ইতিহাস নিয়ে লিখে হুমায়ূন আহমেদ হতে চলছেন ইতিহাস.. ফিরে দেখা নিষিদ্ধ বই

ফকির আবদুল মালেক
Published : 15 May 2012, 03:33 PM
Updated : 15 May 2012, 03:33 PM

হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিতব্য রাজনৈতিক উপন্যাস 'দেয়াল' সংশোধন না করে প্রকাশে বারণ করেছে হাই কোর্ট।

মঙ্গলবার বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই আদেশ দেয়।

সংবাদপত্রে আগাম প্রকাশিত ওই উপন্যাসের দুটি অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলের হত্যাদৃশ্যের যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে- তাতে আপত্তি জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সোমবার বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন।

আদালত বলেন, "হুমায়ূন আহমেদ একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক এবং শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তিনি দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। আমরা কোনো আদেশ দিয়ে তাকে বিব্রত করতে চাই না। তবে নতুন প্রজন্ম ভুল ইতিহাস জানুক- সেটাও আমরা চাই না। বিষাদসিন্ধু- ইত্যাদি যেভাবে আছে পাঠকরা সেভাবেই ঘটনা জানে।"

ধরে নেয়া যায়, আলোচিত হতে যাচ্ছেন হুমায়ুন আহমেদ। দেখা যাক আলোচনা কোন দিকে যায়। এই সুযোগে দেখি আসি বিশ্বসাহিত্যের নিষদ্ধ গ্রন্থ নিয়ে একটি ব্যাপক আলোচনায়। কারো ধৈর্য্য থাকলে পড়ে দেখতে পারেন।

বিশ্বসাহিত্যের নিষিদ্ধ গ্রন্থ
ঔপন্যাসিক জেমস জয়েসের ইউলিসিস, জন স্টেইনবেকের অব মিক এন্ড ম্যান, নভোকভের লোলিটা, ডি এইচ লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লিস লাভার, টনি মরিসনের দ্য ব্লুয়েস্ট আই , সমরেশ বসুর প্রজাপতি ও হুমায়ুন আজাদের নারী ইত্যাদি উপন্যাস প্রকাশের পর পরই নিষিদ্ধ হয়। ধর্মীয় অনুভূতি, অশ্লীলতা, রাষ্ট্র ও মানবতাবিরোধীর অভিযোগ এনে জ্ঞানবৃক্ষের এমন ফলকে দূরে রাখা হয় পাঠক সানি্নধ্য থেকে। পরবর্তী সময়ে এই গ্রন্থগুলোই বিশ্বসাহিত্যের ক্ল্যাসিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয় পাঠকমহলে। এমন গ্রন্থ নিয়ে আমাদের এই বিশেষ আয়োজনবিশ্বসাহিত্যের নিষিদ্ধ গ্রন্থ জ্ঞানবৃক্ষের ফল : এখনো নিষিদ্ধ! শরীফ আতিক-উজ-জামানস্রষ্টার নিষেধ অমান্য করে শয়তানের প্ররোচনায় জ্ঞানবৃক্ষের নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করার জন্য স্বর্গ থেকে আদম ও ঈভের পতন ঘটেছিল। সমগ্র মানবজাতি এখনো সেই পাপের মাসুল গুনছে এবং একদিন যিশুখ্রিস্ট ফিরে এসে মানুষের সেই পাপ মোচন করবেন, যাতে তারা পরিশুদ্ধ হয়ে ঈশ্বরের কাছে ফিরে যেতে পারে। আদি পাপের খ্রিস্টীয় ধারণাটি এ রকমই। আবার কোনো কোনো ধর্ম বিশ্বাস করে, প্রাথমিক অবাধ্যতার পর আদম ও ঈভ অনুতপ্ত হলে ঈশ্বর তাদের ক্ষমা করেন এবং স্বর্গ থেকে তাদের মর্ত্যে অবরোহণ কোনো পতন বা শাস্তি নয়, বরং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। আদম ও তাঁর বংশধররা স্রষ্টার দূতরূপে পৃথিবীতে এসেছেন এবং স্রষ্টা দুনিয়া পরিচালনার গুরুদায়িত্ব তাঁদের ওপর ন্যস্ত করেছেন। ধর্মতত্ত্বের এ ব্যাখ্যায়ই মানুষ সন্তুষ্ট থাকতে চায়, কিন্তু স্রষ্টা মানুষের জন্য জ্ঞানবৃক্ষের ফল কেন নিষিদ্ধ করেছিলেন সেই প্রশ্নের খুব যুৎসই জবাব পাওয়া যায় না। যেমন জবাব পাওয়া যায় না সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষের যুগে, যখন বাক্-স্বাধীনতার স্বীকৃতি রয়েছে তখন কেন গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়? জ্ঞানের ওপর কেন নানা রকম নিষেধাজ্ঞার খৰ নেমে আসে? বিভিন্ন সময় আমরা দেখতে পাই কখনো সরকার, কখনো বিশেষ কোনো কর্তৃপক্ষ, শুল্ক বিভাগ, এমনকি ব্যক্তি প্ররোচনায় অনেক বিখ্যাত গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়েছে। এমনসব গ্রন্থ প্রকাশ্যে পুড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে যার মূল্য নানা দিক দিয়েই অপরিসীম। এযাবৎ যেসব গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার তালিকা অনেক দীর্ঘ। সেই দীর্ঘ তালিকা থেকে আমরা আলোচনার জন্য বিশেষ কয়েকটি গ্রন্থ নির্বাচন করেছি। এই আলোচনায় আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করব গ্রন্থগুলোর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ, নিষিদ্ধের প্রকৃত কারণ এবং নিষিদ্ধকারী কর্তৃপক্ষের পরিচয়।
ইউলিসিস

বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মর্যাদা পেয়েছে আইরিশ লেখক জেমস জয়েসের মহাকাব্যিক উপন্যাস ইউলিসিস। গ্রন্থটি প্রকাশের পর থেকেই পাঠকের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছিল। অনেকেই গ্রন্থটিকে ইতিপূর্বে লেখা উপন্যাসের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মৌলিক বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। বইটিতে ডাবলিনে বসবাসকারী তিনজন মানুষ স্টিফেন ডিডালাস, লিওপোল্ড ব্লুম ও তাঁর স্ত্রী মলি ব্লুমের একটি দিনের ঘটনাপ্রবাহকে ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতীকী অর্থে ইউলিসিস গ্রিক কবি হোমারের মহাকাব্য ওডিসি'র কৌতুককর অনুকরণ।

এই উপন্যাসে জয়েস তিনটি চরিত্রের ভেতর-বাহিরের ঘটনা ও ভাবনাকে তুলে ধরে ব্যক্তিজীবনকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চেয়েছেন। সেইসঙ্গে ভাষার পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়েছেন খুব। প্রথাগত মহাকাব্যিক ভাষা ও কমিক গদ্যের মিশ্রণে তিনি নতুন এক ভাষাশৈলী সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। তবে উপযুক্ত যতিচিহ্ন ব্যবহারের ঘাটতি ও বর্ণনাশৈলীর দুর্বলতা গ্রন্থটি পাঠে অসুবিধার সৃষ্টি করে। আর অতিরিক্ত যৌনতা-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিতর্ক উসকে দেয়।

আমেরিকার দ্য লিটল রিভিউ জার্নালে ১৯১৮ সালের মার্চ থেকে ১৯২০ সাল-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ইউলিসিস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়, যদিও উপন্যাসটি লেখা শুরু হয়েছিল আরো আগে, ১৯১৪ সালে। কিন্তু ধারাবাহিক প্রকাশনার শেষ বছরে এসে বাধে বিপত্তি। একটি অধ্যায়ে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের হস্তমৈথুনের বর্ণনায় নিউইয়র্ক সোসাইটি ফর দ্য সাপ্রেশন অব ভাইস নামক একটি গোষ্ঠী তীব্র আপত্তি তুলে অশ্লীলতার অভিযোগ নিয়ে আসে এবং গ্রন্থটিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চালায়। শেষমেশ ঘটনাটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ১৯২১ সালে এই পত্রিকাটিকে অশ্লীল ঘোষণা করা হলে যুক্তরাষ্ট্রে ইউলিসিসের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩৩ সালে প্রকাশনা সংস্থা র্যাানডম হাউস ফ্রান্স থেকে বইটি আমেরিকায় আমদানি করতে গেলে শুল্ক বিভাগের হাতে ধরা পড়ে। বিষয়টি আদালতে গড়ালে জেলা জজ জন এম উলসে এই মর্মে রায় দেন যে বইটি আদৌ অশ্লীল নয়। এর বিরুদ্ধে আপিল হলে এ রায়ই বহাল থাকে। স্টুয়ার্ট গিলবার্ট এ রায়কে 'যুগান্তকারী' হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

দ্য গ্রেপস অব র্যাছথ
জন স্টেইনবেকের দুটি উপন্যাস The Grapes of Wrath ও Of Mice and Men নিষিদ্ধ হয়েছিল মূলত রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু অভিযোগ আনা হয়েছিল যৌনতা, স্রষ্টার প্রতি অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ ও রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ নির্বাহীদের ব্যঙ্গ করার। ১৯৩৯ সালের ১৪ মার্চ যখন The Grapes of Wrath প্রকাশিত হয় তখন সারা আমেরিকায় হইচই পড়ে যায়, কারণ এই উপন্যাসে ১৯৩০ সালের মহামন্দার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত আমেরিকার কৃষকদের জীবনের যে করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা মানুষকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। মাত্র ছয় মাসের মধ্যে এই গ্রন্থের অর্ধ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু সেইসঙ্গে শুরু হয় তীব্র বিতর্ক। অনেকেই কাহিনীতে বর্ণিত দারিদ্র্য ও হতাশার চিত্রে মর্মাহত হন আবার কেউ কেউ আমেরিকায় এমন বিপর্যয়ের সম্ভাবনাকে একবাক্যে নাকচ করে দেন। বইটির বিরুদ্ধে অশ্লীলতার ব্যাপক অভিযোগ এনে বাফেলো, নিউইয়র্ক, ইস্ট সেইন্ট লুইস, ইলিনয়, ক্যালিফোর্নিয়ায় কপি পোড়ানো হয়। কংগ্রেসে ওকলাহোমার প্রতিনিধি লিলি বোরেন কৃষিশ্রমিকদের অভিবাসনকে ডাহা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেন। বইয়ের কাটতি বাড়াতে যত্রতত্র অশ্লীলতা প্রয়োগ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন। কিন্তু ফার্স্টলেডি ইলিনর রুজভেল্ট স্টেইনবেকের পাশে দাঁড়ান এবং বইটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯৪০ সালে উপন্যাসটি পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করে।

শুরুতে নরহত্যার অভিযোগে ৪ বছর জেল খেটে বেরোনো টম জোড খামারে ফিরে দেখতে পায় সেখানে কেউ নেই, খামারটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রতিবেশী মুলি গ্রেভসের কাছ থেকে জানতে পারে কিভাবে ব্যাংকগুলো খামারের দখল নিয়ে সবাইকে সেখান থেকে বিতাড়িত করেছে। চাচা জন জোডের বাড়িতে সে পরিবারের অন্য সদস্যদের দেখতে পায়। তারা সবাই তখন ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবাই মিলে একটি লক্কড়-ঝক্কড় ট্রাকে চেপে নতুন গন্তব্যের দিকে ছুটল। এভাবেই শুরু উপন্যাসের।

