন্ম ইংরেজিভাষী দেশে বেড়ে উঠলে ইংরেজি তো তার প্রথম ভাষা হবেই। এতে অহঙ্কার করার তেমন কী! সেই মনমানসিকতার দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে, যা অভিবাসী প্রজন্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক। এখন অভিবাসী অভিভাবকরা প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কার সন্তান কতো ভালো বাংলা ভাষা জানবে, শিখবে বাংলা সভ্যতা-সংস্কৃতি। রেওয়াজ করবে সৃজনশীল তাহজিব-তমদ্দুন। ধর্মীয় শিক্ষাসহ এ যুক্তরাষ্ট্রেও এখন গড়ে উঠেছে বাংলা ভাষা, গান, নাচের অনেক স্কুল। এসব শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষকরা বেশ গর্বিত তাদের ছাত্রছাত্রী নিয়ে। শিকড়ের সন্ধানে নিজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সাহিত্য শেখার এবং জানার বিকল্প আর কী হতে পারে?

বাংলাদেশেও সাইবার ক্রাইম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সর্বত্র। কিছু প্রকাশিত সংবাদের দিকে নজর দেয়া যাক। মিরপুর বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পড়ুয়া এক তরুণীর সঙ্গে শিশির নামে এক যুবকের বিয়ে ঠিকঠাক হয়েছিল। বিয়ে ঠিক হয়েছিল দু'পরিবারের সম্মতিতেই। এনগেজমেন্ট দিনও ঠিক হয়। এরই মধ্যে ছেলেটি ওই তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। নানা প্রলোভন আর প্ররোচনার এক পর্যায়ে তরুণী ওই যুবকের ঘনিষ্ঠ হয়। অন্তরঙ্গ সেসব মুহূর্তের ছবি শিশির মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করে রাখে। পরে শিশির ওই তরুণীর পরিবারের কাছে ২০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে। এতো টাকা যৌতুক দিতে অস্বীকার করায় তরুণীর পরিবারের সদস্যদের ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে শিশির। টাকা না দিলে ওই ছবি সে ওয়েবসাইটে দেয়ার হুমকি দেয়। লজ্জা, ঘৃণা, অপমানে ওই তরুণী দু'দফা আত্মহত্যার চেষ্টাও চালায়। বিষয়টি তরুণীর বন্ধু-বান্ধবীরা জেনে যাওয়ায় লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে গেছে।

আরেকটি ঘটনা আরো ভয়াবহ। গেলো ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ইডেন কলেজের এক ছাত্রী তার সেলফোনের লক খুলতে যান ইস্টার্ন প্লাজায় একটি দোকানে। ওই দোকানের কর্মচারী ছাত্রীর সেলফোনের লক খুলে দেন। তবে ওই সেলফোনে থাকা ছাত্রীর দুটি ছবি ব্লুটুথ দিয়ে ডাউনলোড করে নেন। ছাত্রীর অজান্তেই তিনি এ কাজটি করেন। এরপরই ওই ছাত্রীর মোবাইলে ফোন করে তাকে ভালো লাগার কথা জানান। এক পর্যায়ে প্রস্তাব দেন প্রেমেরও। রাজি না হওয়ায় ইডেন কলেজের ওই ছাত্রীর মুখাবয়বের সঙ্গে নগ্নদেহের ছবি মিলিয়ে ফোন নম্বরসহ ছেড়ে দেয়া হয় পর্নোসাইটে। কী মারাত্মক জিম্মিদশায় পড়ছে এই প্রজন্ম!

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাইবার ক্রাইম বাড়ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। সাইবার সিকিউরিটি ফার্ম 'ট্রেড মাইক্রো'র একটি গবেষণা প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বিবিসির রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীনে মোবাইল ইন্টারনেটের জন্য ব্যবহৃত স্মার্ট ফোন এবং জিএসএম মডেম হ্যাক করার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। চীনের ৮১ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং তারাই সাইবার অপরাধীদের সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। ভুয়া অ্যানড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের লোভ দেখিয়ে ফোন ব্যবহারকারীকে ফাঁদে ফেলে তার সিম ক্লোনিং করে একই নম্বর যেমন মেসেজ পাঠানো এবং কল করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে, তেমনি গ্রাহকের ই-মেইল পাসওয়ার্ড, ক্রেডিট কার্ড, পিন নম্বর প্রভৃতি হ্যাক করা হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকার উত্তরায় তাইওয়ান ও চীনের একটি সংঘবদ্ধ ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতচক্র ধরা পড়ে যারা প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ছিল চীন ও তাইওয়ান থেকে। এসব বিষয়ে মানুষের সচেতনতা এখন খুবই জরুরি বিষয়।
যে সত্যটি সব অভিভাবককেই মনে রাখতে হবে তা হচ্ছে, তার সন্তান যেন সুষ্ঠু গাইডেন্স পেয়ে বড় হতে পারে। প্রযুক্তি মানব সমাজের জন্য আশীর্বাদ হলেও তা মানব জীবনের একমাত্র নিয়ন্ত্রক কিংবা নিয়ামক নয়। মনে রাখতে হবে, কম্পিউটারের ডেটাবেইসে যে তথ্য আপলোড করা হবে, তাই কিন্তু সার্চ করে পাওয়া যাবে। কম্পিউটার এমন কোনো শক্তি নয় যা অদৃশ্য, অস্পর্শ কিছু বলে দিতে পারে।

এসব দিক বিবেচনা করে এবং বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশেও সাইবার নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা জরুরি। যাতে ইন্টারনেট প্রযুক্তির বিয়োগাত্মক দিকগুলো আমাদের প্রজন্মকে ধ্বংস করতে না পারে। মুক্তপ্রবাহের যুগে তথ্য নিয়ন্ত্রণ নয়, অসাধু তৎপরতা, অসামাজিক কর্মকাণ্ড যাতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে হতে না পারে সে বিষয়ে সবাইকে নজর রাখতে হবে। আবারো বলি, প্রযুক্তির দরজা দ্রুত উন্মুক্ত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আমরা যেন প্রমাদজনিত ভাইরাসে না ভুগি। কারণ, কোনো অপস্বাধীনতা মানব জীবনে কল্যাণ বয়ে আনে না। আনতে পারে না। সাইবার ক্রাইম ঠেকাতে না পারলে আমাদের সমাজ জীবনে আরও ভয়াবহ শংকা,উৎকন্ঠা নেমে আসতে পারে।