শিমুল সালাহ্উদ্দিনের গুচ্ছ কবিতা

শিমুল সালাহ্উদ্দিনশিমুল সালাহ্উদ্দিন
Published : 21 April 2014, 05:36 PM
Updated : 21 April 2014, 05:36 PM

ছন্দ-সুর

বৈশাখের রোদ উপেক্ষা করে জল-কাদাময় ক্ষেতে, ধানের গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঝুঁকে উল্টো হয়ে পড়ে থাকা শামুকদের কুড়িয়ে ডুলায় তুলছিলাম আর ডুলাটা ভরে গিয়েছিল জড়াজড়ি করা শামুকদের স্তূপে

শামুকেরা ডুলাটার ভেতর তাদের আস্ত-শরীরটাই গুঁটিয়ে নিয়েছিলো, এক টিপুনিতেই ভেতর থেকে বের করে আনছিলাম সব মাঁস আর মজ্জ্বা, উঠোনের পাশে পালিত হাঁসগুলোর খাবার তৈরির জায়গায়, আর খোঁয়াড়ের ভেতর হাঁসগুলো তখন জুলজুল লোলপড়া লোভাতুর চোখে তাকাচ্ছিল। হাঁসগুলো কেমন তাকিয়েছিলো!

শামুকের খোলাগুলো ভেঙে যাচ্ছিল মড়মড় করে আর তার মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত ছন্দ ছিলো, যেনো এর মধ্যে লুকিয়ে আছে মরা শামুকগুলোর শোক-তাপ-বিলাপ, জীবনের স্মৃতিকাতরতা

আজ, এতোদিন পর, সেই ছন্দটির উৎস হাতড়ে-হাতড়ে আমি হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াই জল-কাদাময় জলার পাড়ে-পাড়ে, বেয়ে-বেয়ে উঠি জলে-ডাঙ্গায়, শোঁ-শোঁ শব্দের সঙ্গতে কাদের ত্রস্তপায়ে এগিয়ে আসবার আওয়াজ, আমি তাদের কবলে পড়ে যাই, বারে বারে ভেসে-ভেসে উঠি জলা-পাহাড়চূড়ার উচ্চতায়, ডুবে-ডুবে যাই বসতিভাসানো জলে

আশ্চর্যভাবে কোন্-এক অদৃশ্য হাত আমার শরীরটা তুলে নেয়, এক টিপুনিতেই নিংড়ে বার করে নেয় আমার নিজের ভেতরটাকে। বুক ভেঙে যাবার যন্ত্রণাতেই মড়মড় ক'রে ভেঙে যায় আমার শরীরের খোলা, তৈরি হয়ে যায় আরো-এক নতুন বিলাপগাঁথার ছন্দ-সুর।

আর অদৃশ্য হাতের শরীরে থাকা চোখদুটো, কেমন তাকিয়ে থাকে!

কালস্নান

অস্থিরতা
অস্থিকথা
কুড়িয়েছি চিতাভষ্ম থেকে সারারাত্রি ঘুরে
নাভি ও অঙ্গারগুলি হাই তোলে ধোঁয়াটে ঢেঁকুড়ে
ঢুকে গেছে আমার ফুসফুসে
যার ডাক শুনে কাঁদি আমাকে সে
শূন্যের মোচড়ে ব্যোম-ভাঁজে-ভাঁজে দিলো ছুড়ে
পুতলো লুব্ধক চাঁদিতে আমার গোল ছিদ্র করে
ঘামরজঃরক্ত শুষে
নীল কালো রাত্রি চুষে।

সাকিনগোত্রহীন রাত্রির চণ্ডাল রাষ্ট্রময় মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়েছি
মরা মানুষের নক্ষত্রের দেশে রক্ত মাখা ভাত খেয়ে বেঁচে আছি

এই মরা শহরেও গজায় নতুন পাতা, ফুল ফোটে, প্রজাপতি ওড়ে,
খুব খুব আকাশ উঁচুতে দু-একটা মিষ্টি ফল সোনালিরোদে ওঠে ভরে।


উদ্ধত সৈয়দের জন্য শোকগাঁথা

ভেসেছে উদ্ধত প্রেরণার গান কালস্রোতে
কি দারুন নিদারুন হেসে অন্ধ কবিতারগোছা
নিরবতা গভীরতা হয়ে শুয়ে আছে আজ

উত্তর-দক্ষিণে পাথর নিথর শুইয়ে দেবার আগে
পালাতে পালাতে আমলা-কেরানি-ঊনসাহিত্যিক ভিড়ে
মনে মনে শুধু তোমাকে প্রণাম জানাই মান্নান ভাই

শবযাত্রায় আমাদের মাথার ওপরে ঠাঁই নিয়ে
আকাশের সাথে প্রগত-সমান্তরাল শুয়ে
বস্তুর বিরুদ্ধে দিলে অফুরান উড়িয়ে প্রজাপতি
আরও কত ভালোবাসা বাকি ছিলো হায় জানে কি যযাতি
জীবনের গূঢ় রহস্যের এই যেনো প্রথম আশ্চর্য প্রকাশ

কবি, শবযাত্রায় হাঁটতে হাঁটতে
আমার কেবল মনে পড়ছে, ঠা ঠা হেসে দিয়ে
বললেন আপনি, কোন বিচ্ছেদই বিচ্ছেদ নয় শিমুল…