উপন্যাসটিতে স্টেইনবেক আশা-হীনতার দ্বন্দ্ব, শ্রেণী-সংঘাত, ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। জোডপরিবার প্রচণ্ড দুঃখ-দুর্দশা-বঞ্চনা সহ্য করার পরও তাদের মাঝে এক ধরনের শ্রেণীসচেতনতা গড়ে ওঠে; মৃতপ্রায় লোকটিকে স্তন পান করানো সেই সচেতনতারই প্রতিফলন। কিন্তু এই জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে সবাই গ্রহণ করতে পারেনি। এর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং কিছু রাজ্যে গ্রন্থটি নিষিদ্ধও হয়েছিল। যে সত্য তিনি তুলে ধরেছিলেন সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্পৃক্ততা ও নির্লিপ্ততা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার ৪০ শতাংশ কৃষিজীবী পথে বসেছিল। কিন্তু এদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এই নির্লিপ্ততার সমালোচনা তাই শাসকদের ক্ষিপ্ত করেছিল, যা গ্রন্থটিকে নিষিদ্ধ করতে উৎসাহ জুগিয়েছে, কিংবা যারা গ্রন্থটি পুড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে তাদের ব্যাপারে সরকার নির্লিপ্ত থেকেছে।

অব মাইস অ্যান্ড মেন
জন স্টেইনবেকের আরেকটি উপন্যাস আমেরিকার কয়েকটি বিদ্যালয় ও লাইব্রেরিতে নিষিদ্ধ হয়েছিল প্রণোদিত হত্যাকাণ্ড ও ধর্মদ্বেষী বক্তব্যের কারণে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৪ এবং ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত দু'দফায় বইটি নিষিদ্ধ ছিল। একজন আফ্রো-আমেরিকান পিতা তাঁর সন্তানের স্কুলে বইটি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছিলেন কারণ তাতে বিতর্কিত nigger শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সংক্ষিপ্ত এই উপন্যাসে স্টেইনবেক বন্ধুত্ব, সহমর্মিতার মতো গুরুত্বপূর্ণ মানবিক বিষয়গুলো তুলে ধরার পাশাপাশি ভিন্ন জাতিসত্তা, দুর্বল সামাজিক অবস্থানের মানুষের প্রতি কিছু মানুষের সংবেদনহীনতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মানবিক সমস্যার সহিংস সমাধানকে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।

প্রধান চরিত্র দুটির কর্মকাণ্ড কখনো কখনো পাঠকের কাছে অদ্ভুত মনে হয়। কিন্তু তা সহানুভূতি দাবি করে। এখানে দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকাণ্ডের মাঝে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। কাহিনীতে ব্যাপক সহিংসতা রয়েছে কিন্তু এমন একটি বার্তাও রয়েছে যে সহিংস পথেই পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটে থাকে। অনেক জীব দুর্ঘটনার কারণে কিংবা প্রাকৃতিক নিয়মে বেঁচে থাকার সংগ্রামে পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। মানুষের জীবনে সহিংসতার গুরুত্ব ও অবশ্যম্ভাবিতা এমন এক প্রসঙ্গ যাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এমনই এক বার্তা এ উপন্যাসে রয়েছে, আর এখানেই অনেকে আপত্তি তুলেছেন এবং নিষিদ্ধের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন।

দ্য ব্লুয়েস্ট আই
টনি মরিসনের দ্য ব্লুয়েস্ট আই পেকোলা ব্রিডলাভ নাম্নী এক নিগ্রো বালিকার গল্প, যে তার পিতা কোলি ব্রিডলাভ কর্তৃক ধর্ষিত হয়। লরেইনের এই দরিদ্র পরিবারটি আর দশটা অসহায় নিগ্রো পরিবারের মতো নানাভাবে বঞ্চিত। বাবা প্রায়ই কর্মহীন থাকে, মা বাড়িতে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। ছেলেমেয়ে দুটো আগাছার মতো অবহেলায় বেড়ে ওঠে। বাড়িতে সব সময় ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকে, কখনো কখনো তা মারামারি পর্যন্ত গড়ায়। এতে ছেলেটি প্রায়ই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় আর মেয়েটি ওপরতলায় গিয়ে গণিকাদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটায়। পেকোলা মনেপ্রাণে একজোড়া নীল চোখ কামনা করে। পেকোলার আকাঙ্ক্ষা আর লরেইনের কালো মানুষদের বিভিন্ন ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়, তারা বিশ্বাস করে সাদা মানেই সুন্দর আর কালো মানেই কদর্য। আবার উপন্যাসের অশ্বেতাঙ্গ চরিত্ররা শ্বেতাঙ্গদের সমকক্ষ হতে বা তাদের ছাড়িয়ে যেতে চায় আর আফ্রিকান বৈশিষ্ট্যকে ঘৃণা করে। ম্যাকতিয়ার পরিবারের ছোট মেয়ে ফ্রিডাকে তাদের ভাড়াটিয়া হেনরি যৌন হয়রানি করলে তাদের মা-বাবা মেয়েকে সবধরনের সমর্থন জুগিয়ে যায়, আর ব্রিডলাভ পরিবারে পিতার হাতেই কন্যা ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়। লাঞ্ছিত ও পরিত্যক্ত পেকোলা মরিয়া হয়ে একজন ভবিষ্যৎবক্তার কাছে যায় একজোড়া নীল চোখের আর্জি নিয়ে। সে তাকে একটি রোগাক্রান্ত কুকুরকে হত্যার কাজে ব্যবহার করে। নির্বোধ বালিকা সরল বিশ্বাসে বিষ মাখানো মাংস কুকুরটির মুখে তুলে ধরলে কুকুরটির মৃত্যু হয়, কিন্তু গণকের কথা অনুযায়ী সে নীল চোখ উপহার পায় না। আতঙ্কিত পেকোলা ছুটে পালিয়ে যায়। এরপরই সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। দিন-রাত একজন কাল্পনিক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে সে সময় কাটায়। তাদের আলোচনার প্রসঙ্গ নীল চোখ। এভাবেই সে বাকি জীবন পাগল হয়ে বেঁচে থাকে। পরিবারের নাম ব্রিডলাভ হলেও পরিবারের সদস্যদের মাঝে কোনো love বা প্রেম ছিল না, আর breed শব্দটি তাদের জন্য চরম অশুভ হয়েছিল কন্যার প্রতি কোলির ধর্ষকামী আচরণের কারণে।

