মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রতি ভালোবাসা

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 26 Nov 2011, 03:02 AM
Updated : 19 Dec 2017, 02:37 PM

লাখো মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সমাহিত হয়েছেন চশমা হিলে পারিবারিক গোরস্থানে পিতার কবরের পাশে। রেলওয়েতে কাজ করতেন সেই পিতা। আমার পিতাও ছিলেন রেলে। রেল-পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সহমর্মিতা-সৌহার্দ্য কাজ করে। তাই হয়তো খুব আপন মনে হয়েছে মহিউদ্দিন ভাইকে।

তারও আগে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করব এমন বাসনা হয়েছে। সেটি খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চূড়ান্ত আন্দোলনের সময়। চট্টগ্রামের নির্বাচিত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামে অবরোধ-আন্দোলন শুরু করেছেন, খালেদা সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কিছুই যেতে পারবে না। তারপর ঢাকার নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ শুরু করলেন 'জনতার মঞ্চ'। আন্দোলন জয়ী হল। এরপর অনেক বছর পার হয়েছে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করা হয়ে ওঠেনি।

২০০৭ সালের সেনাচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আছে। ধরপাকড় চলছে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব বিজ্ঞান অনুষদের ডিন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি একাডেমিক কাজে। শোনা গেল মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়ে যাবেন যে কোনো সময়। প্রাণ রসায়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. আলাউদ্দিনকে (মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য) বললাম, 'মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে চাই'। তিনি জানালেন, তাঁর চশমা হিলের বাসা এখন জনশূন্য। গ্রেপ্তারের ভয়ে ও মুখো কেউ হন না। আমার বিশেষ অনুরোধে তিনি আমাকে নিয়ে যেতে রাজি হলেন।

চশমা হিলের বাসায় ভেতরের ঘর, যেখানে অসুস্থ মহিউদ্দিন ভাই শুয়ে ছিলেন, সেখানে আমাদের নেওয়া হল। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আলোচনা হল তাঁর সঙ্গে। জেনারেল মইন ও তার দুই মহাশক্তিধর ব্রিগেডিয়ার আমিন ও বারীকে নিয়েও কথা হল। বললেন, "পেট ভর্তির আগে ক্ষমতা ছাড়ার জন্য এরা আসে নাই। এদের হটানো কঠিন কাজ হবে।"

তবে শেখ হাসিনার সাহস ও দৃঢ়তার উপর তাঁর আস্থার কথাও বললেন তিনি।

এর অল্প দিন পরেই মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়ে যান। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা গ্রেপ্তার এড়াতে সংস্কারপন্থী হয়েছেন, সেনা-জেনারেলদের 'মাইনাস টু ফর্মুলার' অংশ হয়েছেন তারা। ২০০৭ সালের ১৫ জুলাই বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে সরকারের পেছনের সামরিক জান্তা। গভীর অমানিশা নেমে এসেছে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে আমারা প্রতিবাদ করেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাসদস্যদের সঙ্গে ছাত্রদের ব্যাপক সংঘর্ষের পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্টের রাতে গ্রেপ্তার হই আমি। ১২ দিনের রিমান্ড-শেষে ঢাকা কারাগারে আমাকে পাঠানো হয়েছে। সহবন্দি ছিলেন ড. হারুন অর রশিদ। কয়েক দিন পর একজন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি টিফিন ক্যারিয়ারে করে দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছে। সে জানাল, ২৬ সেল থেকে মহিউদ্দিন চৌধুরী সেটি পাঠিয়েছেন। জানলাম, সেখানে শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দিদের চৌকার (চুলা) দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম এই কথা বলে যে, আমাদের খাবারের বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার। দেখা হতেই আমাকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সংগ্রামী ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন।

কারাগারে তখন অনেক রাজনৈতিক বন্দী। কিন্তু আমার মনে হল, যথার্থ অর্থে এই কারাগারে একজনই রাজনৈতিক নেতা আছেন, যিনি প্রতিনিয়ত নেতা-কর্মীদের খোঁজ-খবর নেন, নানাভাবে সাহায্য করেন।

মহিউদ্দিন চৌধুরী জনপ্রিয় নেতা। তাঁকে হাত করতে নানা তৎপরতা চালায় সেনাচালিত সরকার। এর মধ্যে খবর আসে, তাঁর ক্যান্সারআক্রান্ত মেয়ে টুম্পা ব্যাংককের হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়। একটি স্টেটমেন্টে সই করলে মেয়েকে দেখতে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হবে তাঁকে। দেশের দুঃসময়ে এমনভাবে বিদেশে গেলে বন্দি শেখ হাসিনার অবস্থান দুর্বল হবে ভেবে পিতা মহিউদ্দিন সেই স্টেটমেন্টে সই করলেন না। মৃত্যুপথযাত্রী কন্যাকে দেখতে বিদেশেও গেলেন না।

বেশ পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন ব্যাংকক পৌঁছান, ততদিনে তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পা বেঁচে নেই।

কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে চট্টগ্রামে গিয়েছি কয়েকবার। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগে চশমা হিলের বাড়িতে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বেশ রাত হয়েছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জন্য নির্বাচনী প্রচারশেষে তিনি বাড়ি ফিরেছেন। শরীর খুবই অসুস্থ। দুই পা ফুলে আছে। এই অবস্থায় কেন প্রচারে নেমেছেন জানতে চাইলাম সেটা। কষ্টের মধ্যেও মৃদু হাসি মহিউদ্দিন ভাইয়ের মুখে। 'শেখ হাসিনাকে জেতাতে হবে', বললেন নেতা।

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা। স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, জাতির জনকের ইতিহাস, জয় বাংলার ইতিহাস জানাতে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে এই আয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের সেনানী মহিউদ্দিন চৌধুরী নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাতে। প্রতি বছর ফোন আসে। ওপাশ থেকে কেউ বলেন, "কথা বলেন"।

"প্রফেসর সাহেব, বিজয় মেলার তারিখটা দেন, আসতে হবে", বলেন মহিউদ্দিন ভাই।

সে আমন্ত্রণ শিরোধার্য করে ছুটে গেছি চট্টগ্রামের বিজয় মেলায়। সভাপতিত্ব করছেন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী। তেমন এক মেলায় গিয়েছি। সামনে মেয়র নির্বাচন। এর আগের নির্বাচনে মহিউদ্দিন ভাই হেরে গেছেন। খুব চাচ্ছিলাম মনোনয়ন যেন পান তিনি। যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন অন্য কেউ মেয়র হবেন, মন থেকে তাতে সায় পাইনি। বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়েছি। কেন জানি না, মনের কথাগুলোই বেরিয়ে এল, "অন্য কেউ নন, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী হবেন চট্টগ্রামের মেয়র প্রার্থী।"

আমার এ ঘোষণায় হর্ষধ্বনি উঠল শ্রোত্রীমণ্ডলীর পক্ষ থেকে। মহিউদ্দিন চৌধুরী মনোনয়ন পাননি। কষ্ট পেয়েছি।

মহিউদ্দিন ভাই গুরুতর অসুস্থ। স্কয়ার হাসপাতালে সিসিউতে আছেন, শিগগির তাঁকে নেওয়া হবে বিদেশে। মন বিষণ্ণ হয়েছে। মনে হল তাঁকে হারাতে যাচ্ছি। কিন্তু অনেকটা ভালো হয়েই তিনি দেশে ফিরলেন। স্কয়ার হাসপাতালের কেবিনে আছেন। এক বিকেলে তাঁকে দেখতে গেলাম। বিছানায় শুয়ে আছেন। দুই কন্যা ও ভাবি আছেন সেখানে।

আমাকে চিনতে পারলেন। কপালে হাত রাখলাম। চাদর সরে গিয়ে হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত উন্মুক্ত। খুবই শীর্ণ। মনে পড়ল, চশমা হিলের বাড়িতে ফুলে যাওয়া পায়ের কথা। এবারে এই পা নিয়ে কি মহিউদ্দিন ভাই আবার উঠে দাঁড়াবেন, হাঁক দেবেন চাটিগা ভাষায়?

তাঁর দুপায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। "আমার দুই যমজ মেয়ে, স্যারকে সালাম দাও", বললেন মহিউদ্দিন ভাই।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে যাওয়ার সময় তাঁর ছেলে ব্যারিস্টার নওফেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সে কথা জানালাম তাঁকে। তাঁকে যে আমার খুব পছন্দ হয়েছে তা-ও বলেছি। খুবই মৃদু হাসির রেখা কি খেলে গেল মহিউদ্দিন ভাইয়ের মুখে? "লেফটিস্ট, লেফটিস্ট" প্রিয় ছেলে নওফেলের প্রসঙ্গে বললেন মহিউদ্দিন ভাই।

বললাম, "এবার বিজয় মেলার কোনো আমন্ত্রণ পাইনি। আপনি সুস্থ হয়ে ওঠেন, আগামী বিজয় মেলায় যাব চট্টগ্রামে।"

তিনি চোখ বুজলেন। আরও খানিকক্ষণ ছিলাম। আমার হাতের ফোন বেজে উঠল। দ্রুত তা বন্ধ করেছি। মহিউদ্দিন ভাই চোখ মেলে হাত বাড়ালেন। বললেন, "আবার দেখা হবে।"

সে দেখা আর হয়নি। না-ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি। কুলি, মজুর, মেথর, রাস্তার মানুষ, শিক্ষিত, শিক্ষাবঞ্চিত, ধনী, নির্ধন– সবার নেতা ছিলেন মহিউদ্দিন ভাই। চশমা হিলের কবরে তিনি আছেন, বিপন্ন মানুষের স্রোত সে দিকেই প্রবাহিত। কজন রাজনৈতিক নেতার ভাগ্যে মানুষের এমন ভালোবাসা মেলে?

তাঁর জন্য ভালোবাসা।