চট্টগ্রামে যৌতুক সংস্কৃতি: আমি লজ্জিত কিন্তু আপনারা!!

মো ফয়সাল আহম্মদ
Published : 11 Nov 2012, 09:11 AM
Updated : 11 Nov 2012, 09:11 AM

করির সুবাদে গত ২০০৪ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমি চট্টগ্রামে ছিলাম। ২০১১ সালের শেষ দিকে আবার চট্টগ্রামে আসি সেই একই চাকরির সুবাদে। আসলে চট্টগ্রামের সাথে আমার একটা নাড়ির টান রয়েছে। কারণ এখানেই আমার দুই চাচা গত হয়েছেন এবং এক চাচার কবর রয়েছে এই চট্টগ্রামের মাটিতেই। চট্টগ্রামের মানুষের আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার, ভৌগোলিক অবস্থান আমাকে মুগ্ধ করে। এখানে আমার সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, ক্লাইন্ট সবার সাথে রয়েছে মধুর সম্পর্ক। এতো ভালো কিছুর মাঝেও চট্টগ্রামের একটি প্রথা আমাকে একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে খুব পীড়া দেয়। তা হলো যৌতুক প্রথা। আর এই প্রথার বাহিরে চট্টগ্রামের ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র কেউ নেই। আর আমার মনে হয় এ বিষয়টি বাংলাদেশের সব মানুষই জানে। কারণ গত কিছু দিন পূর্বে আমি একবার ছুটি নিয়ে ঢাকাতে যাই।

সেখানে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধুর সাথে দেখা। অনেক দিন পর দেখা, তাই কুশলাদি বিনিময় করার পর বন্ধুটি জানতে চাইলো এখন কোথায় তোর পোস্টিং। বললাম, চট্টগ্রাম। ও বলল, দোস্ত খুব ভালো জায়গায় আছিস, এবার চট্টগ্রামে একটি বিয়ে করে ফেল। জানতে চাইলাম কেন? ও জানালো, ওখানে বিয়ে করলে শ্বশুর বাড়ি থেকে সব (যৌতুক) দিয়ে দিবে। আমি ওর কাছে জানতে চাইলাম তুই কিভাবে জানলি। জানালো ওর এক বন্ধু নাকি চট্টগ্রামে বিয়ে করেছে, তাকে শ্বশুর বাড়ি থেকে ঘরের ফার্নিচার থেকে শুরু করে যা যা দরকার সব দিয়ে দিয়েছে। আমি ওকে শুধু বললাম, তার মানে তোর বন্ধু যৌতুক নিয়েছে। ও বলে, এটা যৌতুক হতে যাবে কেন? শ্বশুর ওকে স্বেচ্ছায় সব কিছু দিয়েছে। বন্ধুটিকে শুধু বললাম, স্বেচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক সবই যৌতুক। যাই হোক বন্ধুর সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে চলে এলাম এবং মনে মনে বললাম, চট্টগ্রামের এ যৌতুক ট্রেডিশন এখন সারা বাংলার মানুষ জানে!! নিজে একজন ভইঙ্গা হয়েও চট্টগ্রামে বাস করার সুবাদে কিছুটা হলেও লজ্জা পেয়েছি, কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষ কি পেয়েছে? মনে হয় না।

গত জানুয়ারিতে নগরীর নয়াবাজারস্থ একটি বাসায় ছিলাম। পাশের বাসায় ছিলো বৃদ্ধ এক মহিলা। যাকে আমি খালা হিসেবে ডাকতাম এবং যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ ছিলো এবং আছে তার প্রতি। তার দুই মেয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করে। বড় মেয়ে ডিভোর্সী এবং ছোট মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। প্রতি মাসে খালাকে দেখতাম নতুন নতুন হাড়ি, পাতিল, থালা/বাসন কিনতে। একমাসে আমার কাছে এসে বললো, তুমি কিছু টাকা আমাকে ধার দিবা, বললাম কতো, বললো তিন হাজার টাকা। ঠিক আছে দিবো, বলে জানতে চাইলাম টাকা দিয়ে কি করবেন। বললো, ছোট মেয়ের বিয়েতে একটি টেলিভিশন দিতে হবে ওটা কিনবো। আমি খালাকে জিজ্ঞাস করলাম, খালা আপনি মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দিবেন? খালা উত্তরে বললেন, বাবা, আমি আর ভুল করতে চাই না। আমার প্রথম মেয়ের বিয়েতে ছেলেকে কিছু দিতে পারিনি বলে বিয়ের পাঁচ বছর পরে সংসার ভেঙে গেছে। এবার আমি ছোট মেয়ের জামাইকে বিয়ের সময়ই সব কিছু দিয়ে দিবো। খালাকে বললাম আমি আপনার হবু মেয়ের জামাইর সাথে এ বিষয়ে একটু কথা বলি। খালা বললো, না বাবা তোমার কিছু বলার দরকার নেই, এতে বিয়েটা ভেঙে যেতে পারে। আমি যা পারি তাই জামাইকে দিবো। আমার কোন কষ্ট নেই, কারণ এটা চট্টগ্রামের একটা নিয়ম। আমি খালাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, যৌতুক দেয়া নেয়া উভয়ই অপরাধ।