১৯৭০ সালে আমেরিকায় নাগরিক অধিকার আন্দোলন চলার সময় গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সেই আন্দোলনে আফ্রো-আমেরিকানরা তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লড়ছিল। সাদা হওয়াটাই সৌন্দর্যের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। কালোরা সৌন্দর্যের নতুন মানদণ্ড ও সংজ্ঞার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছিল, যার সঙ্গে জাতিসত্তা ও নৃতাত্তি্বক বৈশিষ্ট্য সম্পৃক্ত ছিল। কোনো তুলনা নয়, কালোরা কালো হিসেবেই সুন্দর_এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড় করাতে চাইছিলেন তাঁরা। পেকোলার কাহিনী তুলে ধরে নির্মম মানসিক যন্ত্রণাপীড়িত এই কালো মানুষরা।

এ বইটি নিয়ে প্রথম আপত্তি ওঠে লিভিংস্টোন কাউন্টির একটি উচ্চবিদ্যালয়ে, যেখানে বইটি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। যৌনতাই ছিল মূল আপত্তির বিষয়। Livingston Organization for Values in Education (LOVE) নামক একটি রক্ষণশীল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি কাউন্টির সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তাকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার অনুরোধ করে বলেছিলেন, ছাত্রদের জন্য প্রযোজ্য যৌনশিক্ষার মাত্রা গ্রন্থটিতে অতিক্রম করে গেছে কি-না। গ্রন্থটি পাঠ করে আইন কর্মকর্তা মত দেন, যে অধ্যায়গুলো উল্লেখ করে আপত্তি তোলা হয়েছে তার গভীর শিল্প ও সাহিত্যমূল্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক বক্তব্য রয়েছে। শুধু যৌনতা ছড়ানো এর উদ্দেশ্য নয়, এখন স্কুলবোর্ড কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক, এখানে ছাত্রদের জন্য প্রযোজ্য যৌনতার মাত্রা অতিক্রম করেছে কি-না। তবে ফৌজদারি আইন ভঙ্গের মতো কোনো কারণ এখানে ঘটেনি। এরপরও গ্রন্থটি স্কুলে নিষিদ্ধ হয়েছিল।

অ্যাজ আই লে ডাইং
উইলিয়াম ফকনারের As I Lay Dying (১৯৩০) প্রকাশের ৫৬ বছর পর কেনটুকির একটি স্কুলবোর্ড বইটিকে নিষিদ্ধ করেছিল। অভিযোগ ছিল, এই গ্রন্থে ঈশ্বরনিন্দা, গর্ভপাতের মতো বিষয় এবং bastard, goddam I son of a bitch-এর মতো অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বোর্ডের কোনো সদস্যই বইটি পড়েননি।

As I Lay Dying উপন্যাসে মিসিসিপির একটি পরিবারের কাহিনী ধারণ করা হয়েছে। এই পরিবারের কর্ত্রীর মৃত্যুর পর তার অন্তিম ইচ্ছাকে শ্রদ্ধা জানাতে তার পরিবারের সদস্যরা জেফারসনে তার পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করার জন্য ৯ দিন ধরে ৪০ মাইল পথপরিক্রমা করে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আবহাওয়ার মধ্যে এই পথ পাড়ি দেয়ার সময় যেসব ঘটনা ঘটে তার চটুল ও হাস্যরসাত্মক বর্ণনা রয়েছে। এই ভ্রমণের বর্ণনায় ১৫ জন কথক ব্যবহার করা হয়েছে। প্রত্যেক কথক ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যক্তি ও ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন।

উপন্যাস যখন শুরু হয় গৃহকর্ত্রী এডি তখন মৃত্যুশয্যায়। তার শয়নকক্ষের বাইরে জ্যেষ্ঠপুত্র ক্যাশ বানড্রেন নিখুঁতভাবে তার কফিন তৈরি করছে। বাড়ির সামনের দরজায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুত্র ডার্ল ও জুয়েল বানড্রেন জরুরি কাজে বাইরে যাওয়ার জন্য বাবার কাছে অনুমতি চাইছে। কিন্তু যাত্রার শুরুতেই বিপত্তি বাধল। শহরের নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি প্রবল বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাওয়ায় তাদের আরো বিলম্ব হতে লাগল।