ঘুমপ্রহরের গান

সানজিদা ইসলাম পদ্মা
আমাকে নিকটে নিয়ে,ঘুম যার চলে গেছে দূরে…

কি ভীষণ সেই সচেতন লাফিয়ে পড়া,সেই মুহূর্তের মধ্যে গভীর সমুদ্রের অচেতন মাছ হয়ে যাওয়া— উজ্জ্বল রশ্মিরাশির পেছনে ফেলে যাবতীয় কোলাহল,হলাহল, জাগরণ— দারুণ দুহাত বিস্মৃত করে পতনের লোভে দেখো পেছনে ঠেলে ফেলছো উজ্জ্বল নীল বাস্তব ও শূন্যতা,নীচেও থাকে আরো নীল,জলের তরল হাতে নিজেকে এরপর সঁপে দাও তুমি,তবু চেতনে তোমার কেন ওগো অধরা ঘুম?

জলের তরল হাতে সমর্পণ করো তুমি পেলবতাবহ মাছের শরীর,সাঁতার কাটতে থাকো দৃঢ় দুই পায়ে…গড়ে তোলো সারাদিন থরে থরে জলের সঙ্গত; সংলাপ।
এভাবেই চুমুর ছদ্মবেশে সাজিয়ে আরকঘুম ঢেলে দেবে জল চোখেতে তোমার, ঠোঁটের চামচে— কবিতার পদশব্দ,শব্দের উজ্জ্বল প্রসাধন,ছন্দের স্পন্দন থেকে অবিরাম আমার আবিল রক্ত ক্রমাগত শুদ্ধ করে নেয়া ছাড়া আর কোন ব্রত নেই সোনা,কেন আমি নিকটে এসেছি বলে ঘুম উধাও তোমার? দস্যুতা কি প্রেমিকের আলখাল্লা হবে না কখনো?

জানো,রাত্রী গভীর হলে কেউ কেউ মাছ হয়ে যায়,কেউ পাখি,কেউ নদী,কেউ কেউ ফুল,আর তোমার সাথে দেখা হবার পর মানুষেরা কবি হয়,কবির সমস্ত ঘুম কোলে নিয়ে ঘুমায় প্রেমিক হৃদয়।
অয়ি নিশীথিনী,তোমার স্তুতি ও স্তবে আমার উষর ঠোঁট গ্রীষ্মশেষের শিমুলের মতো ফেটে পড়তে চায়।আহ !আমি যদি এই মধ্যরাতের ঘুমহীনতার মঞ্চ থেকে ঝাপিয়ে পড়তে পারতাম অবনীল সমুদ্রে, যা তুমি চাও… কথা নেই কোন আর, ঘুমাও…ঘুমাও…

বর্ষণ

বিভাবিদ্যুতে ফেটে ফেটে যাওয়া আকাশ
নেমে এলো প্রবলতোড়ে বর্শাবল্লমফলা

ফোঁটা ফোঁটা—

ছিটকে
মাটিতে পড়েই টেনে আনলো পাতাল থেকে
সোঁদাঘ্রাণ, ওমজড়ানো বীজ ও মুমূর্ষুশ্বাস গন্ধপুরাণ
বাতাসে বাতাসে—

পাতাদের দেশে দেশে নিরুপায় জলকেলি স্নান-উৎসব

খঞ্জরের মতো যদি এভাবেই ভেঙে পড়তে প্রকৃত বুকে!
এভাবেই ভেঙে ভেঙে পড়তে আর গলে যেতে
সোঁদাকাদাগন্ধমাখাকামজলে—

নিফাটা আকাশ তবে মুহুর্মুহু বিজলীঠমকেও,খুঁজে পেত ঠিকই
নেশালু গমক— চুষবার মতো কোনো সুডৌল বর্তুলবোঁটা…

তুমি আর ভিজতে ভয় পেতে না!

অকালসন্ধ্যা


তোমার কন্যা,স্বপ্ন কমলিনী,যখন তোমার এখনকার বয়সী হবে,কোন এক বিষণ্ন সন্ধ্যায়,গোধূলীর দিকে চেয়ে তোমাকে শুধাবে,বাবা তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে এটা তুমি কখন বুঝলে মমি!

তুমি অতৃপ্ত এক শ্রী-দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলবে,ওকে কবর দিয়ে ফেরার পথে। খুব শীত লাগছিলো।তখন।

সকল সন্ধ্যাই অকালে নেমে আসে
দিনেই জ্বালাতে হয় পিদিমের
নিভু নিভু আলো
খুলে দেয় আলো
কাহিনীঠোঙার দড়িবাঁধা মুখ
জানালায় জানালায় ছড়িয়ে পড়ে পালা,
দহলিজে, সেলফোন ও ড্রয়িঙ-স্পেসে…

মানুষের বদলে শুনতে আসে কেবল
রাজ্যের শালিখ,চড়ুই আর কাক…

আহা সে পালা! হাসে
নটীরূপী আমার রঙে ঢঙে হেসে কুটি কুটি
প্রিয় পাখিগুলি, ডানা ঝাপটিয়ে
সন্ধ্যা নামিয়ে আনে
কিচিরমিচিরে ক্রমাগত

মানুষের মগজহীন আমার ছায়ার
উঠোনে পড়ছে রোদ…

হুল্লোর।