এবার খালা আমার উপর রাগ করলো এবং আমাকে হাতে ধরে আবারও অনুরোধ করলো, আমি তার হবু মেয়ের জামাইকে যেন কিছু না বলি। হয়তো খালার কোন কষ্ট নেই, কারণ খালা চট্টগ্রামের মানুষ। কিন্তু আমিত খুব কষ্ট পেলাম এবং একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে নিজের অবস্থানে থেকে খালার কোন উপকার করতে পারলাম না তার অনুরোধে, শুধু পারলাম খালাকে যৌতুকের টেলিভিশনটি কিনতে কিছু টাকা ধার দিতে। আমি লজ্জিত!! কিন্তু আপনারা?? গত কিছু দিন আগে মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার অফিসটি কোর্ট বিল্ডিং-এ ছিলো। একদিন হঠাৎ ষাটোর্ধ্ব এক ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইতে অফিসে আসলো। আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম, মুরব্বী ভিক্ষা করেন কেন? আপনার কোন ছেলে মেয়ে নেই, যারা আপনাকে দেখবে? উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালেন, তার তিন মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, এক মেয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করে এবং একজন এখনও ছোট। মেজো মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। জামাইকে একটি টেলিভিশন ও খাট দিতে হবে। তাই ভিক্ষা করে টাকা জমিয়ে এসব কিনবো। মুরব্বীকে জিজ্ঞাস করলাম জামাইকে এসব না দিলে কি মেয়ের বিয়ে হবে না। উনি জানালেন, কি বলেন বাবা এগুলোতো আমাদের চট্টগ্রামের নিয়ম। এসব না দিলে কি মেয়ের বিয়ে হয়? যাই হোক মুরব্বীকে ১০ টি টাকা দিয়ে কিছু বলতে চাইলাম কিন্তু তিনি আমার আর কোন কথা না শুনে অফিস থেকে বের হয়ে গেলেন। হয়তো তার তাড়া আছে, আরও দশ জায়গায় যেতে হবে, তাড়াতাড়ি টাকা জোগাড় করতে হবে, কারণ সামনে যে তার মেয়ের বিয়ে। উনি যাওয়ার পর মনে মনে ভাবলাম সারা বাংলাদেশ যেখানে যৌতুককে ঘৃণা করতে শুরু করেছে, যৌতুকের বিরুদ্ধে সরকার আইন তৈরি করেছে সেখানে চট্টগ্রামের মানুষ এটাকে জিইয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। সত্যিই আমি খুব লজ্জিত!!

গত জুন মাসে আমার এক বন্ধুর ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াতে যাই নগরীর একটি দামী কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানে বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে এক সময় বলে ফেললো তার ভাইয়ের শ্বশুররা খুবই বড় লোক। তার ভাইকে টিভি, ফ্রিজ, সকল প্রকার আসবাবপত্রসহ যাবতীয় সব কিছু দিয়েছে। বন্ধুকে বললাম, তোমার ভাই এত কিছু কি যৌতুক হিসেবে নিয়েছে? উত্তরে সে বলল, যৌতুক নিতে যাবে কেন, এসব এমনিতেই দিয়েছে। তাকে আর কিছু বলতে পারলাম না। লজ্জায় মাথা নিচু করে খাওয়া দাওয়া শেষ করে চলে আসলাম। আমার অভিজ্ঞতা বলে এই ঘৃণিত প্রথা থেকে চট্টগ্রামের ধনী, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র কেহ বাদ নেই। সকলেই এটাকে তাদের সংস্কৃতি মনে করে। তাহলে কি এর থেকে বের হবার কোন উপায় নেই? অবশ্যই আছে। এজন্য প্রথমেই দরকার চট্টগ্রামের মানুষের মনের সংস্কার। যদি তারা মনে করে যে যৌতুক দেয়া এবং নেয়া উভয়ই অপরাধ, তাহলেই তারা এই কু-প্রথা/সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারবে। এজন্য মিডিয়া, সরকার, সুশীল সমাজ, এনজিও প্রতিনিধি সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। মিডিয়াগুলো চট্টগ্রামের এ কু-প্রথা নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারে।

সরকারিভাবেও চট্টগ্রামে যৌতুক প্রথা রোধে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে এবং আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও একটু সজাগ দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। আমাদের সুশীল সমাজের ভূমিকাও কম নয়। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার করে তুলতে পারে। এ কু-প্রথা রোধে এনজিওগুলো বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা যৌতুকের বিরুদ্ধে পোস্টার, লিফলেট বিতরণ, জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারে। আসলে এজন্য দরকার আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। মিডিয়া, সরকারি সংস্থা, সুশীল সমাজ, এনজিও প্রতিনিধি সবাই মিলে এর বিরূদ্ধে কাজ করলে খুব বেশি দিন এই ঘৃণিত ও লজ্জাকর প্রথা চলতে পারবে না। পরিশেষে বলবো, চট্টগ্রাম আমার প্রিয় জায়গা। এখানকার মানুষগুলো আমার খুব প্রিয়। আর আমার এ প্রিয় মানুষগুলো কোন কু-প্রথাকে বুকে লালন করে রাখুক তা চাই না, আমার প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে কেহ উপহাস করুক কিংবা লজ্জা দিক তা আমি চাই না। আমি চাই চট্টগ্রামের মানুষ সকল কু-প্রথা/সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবেন।

– মো. ফয়সাল আহম্মদ, জেলা সমন্বয়কারী, এসএএইচআর প্রকল্প, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, চট্টগ্রাম ইউনিট।