কোনোমতে নদী পার হওয়ার পর আনস জুয়েলের ঘোড়ায় চড়ে খচ্চর কিনে আনতে গেল, কিন্তু ইতিমধ্যে এডির মৃতদেহ থেকে দুর্গন্ধ বের হতে শুরু করেছে। শেষমেশ আনস ফিরে এলো, ঘোড়া বিক্রি করে দিয়ে সে কয়েকটি খচ্চর কিনে এনেছে। আনস-এডির কন্যা ডিউয়ি ডেল তার প্রেমিকের সঙ্গে মেলামেশার কারণে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। প্রেমিকের পরামর্শে সে গর্ভপাত ঘটাতে চায়, আর তাই শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় একটি ওষুধের দোকানে গর্ভপাতের বড়ি খোঁজ করে না পেয়ে সে হতাশ হয়। আট দিনের মাথায় এডির পচনশীল দেহ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ালে টাউন মার্শাল দ্রুত তাদের শহর ছাড়ার নির্দেশ দিলেন। তাদের পথপরিক্রমার শেষরাত তারা জনৈক গিলেসপির গোলাঘরে কাটানোর অনুমতি পেল। কিন্তু রাতে ডার্ল গোলাঘরে আগুন লাগিয়ে দিল। আগুন থেকে কফিন উদ্ধার করতে গিয়ে জুয়েলের পিঠ পুড়ে গেল। যখন গিলেসপি বুঝতে পারলেন, ডার্ল আগুন লাগিয়েছে তখন তিনি হুমকি দিলেন, তাকে মানসিক হাতপাতালে না পাঠালে তিনি মামলা করবেন।

পরদিন জেফারসনে পেঁৗছে তারা এডিকে সমাহিত করল। সমাধিস্থল ছেড়ে বেরিয়ে এসে তারা মানসিক হাসপাতালের কর্মীদের হাতে ডার্লকে তুলে দিল। ডিউয়ি ডেল আরেকটি ওষুধের দোকানে গিয়ে গর্ভপাতের বড়ি খোঁজ করল। সেখানে চতুর বিক্রেতা তাকে এক বাক্স অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে দিল। এক পর্যায়ে সে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করল। অন্যত্র এক ডাক্তারের কাছে ক্যাশের পায়ের চিকিৎসা হলো। পরদিন সকালে আনস বানড্রেন বেরিয়ে গেলেন নতুন করে দাঁত বাঁধাই করতে, কারণ স্থানীয় যে মহিলার কাছ থেকে তিনি কবর খোঁড়ার যন্ত্রপাতি ধার করেছিলেন তাকেই তিনি নতুন মিসেস বানড্রেনরূপে বরণ করে নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

উইকিপিডিয়ার তালিকা অনুসারে বইটি কেনটুকিতে নিষিদ্ধ হয়েছিল এর ভাষা আর খ্রিস্টধর্ম-বিরোধী বক্তব্যের কারণে। খ্রিস্ট-বিরোধী বলতে একজন পাদ্রির বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, বিবাহপূর্ব যৌনসম্পর্ক, গর্ভপাত, অশ্লীল বাক্য ও বিনাকারণে ঈশ্বরের নাম নেয়ার জন্য।

দ্য বেল জার
কবি সিলভিয়া প্লাথের একমাত্র উপন্যাস 'দ্য বেল জার' পারিবারিক চাপে নিষিদ্ধের খপ্পরে পড়েছিল। লেখকের আত্মজৈবনিক উপাদান ছিল এই উপন্যাসে, যা তার পরিবারের জন্য বিব্রতকর হয়েছিল। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে। এর সাহিত্যমূল্য সম্পর্কে সন্দিহান হওয়ায় প্লাথ ভিক্টোরিয়া লুকাস ছদ্মনামে তা প্রকাশ করেন।

এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ম্যাসাচুসেটসের কলেজ শিক্ষার্থী এসথার গ্রিনউড নিউইয়র্কে আসে অতিথি সম্পাদক হিসেবে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতে। একজন অতি সহানুভূতিশীল নারী জে সীর হয়ে সে কাজ করতে আসে। মেয়েদের একটি হোস্টেলে এসথার ও বাকি ১১ জন ছাত্রীর থাকার ব্যবস্থা হয়। স্পন্সররা তাদের সবরকমের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। কিন্তু এসথার কেমন যেন উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, কারণ রোজেনবার্গসের ফাঁসি তাকে আতঙ্কিত করে তোলে এবং সে তার বান্ধবী ডোরিনের বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গিকে যেমন স্বাগত জানাতে পারেনি তেমনি পারেনি বেটসির অতি উৎসাহকে। খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে নিমন্ত্রণ খেয়ে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এসথার জাতিসংঘের এক কর্মীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও পুরুষটি কোনো আগ্রহ দেখাল না। কলেজশিক্ষার শেষে কী করবে ভেবে সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফিরে আসার আগের রাতে মার্কো নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে কিছু মুহূর্ত কাটানোর সময় মার্কো তাকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়। এসথার ভেবে পায় না সে কী করবে: একটি প্রথাগত জীবন বেছে নেবে নাকি তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সক্রিয় হবে। তার ছেলেবন্ধু বাডি উইলার্ড যক্ষ্মারোগ থেকে সেরে ওঠে এবং এসথারকে বিয়ে করতে চায়। বাইরে থেকে বাডিকে আদর্শ জুড়িই মনে হয় : সুদর্শন, নম্র, বুদ্ধিদীপ্ত ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু সে এসথারের কাব্য-আকাঙ্ক্ষাকে অনুধাবন করতে অক্ষম ছিল। তা ছাড়া সে যখন স্বীকার করল, এসথারের সঙ্গে প্রণয়কালীন সে একজন ওয়েট্রেসের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে তখন এসথার তাকে প্রতারক আখ্যা দিয়ে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায়। একটি রহস্যময় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সে তার কুমারিত্ব হারানোর প্রচেষ্টা চালায়।

