‘ঐশীরা’ আইনে কতটা নিরাপদ

মুজতবা হাকিম প্লেটো
Published : 22 August 2013, 11:40 AM
Updated : 22 August 2013, 11:40 AM

পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রীর খুনের ঘটনায় তাদের শিশুকন্যা ঐশীকে নিয়ে দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। শুরু থেকেই পুলিশ জানিয়েছে, ঐশী পিতামাতাকে খুনের দায় স্বীকার করেছে। কাকতালীয়ভাবে এর মধ্যেই কার্যকর হল 'শিশু আইন ২০১৩'। স্কুলের কাগজপত্রে ঐশীর বয়স আঠারোর কম বলে এ ঘটনায় পুলিশ থেকে শুরু করে সাংবাদিক পর্যন্ত সবাই সীমালঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ উঠছে।

মনে আছে প্রায় একইভাবে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তাদের শিশুপুত্রের বক্তব্য প্রচারের বিভিন্ন ঘটনায় সংবাদে শিশুর উপস্থাপন নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। অনেকের ধারণা, এসব ঘটনায় প্রমাণ হয় সংবাদে শিশুর প্রতি আচরণ সাংবাদিকের ব্যক্তিগত দৃষ্টি-নির্ভরশীল। আদতে আইন কী বলে? আর তা শিশুকে কতটুকুই-বা সুরক্ষা দেয়?

গত জুনে পাশ হওয়া 'শিশু আইন-২০১৩' গত ২১ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে। এর আগে চালু ছিল 'শিশু আইন-১৯৭৪'। জাতিসংঘের 'শিশু অধিকার সনদে' বাংলাদেশ সম্মতি দেওয়ায় শিশুর স্বার্থরক্ষায় নতুন আইন প্রণয়ন করা হল। এতে পুলিশি আচরণ থেকে শুরু করে সংবাদ পরিবেশন সব বিষয়ে দিকনির্দেশনা রয়েছে।

নিহত পুলিশ কর্মকর্তার মেয়েকে পিতামাতার খুনের দায়ে আটকের পর দেশজুড়ে বিতর্ক তৈরি হয়। তাই ২১ আগস্ট, ২০১৩ মেয়েটির বয়স যাচাইয়ের জন্য পুলিশ তাকে ডাক্তারের কাছে পাঠায়। কিন্তু 'শিশু আইন ২০১৩' তে এ সম্পর্কে কী বলা হয়েছে?

আইনের ২০ ধারায় লেখা আছে- 'আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন, আদালতের রায় বা আদেশে ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দ্যেপূরণকল্পে, অপরাধ সংঘটনের তারিখই হইবে শিশুর বয়স নির্ধারণের জন্য প্রাসঙ্গিক তারিখ।'

৪৪ (৪) ধারায় আছে 'বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তা জন্মনিবন্ধন সনদ অথবা উক্ত সনদের অবর্তমানে স্কুল সার্টিফেকেট বা স্কুলে ভর্তির সময় প্রদত্ত তারিখসহ প্রাসঙ্গিক দলিলাদি উদঘাটনপূর্বক যাচাই-বাছাই করিয়া তাহার বয়স লিপিবদ্ধ করিবেন।'

ধৃত মেয়েটি 'ও লেভেল পরীক্ষা' দিয়েছে। তার এসব নথিসহ পাসপোর্টও রয়েছে। অথচ আমরা দেখলাম, এত স্পষ্ট করে নির্দেশনা থাকার পরও শিশু আইন কার্যকরের দিনই পুলিশ মেয়েটির বয়স যাচাইয়ের জন্য তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে!

এই আইনে শিশুর স্বার্থরক্ষায় নতুন অনেক কিছুই যুক্ত হয়েছে। এখন থেকে ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সবাই শিশু। আবার বিচার যখনই হোক না কেন, ঘটনা ঘটার দিনে কেউ ১৮ বছরের নিচে বয়সী হলেই সে 'শিশু' বলে গণ্য হবে। বয়স নির্ধারণ বিষয়টি শিশুর অধিকার রক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ দেখা যাচ্ছে এসব তোয়াক্কা না করে এসবি কর্মকর্তা মাহুফুজুর ও তার স্ত্রী হত্যা মামলায় তাদের মেয়ের বয়স ১৮ বছর দেখিয়ে তাকে রিমান্ডে নেওয়া হল। এতে সে শিশু হিসেবে প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বাবা-মাকে হত্যায় মেয়েটি জড়িত এ সন্দেহ তীব্র হওয়ায় তার প্রতি কোনো দয়া-মায়া দেখাচ্ছেন না অনেকেই। এমনকি দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তাও 'ইবলিশের পর তার স্থান' এমন মন্তব্য করেছেন! পুলিশ থেকে গণমাধ্যম প্রাথমিক তদন্ত শুরুর আগেই তাকে যেন 'হত্যাকারী' হিসেবে রায় দিয়ে দিয়েছে!

