মুক্তিযোদ্ধারা কি যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় একাত্তরের ট্রেনিং কাজে লাগাবেন!

ফকির ইলিয়াস
Published : 23 Dec 2011, 06:07 AM
Updated : 23 Dec 2011, 06:07 AM

ঢাকায় বিএনপি মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ডেকেছিল। এ সমাবেশ ঘিরে সহিংস কর্মকান্ড ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে ককটেল ফাটানো হয়েছে। সিলেটে জ্বালাও-পোড়াও করা হয়েছে জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। ঢাকায় এবং সিলেটে একজন করে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আবারও তাদের 'একাত্তরের ট্রেনিং' কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন। প্রশ্নটি হচ্ছে, এই মুক্তিযোদ্ধারা কার বিরুদ্ধে তাদের এই ট্রেনিং কাজে লাগাবেন-যারা একাত্তরের মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চাইছে তাদের বিরুদ্ধে; নাকি যারা রাজাকার-আলবদরদের বাঁচাতে চাইছে তাদের পক্ষে?

বিএনপি আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় পাঁচ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এসেছিলেন বলে বিএনপি জানিয়েছে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সেই সমাবেশের অংশ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকা আগমনের দৃশ্য দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তাদের দেখেই বোঝা গেছে, তারা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকা এসেছেন। হাতে বাক্সপেটরা। চোখে-মুখে শঙ্কার ছাপচিত্র। উৎকণ্ঠিত তাদের চেহারায় ফুটে উঠেছে, তারা একটি শান্তিময় জীবন চান।

বিএনপি তাদের ঢাকায় ডেকে এনেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এনেছে? সন্দেহ নেই, এই মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হয়েছে, বিএনপি তাদের ভাগ্য বদলে দেবে। বিএনপি তাদের সব সমস্যার সমাধান করবে।
এই যে প্রতিশ্রুতি বিএনপি দিচ্ছে, তা তারা কতটা পূরণ করবে কিংবা আদৌ করবে কি না; সে বিষয়ে আলোচনা দরকার। বিএনপি বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যে এর আগে ছিল না, এমন নয়। মনে রাখা দরকার, এ দলের জন্ম হয়েছিল রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে। দলটি রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করেছিল। মশিউর রহমান যাদু মিয়া, ড. আলীম আল রাজি প্রমুখ চিহ্নিত রাজাকারকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছিল। এসব ঘটনা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের চপেটাঘাতের শামিল। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রমান বলেছিলেন, 'আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ানস।' তিনি বলেছিলেন, 'মানি ইজ নো প্রবলেম।'

হ্যাঁ, জিয়া নিজে রাজনীতিবিদ ছিলেন না বলেই প্রকৃত রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রতি তার কোন দরদ ছিল না। চিহ্নিত মৌলবাদীরা পালে হাওয়া পায় জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক না হয়েও জিয়া ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে প্রয়াসী হন। সেসব ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষের অজানা নয়। সেই ভোগবাদী রাজনীতির উত্তরসূরি খালেদা জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন দুই টার্মে ১০ বছরেরও বেশি সময়। তিনি এবং তার সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কী করেছেন? প্রশ্নটি খুব সঙ্গত কারণেই আসতে পারে। ১৯৯১-৯৬ সালে খালেদা জিয়ার সরকার দেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের চারা পুষতে থাকে। সেই চারাগাছ বৃক্ষে রূপ নেয় ২০০১-০৬ সাল সময়কালে। খালেদা জিয়া আলবদরের দুই শীর্ষ কমান্ডার নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী বানান। এর প্রতিবাদে বিএনপি নেতা সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মীর শওকত আলী বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। পরে দল থেকে বেরিয়ে যান লে. কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীরবিক্রম- সবই ঘটেছিল খালেদা জিয়ার রাজাকারপ্রীতির কারণেই। ওই একই সময় বিএনপিতে সব মুক্তিযোদ্ধা নেতা মেজর হাফিজ উদ্দিন, কর্নেল হান্নান শাহকে 'সাটআপ' করে রাখা হয়। রাজাকার-আলবদররা দেশের পতাকা উড়িয়ে মন্ত্রিত্ব করে এবং তাদের আখের গোছায়।

দেশের প্রধান দুটি দল যদি আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে বিবেচনা করা হয়, তবে কোন দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বেশি করেছে তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ মুক্তিযোদ্ধাদেরই করতে হবে। সম্মান, সুযোগ-সুবিধা প্রদান, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগই এগিয়ে আছে। বিএনপি শুধুই রাজাকারদের বাঁচার জন্য, আলবদরদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভাঙাতে তৎপর হয়েছে বারবার।

মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের নামে বিএনপি ঢাকায় যে সহিংস তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করেছে তার শিকড় অন্যত্র। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ওইদিন ভোর ৬-৭টা থেকেই ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে কিছু তরুণকে জড়ো করানোর চেষ্টা করা হয়। এরা কারা? এরা একটি মৌলবাদী সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডার- যারা এদেশে একযোগে বোমা হামলা করার মতো অতীত রেকর্ড তৈরি করে রেখেছে। ঢাকায় আক্রমণের পরপরই সিলেটে একজন বাসযাত্রীকে পুড়িয়ে মারা হয়। সে বীভৎস দৃশ্য দেশবাসী দেখেছে। কত পাষ- হয়ে মানুষ এমনটি করতে পারে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ ছিল ওইদিন বিকেল ৩টায়। ভোর ৬টা থেকে রাজপথ দখলের, সন্ত্রাসী আচরণের চেষ্টা কারা করেছিল? কেন করেছিল? বিষয়গুলো খুব গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা দরকার।
আমরা পত্রপত্রিকায় দেখছি, একাত্তরের অন্যতম যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে- এই সন্দেহে তার অনুসারী একদল ক্যাডার তার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে বলেও বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর বেরোচ্ছে। গোলাম আযমকে গ্রেফতার করা হলেই দেশে একযোগে হামলা চালানো কিংবা নাশকতা করা হতে পারে বলে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞমহল আশঙ্কা করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি জঙ্গিবাদীদের ভয়ে আইনি প্রক্রিয়া ধীরগতি হয়ে যাবে? মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধমকির কাছে হেরে যাবে রাষ্ট্রপক্ষ? না, এমনটি আশা করা উচিত নয়। কারণ এদেশ ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমের শক্তি দ্বারা সুরক্ষিত।

সম্প্রতি বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ঢাকার একটি সমাবেশে বলেছেন, আলবদর-রাজাকার-আলশামস বাহিনীই দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। এই আলশামস-আলবদর বাহিনীর নেতা কারা ছিল? কারা দেশের বিভিন্ন স্থানে 'কসাই' কুখ্যাতি পেয়েছিল একাত্তর সালে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের কাছে দেশবাসী জানতে চায়। মওদুদ আহমদরা যদি এসব আলবদর-আলশামস নেতার পরিচয় জানেন, তবে জেনে-শুনে তারা এদের সঙ্গে জোটবদ্ধ রাজনীতি কেন করছেন? কোন বিবেকে করছেন? তাহলে কি দেশবাসী ধরে নেবে মওদুদ আহমদরা রাষ্ট্রের সঙ্গে, শহীদদের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতারণা করছেন? ছি, ধিক! এমন মানসিকতার!

বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর মনে রাখা দরকার, গোটা দেশ থেকে সশস্ত্র চোরাগোপ্তা সন্ত্রাসী দেশের শহরগুলোতে এনে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা আরও প্রকট হতে পারে। 'মরলে শহীদ আর বাঁচলে গাজি'- এই তত্ত্বের প্রবক্তারা তরুণদের বিভ্রান্ত করে আগুনের মুখে ঠেলে দিয়ে রাজনৈতিক কায়দা হাসিলের তৎপর হতে পারে, যা গোটা দেশের জন্য অশনি সংকেতের সমান।

খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের একাত্তরের ট্রেনিং কাজে লাগানোর যে আহ্বান করেছেন, তা দেশে একটি সহিংস সংঘাতের ইঙ্গিত বহন করছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধারা কি খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক মিত্র নিজামী-মুজাহিদ, গোলাম আযম, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সাঈদী গংকে বাঁচানোর জন্য তাদের ট্রেনিং কাজে লাগাবেন? কাজে লাগাতে রাজি হবেন? রাজি হওয়া উচিত?

খালেদা জিয়ার মূল লক্ষ্য তার দুই ছেলেকে বাঁচানো, তাদের রাজনীতিতে পুর্নবাসিত করা, দেশে ফিরিয়ে আনা, রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো। আমরা দেখছি খালেদাপুত্র তারেক রহমানও নিজামী-মুজাহিদদের সঙ্গে গলাগলি করে জনসভা করেছেন। মৌলবাদী রাজনীতির উত্তরসূরিরা এভাবেই বাংলাদেশে তাদের শিকড় বিস্তৃত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

দেশের এক চরম ক্রান্তিকালে মুক্তিযোদ্ধারা বীরদর্পে মাটি ও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশ এখন স্বাধীন। কিন্তু সেই পরাজিত ঘাতক দালাল-রাজাকারদের বিচার এখনো সম্পন্ন হয়নি। দেশের একটি চক্র এসব রাজাকারের বিচার চায় না। খালেদা জিয়া এই চক্রের প্রধান শক্তি হিসেবে নিজেকে বারবার জাহির করছেন তার কথায় ও কাজে। নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের বাঁচানোর জন্য তাদের ট্রেনিং কাজে লাগাবেন না।

বাংলাদেশে মধ্যস্বত্বভোগের রাজনীতি নতুন নয়। জঙ্গিবাদীদের মাঠে নামিয়ে জাতীয়তাবাদী সুবিধাবাদীরা আগেও মাঠ গরম করেছে। কারণ তারা জানে, মৌলবাদীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাদ দিলেই তারা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাবে। খালেদা জিয়া যদি এত বেশি মুক্তিযুদ্ধপ্রিয় হন, তবে রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গে ঐক্য ভাঙতে তার এত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেন?

মনে হচ্ছে, একটি অনিবার্য সংঘাতের দিকে দেশকে ঠেলে দেয়ার জোর প্রচেষ্টা করছে প্রধান বিরোধীদল। সরকারকে তাই সংযত হয়ে অগ্রসর হতে হবে। এই দেশ থেকে শহীদের রক্তছায়া আর ধর্ষিতা মায়ের আর্তি এখনো বিলীন হয়ে যায়নি। কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অথচ খালেদা জিয়ার মূল মিশন হচ্ছে, আলবদর-রাজাকারদের বিচার নস্যাৎ করা। তিনি তার মনের কথা কোনমতেই লুকিয়ে রাখতে পারছেন না।