এসথার বোস্টনের পল্লীতে ফিরে আসে এবং আবিষ্কার করে, তার পরিকল্পনা মতো কোনো লেখক শ্রেণীতেই সে পড়ে না। এরপর সে মায়ের সঙ্গে গ্রীষ্মটা কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর হঠাৎই একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করে শর্টহ্যান্ড শিখতে থাকে এবং শিক্ষায়তনিক গবেষণাকর্ম শুরু করে। শিগগিরই সে দেখল, সে কিছুই লিখতে, পড়তে এমনকি ঘুমাতে পর্যন্ত পারছে না। এক পর্যায়ে সে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিল। তার মা তাকে মনোচিকিৎসক ডা. গর্ডনের কাছে নিয়ে গেলে তিনি তাকে ইলেকট্রিক শকথেরাপির পরামর্শ দিলেন। এই চিকিৎসার পর এসথার আরো বেশিমাত্রায় অক্ষম হয়ে পড়ল। হতাশায় সে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিল; কিন্তু কব্জি কেটে, ফাঁস লাগিয়ে, জলে ডুবে, ঘুমের বড়ি খেয়ে নানাভাবে আত্মহননের চেষ্টা চালিয়ে সে ব্যর্থ হলো। এরপর তাকে অন্য একটি বেসরকারি মনোচিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠানো হলে সেখানকার ডাক্তার নোলান তার চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। এই নারী চিকিৎসককে এসথারের পছন্দ হলো। তিনি তাকে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তুলতে লাগলেন। এই চিকিৎসাকেন্দ্রে তার সঙ্গে জোয়ান নাম্নী এক মহিলার বন্ধুত্ব হলো। সেও মনঃস্তাত্তি্বক সংকটে ভুগছিল। কিন্তু জোয়ানের সমকামিতার প্রচেষ্টায় সে বিস্মিত ও বিরক্ত হলো। অবস্থার উন্নতি হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মাঝে মাঝে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিত। এই যাওয়া-আসার মাঝেই একদিন আরভিন নামের এক গণিতের অধ্যাপকের কাছে সে তার কুমারিত্ব হারায়। সঙ্গমের প্রথম অভিজ্ঞতা খুব আনন্দের হয়নি। প্রচুর রক্তপাতের ফলে তাকে জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়। এক সকালে গলায় ফাঁস লাগিয়ে জোয়ান আত্মহত্যা করে। বাডি এসথারকে দেখতে হাসপাতালে আসে, দু'জনেই তাদের সম্পর্কের সমাপ্তিকে মেনে নেয়। শীতকালীন সেমিস্টার শুরু করার জন্য এসথার হাসপাতাল ত্যাগ করে। সে বিশ্বাস করে, সাময়িক সুস্থতা লাভ করলেও তার পাগলামি আবার ফিরে আসতে পারে।

এটি একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস। এসথারের সঙ্গে প্লাথের জীবন কাহিনীর প্রায় হুবহু মিল রয়েছে। এ সময়ে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন তিনি। পরের বছরই রান্নাঘরে গ্যাসের চুলা থেকে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন প্লাথ। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩১ বছর। এই উপন্যাসটি তিনি সম্ভবত ১৯৫০-এর দশকে লিখতে শুরু করেন। ১৯৬১ সালে তিনি তা শেষ করার জন্য একটি ফেলোশিপ লাভ করেন। ভিক্টোরিয়া লুকাস ছদ্মনামে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে লন্ডনে। প্রকৃত নামে বের হয় ১৯৬৭ সালে, কিন্তু ১৯৭১ সালের আগে তা আমেরিকাতে প্রকাশিত হয়নি তাঁর সাবেক স্বামী টেড হিউজ ও মায়ের হস্তক্ষেপের কারণে।

আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস
একজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর ব্যক্তিজীবনের বেদনাঘন কাহিনী মায়া অ্যাঞ্জেলুর Know Why the Caged Bird Sings ১৯৩০ শতকে আরকানসাসে একটি নিভৃত পল্লীতে তিন বছর বয়সে মাতা কর্তৃক পরিত্যক্ত একটি শিশু অপার বেদনা নিয়ে বেড়ে উঠছিল। তার অনাকর্ষণীয় শরীর ও যৌনানুভূতির ঘাটতি ছিল। আবার যে পুরুষটি তাকে ধর্ষণ করেছিল তার মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেকে খানিকটা দায়ী মনে করেন। প্রথম সন্তান গাইয়ের জন্মের আগ পর্যন্ত নিজের নিয়তির ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যে পরিস্থিতিতে তিনি গর্ভবতী হলেন এবং সন্তান গাইকে মেনে নিলেন তার সঙ্গে খাঁচাবন্দি পাখির তুলনা চলে। এর থেকে তিনি মুক্তি খুঁজলেন এবং নিজের জীবনের ভার নিজের হাতে তুলে নিতে চাইলেন। বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার মিশেলে অ্যাঞ্জেলু তার উপন্যাসকে দাঁড় করিয়েছেন। এই গ্রন্থে একজন শ্বেতাঙ্গ দন্ত চিকিৎসকের প্রসঙ্গ রয়েছে যা সত্য। এই চিকিৎসক কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে তার চিকিৎসা করতে চাননি। অ্যাঞ্জেলু তার নাম দিয়েছেন ডা. লিংকন, যিনি শ্বেতাঙ্গদের প্রতিনিধি। এই নামের মধ্য দিয়ে তিনি ব্যঙ্গ করছেন প্রেসিডেন্ট লিংকনের ১৮৬৩ সালের দাসত্ব মুক্তির বিবৃতিকে। যাতে তিনি দাবি করেছিলেন, কালোরা সবরকমের বন্ধন থেকে মুক্ত। এ ধরনের শৈলী তার লেখনীকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
উপন্যাসের কাহিনী শুরু হচ্ছে ১৯৩১ সালে, মায়ার শৈশব-স্মৃতিচারণ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে তা এগিয়ে যায়। বৈশ্বিক মহামন্দার দুর্ভোগ যেমন উপন্যাসের কাহিনীর মাঝে রয়েছে, তেমনি হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ লড়াইয়ে জো লুইয়ের বিজয়ের প্রসঙ্গও আছে। এর মাধ্যমে তিনি দেখাতে চাইছেন, কালোদেরও সামর্থ্য রয়েছে শ্বেতাঙ্গপ্রধান সমাজে কর্তৃত্ব করার। এ উপন্যাসে অ্যাঞ্জেলু আত্মজৈবনিক উপন্যাসের দুটি প্রথাগত বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন : প্রতিবন্ধকতাকে জয় আর আত্মপরিচয় অনুসন্ধান।