এভাবে চেনা-অচেনা গণমাধ্যমে কত শত সংবাদই না বেরুচ্ছে। মেয়েটির কোন বন্ধু ইয়ারা সরবরাহ করত, কে যৌনাচারে ইন্ধন দিত, সে কত হাতখরচ পেত, নাম-ঠিকানহীন তার চিঠিও ছাপা হয়ে গেল! কেউই অনুধাবন করছেন না, শুধু ঘটনার শিকার শিশু নয়, ঘটনার সংঘটক শিশুরও সুরক্ষার কথা আইন বলছে।

বাবা-মার সঙ্গে সন্তানের বিশেষ করে এই বয়সের শিশুদের দ্বন্দ্ব নতুন নয়। বাবা-মার উপর রাগ করে হরহামেশা সন্তানরা জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। আত্মহত্যার কতশত সংবাদ প্রতিনিয়ত ছাপাও হয়। কখনও কখনও অভিভাবকের উপর হামলার খবরও বের হয়। এমনকি অভিভাবককে হত্যার ঘটনাও নজিরবিহীন নয়। কিন্তু পুলিশ দম্পতির হত্যাকাণ্ডটি পুলিশ ও সংবাদকর্মীরা যেভাবে মোকাবেলা করছেন সেটা এ ঘটনায় ঝড় ওঠার পরিস্থিতি তৈরিতে জোরালো ভূমিকা রাখে।

নতুন শিশু আইনে 'শিশু আদালতের কার্যক্রমের গোপনীয়তা' অধ্যায়ের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, শিশু আদালতে বিচারাধীন কোনো মামলায় জড়িত বা সাক্ষী শিশুটির ছবি, নাম বা এমন কোনো বর্ণনা, সংবাদ বা প্রতিবেদন প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক বা ইন্টারনেটে প্রকাশ করা যাবে না; যাতে শিশুটিকে শণাক্ত করা যায়। আদালত অনুমতি দিলেই তবে ছাপা যাবে। আদালত এমন অনুমতি দেওয়ার আগে এসব প্রকাশে শিশুর কোনো ক্ষতি হবে কিনা তা খতিয়ে দেখবে। লক্ষণীয়, পুলিশকন্যাকে গ্রেপ্তার বললেও মেয়েটিকে শণাক্ত করা যায়। ফলে এ বিষয়ে গণমাধ্যম কী করবে তা গভীর ভাবনার বিষয়।

আইনের নবম অধ্যায়ের ৮১ ধারায় কোনো গোপন তথ্য সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করলে কী ধরনের সাজা হবে তা লেখা রয়েছে। শিশুর স্বার্থবিরোধী প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির এক বছর পর্যন্ত জেলের ভাত খাওয়ার বন্দোবস্ত রয়েছে। এতে ৫০ হাজার টাকাও গুণতে হতে পারে। শুধু কি তাই, কোনো কোম্পানি, সমিতি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এ অপরাধে জড়িত থাকলে তার নিবন্ধন দুই বছরের জন্য স্থগিত করাসহ দুই লাখ টাকা জরিমানার ব্যবস্থা আছে।

তবে সাজা পাওয়ার ভয়ে এখনই শিউরে ওঠার কারণ আছে কিনা সন্দেহ। কারণ অপরাধটির ২৮ ধারায় 'শিশু আদালতে বিচারধীন মামলায়' এবং দণ্ডের ধারায় 'এই আইনের বিচারাধীন কোনো মামলা বা বিচার কার্যক্রম' কথাটি লেখা রয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাহফুজুর হত্যাকাণ্ডের মামলাটি সাধারণ আদালতেই এখনও চলছে। তাই ২১ আগস্টেও কেউ তার মেয়ের ছবি ছাপলে দণ্ড পাবেন কিনা তা আদালত বলতে পারে।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মতো কোনো ঘটনায় মামলা স্বাভাবিক কারণেই শিশু আদালতে হবে না। কিন্তু এসব ঘটনায় তাদের শিশুপুত্রের মতো অনেক শিশুর বক্তব্য বিচারের কাজে প্রয়োজন হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে ওই শিশুর নাম, ছবি বা বর্ণনা প্রকাশে এ আইনের গোপনীয়তার বিধানের কী হবে? তবে কী সদ্য চালু এই আইন সব শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে না?