উপন্যাসে তিনি দ্বৈতসত্তার দৃষ্টিভঙ্গি শৈশবের মায়া আর পরিণত অ্যাঞ্জেলুর দৃষ্টিভঙ্গিকে চমৎকারভাবে গাঁথতে পেরেছেন। এখানে অ্যাঞ্জেলু দুই ব্যক্তিত্ব ধারণ করেছেন : মায়ার কণ্ঠস্বর কখনো মর্মভেদী শোনায় যখন তিনি তাঁর শৈশব-কৈশোরের নিগ্রহের কথা শোনান আর অ্যাঞ্জেলুর কণ্ঠে আমরা পাই এক অন্তর্ভেদী, বস্তুনিষ্ঠ ও পরিণত সুর।

১৯৯০-২০০০ সালের মধ্যে নিষিদ্ধের হুমকির তালিকায় থাকা ১০০ বইয়ের মধ্যে তৃতীয় স্থানে ছিল I Know Why the Caged Bird Sings। ১৯৮৩ সাল থেকেই আমেরিকার স্কুলবোর্ড কর্তৃপক্ষ বইটি নিষিদ্ধ করার তৎপরতা চালিয়ে আসছে। অভিযোগ খুবই সনাতন : সমকামিতা, বিবাহপূর্ব শারীরিক সম্পর্ক, পর্নোগ্রাফি ও সহিংসতা। ঈশ্বরের প্রতি নিন্দাসূচক ভাষা ব্যবহারও লাইব্রেরি থেকে সরিয়ে নেয়ার একটি কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে অ্যালাবামা স্টেট স্কুল টেক্সটবুক কমিটি শ্বেতাঙ্গদের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ এনেছিল বইটির বিরুদ্ধে। এখনো এই গ্রন্থটি আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে রয়েছে।

দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল
কানাডার ঔপন্যাসিক মার্গারেট অ্যাটউড-এর ডিসটোপিয়ান (dystopian) উপন্যাস The Handmaid's Tale প্রকাশিত হলে দ্রুতই বেস্টসেলারের তালিকায় স্থান করে নেয়। এই শ্রেণীর উপন্যাসের মূল বৈশিষ্ট্য হলো একটি কল্পরাজ্য বা সমাজ উপস্থাপনা, যেখানে সবকিছুই ভীতিজাগানিয়া ও নিবর্তনমূলক। এই উপন্যাসে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ডিসটোপিয়াকে দেখা হয়েছে। উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল আমেরিকার নির্বাচনে রোনাল্ড রিগ্যান ও ব্রিটেনের নির্বাচনে মার্গারেট থ্যাচারের বিজয়ের পর। এ সময়টি পশ্চিমে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার পুনর্জাগরণের কাল। বিগত শতকগুলোর সব প্রগতিশীল অর্জন এই 'ধর্মীয় অধিকার' জাগরণের লড়াইয়ের কারণে হারিয়ে যাবে এমন একটি আশঙ্কা নারীদের মধ্যে জেগে উঠেছিল। এই উপন্যাসে অ্যাটউড দেখিয়েছেন কীভাবে নারী-অধিকার হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। গিলিড নামে একটি কল্পরাজ্য তিনি সৃষ্টি করেছেন যেখানে একটি ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসীন। তারা এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠায় কৃতসংকল্প যেখানে 'প্রথাগত মূল্যবোধ' পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং নারী পুরুষের ইচ্ছাধীন থাকবে। কিন্তু নারীরা প্রথাগত লৈঙ্গিক ভূমিকা থেকে মুক্তি পেতে চায়। ১৯৭০-এর দশককে তারা অর্জনের দশক হিসেবে বিবেচনা করে যখন জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল, গর্ভপাতের আইনসম্মত অধিকার পাওয়া গিয়েছিল এবং নারীভোটারদের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু গিলিড নামক রাজ্যে নারীরা শুধু ভোটাধিকারই নয়, পড়ালেখার অধিকার থেকেও বঞ্চিত। এই উপন্যাসে অ্যাটউড একইসঙ্গে এমন এক বিপর্যস্ত পৃথিবীর চিত্র তুলে ধরেছেন যা দূষিত ও অনুর্বর এবং সেইসঙ্গে জন্মহার হ্রাস, পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের ভীতি এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের হুমকিকে ধারণ করছে।
এরপর একদিন অফরেড দোকানে গেলে তার সঙ্গে নতুন অফগ্লেন দেখা করে। এই নতুন মহিলা জানায়, অফগ্লেন আত্মহত্যা করেছে, কারণ গোয়েন্দারা তাকে চিনে ফেলে ধরতে এসেছিল। অফরেড একটি কালো ভ্যান দেখতে পেল। নিকের মাধ্যমে সে জানতে পারল, মে ডে'র সদস্যরা তাকে উদ্ধার করতে এসেছে। সে তাদের সঙ্গে চলে গেল, কিন্তু জানে না কোথায়, বন্দিশালায় নাকি মুক্ত পৃথিবীতে।

উপন্যাসটি শেষ হচ্ছে একটি সমাপ্তি ভাষণ দিয়ে। গিলিডের পতনের পর প্রফেসর পিক্সোটো বক্তৃতার ঢঙে লিখিত এই বিবৃতি প্রদান করছেন। তাতে তিনি বিশ্লেষণধর্মী ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন গিলিডের গঠন, প্রথা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে। তিনি অফরেডের কাহিনীর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। নিক তাকে পালানোর ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু তারপর তার কী হলো তা অজানা। সে হয়তো কানাডা বা ইংল্যান্ডে পালিয়ে গেছে, নয়তো আবার ধরা পড়েছে। ১৯৯০-এর দশকে দ্য আমেরিকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের ১০০টি নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় The Handmaid's Tale-এর অবস্থান ছিল ৩৭তম। টেক্সাসের একটি গোষ্ঠী গ্রন্থটিকে খ্রিস্টবিরোধী ও অশ্লীল ঘোষণা করেছিল। সান অ্যান্টোনিওর জাডসন স্কুল ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের সুপারিনটেন্ডেন্ট অ্যাড লেমান অভিভাবকদের অভিযোগের ভিত্তিতে পাঠ্যসূচি থেকে গ্রন্থটিকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবকদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটি বইটিকে নিষিদ্ধ না করার সুপারিশ করলেও লেমান তা আমলে নেননি।

আলোচিত গ্রন্থগুলো ছাড়াও সাময়িক ও চিরতরে নিষিদ্ধের তালিকায় রয়েছে অজস্র বই। নরাত্মারোপিত প্রাণীরা মানুষের মতো আচরণ করছে_ এ অভিযোগে চিনে লিউস ক্যারোলের Alice's Adventures in Wonderland; জার্মান সশস্ত্র বাহিনী ভারম্যাকট (Wehrmacht)-কে সমালোচনা করার জন্য এরিখ মারিয়া রিমার্কের All Quiet on the Western Front নাজি জার্মানিতে; জর্জ অরওয়েলের Animal Farm জার্মানিতে, ১৯৪৬ সালে যুগোশ্লাভিয়ায়, ১৯৯১ সালে কেনিয়ায় এবং ২০০২ সালে ইউনাইটেড আরব আমিরাতে নিষিদ্ধ হয়েছিল। অশ্লীলতার অভিযোগে ১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস বিভাগ ভলতেয়ারের উপন্যাস Candide-কে আটক করেছিল। ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের আপত্তির মুখে ড্যান ব্রাউনের The Da Vinci Code লেবাননে; আয়ান গিবসনের The Death of Lorca স্পেনে; বলশেভিক পার্টির সমালোচনা করার জন্য বরিস পাস্তেরনাকের Doctor Zhivago ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নে; গুয়েতেমালার শাসক দলের সমালোচনার কারণে মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল অস্তুরিয়াসের উপন্যাস El Senor Presidente গুয়েতেমালায়; বেশিমাত্রায় বামপন্থি আদর্শ প্রচার করায় প্রমোদ্য অনন্ত তোয়ে'র উপন্যাস The Fugitive Perburuan ইন্দোনেশিয়ায়; অশ্লীলতার অভিযোগে সানফ্রান্সিসকো কাস্টমস কর্তৃক ১৯৫৭ সালে অ্যালেন গিন্সবার্গের কাব্যগ্রন্থ Howl; নাডিন গর্ডিমারের উপন্যাস July's People সাউথ আফ্রিকায়; যশবন্ত সিং-এর জীবনী ঔJinnah: India-Partition-Independence ভারতের গুজরাটে; মদ ও শূকরের মাংসের প্রতি জিন্নাহর পছন্দের বিষয়টি উল্লেখ থাকায় স্ট্যানলি ওলপার্টের Jinnah of Pakistan গ্রন্থটি পাকিস্তানে; অশ্লীলতার অভিযোগে ভ্লাদিমির নবোকভের লোলিতা ফ্রান্স, ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড, আর্জেন্টিনা ও সাউথ আফ্রিকায়; স্টালিনের নেতৃত্বকে কটাক্ষ করার জন্য জর্জ অরওয়েলের Nineteen Eighty-Four সোভিয়েত ইউনিয়নে; ফরাসি বিপ্লবকে সমর্থন করার অভিযোগ এনে থমাস পেইনের Rights of Man গ্রন্থটি যুক্তরাজ্যে এবং জারের রাশিয়াতে এবং নোয়াম চমস্কির রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ Year 501: The Conquest Continues দক্ষিণ কোরিয়াতে নিষিদ্ধ হয়েছিল। ভারতে বুদ্ধদেব বসুর রাত ভ'রে বৃষ্টি, সমরেশ বসুর প্রজাপতি, বাংলাদেশে হুমায়ুন আজাদের নারী, তসলিমা নাসরিনের লজ্জা, আবদুল মান্নান সৈয়দের সত্যের মত বদমাশ ইত্যাদি গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তীতে যা বহুল পঠিত ও গৃহীত হয়। এই তালিকা আরো দীর্ঘ করা যাবে, আর তাতে লেখনীর কলেবরই কেবল বাড়বে। কিন্তু পঠন-পাঠনের প্রসঙ্গে আমাদের অবস্থান খুব সুস্পষ্ট। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ সমর্থনযোগ্য নয়। এটা মানুষের মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ। তাছাড়া কোনো গ্রন্থকে নিষিদ্ধ করলে তা বাড়তি আকর্ষণ লাভ করে, যা অনেক নিম্নমানের বইয়েরও কাটতি বাড়িয়ে দেয়। আর বই পোড়ালে কী হয়? র্যা লফ ওয়াল্ডো ইমারসনের ভাষায়, Every burned book enlightens the world

সূত্র: কালের কন্ঠ