পুরোনো আইনেও কিন্তু এ নিয়ে বিধিনিষেধ ছিল। ১৯৭৪ সালের শিশু আইনে যে কোনো আদালতেই করা মামলায় জড়িত শিশুর পরিচয় প্রকাশ পায় এমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করায় নিষেধ ছিল। ওতে সাজা ছিল দুই মাস পর্যন্ত কারাভোগ এবং দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা।

আইনে সাজার ব্যাপারটি থাকলেও টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে আমরা অহরহ দেখছি শিশু নিয়ে নানা প্রতিবেদন। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তাদের শিশুর পরিচয়টিই শুধু প্রকাশ পায়নি, তার অনুভূতিও জানতে চেয়েছেন কোনো কোনো সংবাদকর্মী! এসব ক্ষেত্রে আইন কেন তার লম্বা হাতখানা ব্যাঙের জিহ্বার মতো প্রসারিত করে খপ করে শিকার ধরেনি! তবে কি আইন শুধুই কাগুজে? বর্তমান আইনটিও কি রচনার কৃতিত্ব নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে? হয়তো-বা, হয়তো নয়।

আরও একটি সমস্যা হচ্ছে, শিশু কোনো অপরাধের শিকার হলে বা বাদী ও বিবাদী শিশু হলে তার বিচার শিশু আদালতে এবং শিশু আইনে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মাহফুজুর ও তার স্ত্রীর হত্যার মতো কোনো প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধের শিকার হলে মামলা স্বাভাবিকভাবেই প্রচলিত আদালতে হবে।

এ হত্যাকাণ্ডের মামলার এখনও কোনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। তবে অপরাধী শিশু বলেই সন্দেহ করছে পুলিশ। ফলে সংবাদ প্রকাশে বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে আইনে যেভাবে 'শিশু আদালত' বা 'শিশু আইন' নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাতে জটিলতা তৈরি হয় বৈকি।

শুধু তাই নয়, এ আইনে মামলা হওয়ার আগেই কোনো ঘটনায় শিশুর জড়িত থাকার খবর হতে পারে। কিশোরী ধর্ষণের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় অনেক গণমাধ্যমে মেয়েটির পরিচয়সহ নানা কিছু প্রকাশ করা হয়। এতে মেয়েটির আরেক দফা বলৎকার ঘটে বটে। এ ধরনের ঘটনা শিশুর জীবনের উপর প্রভাব ফেলে বলেই শিশুর পরিচয় গোপন রাখার ব্যাপারটি সামনে এসেছে।

আদালত যদি ব্যাখ্যা দেয়, ঘটনার সময় থেকেই শিশুর পরিচয় ও ছবি অপ্রকাশযোগ্য তাতেও সংকট আছে। রাস্তায় কোনো ভাঙচুর-বিক্ষোভের ছবি ছাপা হল, ওই ছবিতে ভাঙচুরকারীদের মধ্যে কোনো শিশুর ছবি থেকে গেলে আইন কীভাবে সেটাকে দেখবে? ১৭ বছর ১১ মাস ২৯ দিন বয়সী শিশুর সঙ্গে ১৮ উর্ধ্ব বয়সীদের পার্থক্য করা সবসময় সম্ভব কি?

তাই আইন যথাযথভাবে পালনে সংবাদকর্মীরা যেমন সংকটে পড়তে পারেন তেমনই আইনের ফাঁক গলে কেউ ছাড় পাবে কিনা প্রশ্ন থেকে যায়। এই আইনের উদ্দেশ্যর উপর দাঁড়িয়ে শুভবুদ্ধিসম্পন্নরা সাংবাদিকতার নৈতিকতা মান্য করবেন সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু মনে রাখা দরকার, সংবাদ শেষ পর্যন্ত পণ্যই; সাংবাদিক যার মজুর। মুনাফার জন্য সব মালিক বা রুটিরুজির খাতিরে সব মজুর নৈতিকতা মান্য করবে ভাবা দুষ্কর। আদতে সাধুকে নীতিবাক্য শোনানোর জন্য নয়, বরং দুষ্টকে দমনে আইন করা হয়। বাজারে কাটতি বাড়াতে কোনো গণমাধ্যম আইন-নৈতিকতার বালাই না করে ভেজাল সংবাদ প্রকাশ করলে আদালত কী ব্যবস্থা নেবে?

আমরা দেখছি, ঐশীকে নিয়ে অনিয়ন্ত্রিত এসব সংবাদের দর্শক ও পাঠক আছে। সংবাদ নিয়ে অবাধ অশুভ প্রতিযোগিতার মুখে নিয়ম মেনে সংবাদ করাও কঠিন বটে। তাই আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করার পাশাপাশি অতীতের মতো আইনের কাগুজে অবস্থান শিশু স্বার্থরক্ষায় কতটা কাজে দেবে তা দেখবার বিষয়।