স্মৃতির চাঁদরে কমরেড নির্মল সেন

মো ফয়সাল আহম্মদ
Published : 13 Jan 2013, 04:17 AM
Updated : 13 Jan 2013, 04:17 AM

যার কলমে সমাজের নানা অসঙ্গতি উঠে এসেছিল, যিনি আমৃতু্য অন্যায়ের বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন সেই সাংবাদিক, কলামিষ্ট, লেখক ও রাজনীতিবিদ কমরেড নির্মল সেন-কে নিয়ে কিছু লেখার দুঃসাহস আমার কেন হয়ত অনেকেরই নেই৷ কারন তার সম্পর্কে অনেক কিছু লিখলেও তা অনেক কম হয়ে যাবে৷ তার মত সত্‍ ও আদর্শবান মানুষ আমাদের দেশে খুব একটা খুঁজে পাওয়া দায়৷ তিনি ছিলেন অনেকেরই প্রিয় মুখ, প্রিয় নির্মল দা৷ সদা হাস্য উজ্জল এ মানুষটি সব সময় দেশ ও জনগনের কল্যানের কথা ভাবতেন৷ তাইতো তিনি স্বাধীনতার পর গুপ্ত হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তত্‍কালীন দৈনিক বাংলায় স্বাভাবিক মৃতু্যর গ্যারান্টি চাই শিরোনামে কলাম লিখে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলেন৷ সেই জাতীয় বিবেক খ্যাত কমরেড নির্মল দা আজ আমাদের মাঝে নেই৷ গত ০৮/০১/২০১৩ ইং তারিখ সন্ধ্যায় রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে মৃতু্য বরন করেন৷ আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি৷

আমি স্বাভাবিক মৃতু্যর গ্যারান্টি চাই খ্যাত বিশিষ্ট কলামিষ্ট কমরেড নির্মল সেনকে আমি কাছ থেকে দেখেছি ১৯৯৭ সাল থেকে৷ আমার বন্ধু আবু সুফিয়ান ছিল তার দলের অঙ্গ সংগঠন সমাজবাদী ছাত্র জোটের কেন্দ্রীয় সভাপতি৷ তাই বন্ধুর কাছে তার কথা শুনে দাদার সাথে দেখা করার ইচ্ছা পোষন করি৷ একদিন বিকেলে বন্ধুকে নিয়ে তোপখানা রোডস্থ দাদার পার্টি অফিসে যাই এবং দাদার সাথে আমার পরিচয় হয়৷ সেই যে শুরু তার পর প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন হলেও দাদার সাথে আমি দেখা করতাম৷ যদিও চট্টগ্রামে আসার ফলে গত বেশ কিছু দিন যাবত্‍ তা সম্ভব হয়ে উঠেনি৷ তারপরও নিয়মিত খোঁজ খবর রাখতাম৷ দাদার মুখ থেকে বিভিন্ন সময় দেশ ও জনগণের কল্যানে এবং দেশের জন্য তার অবদানের বিভিন্ন কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম৷ আর মনে মনে ভাবতাম যদি দাদার মতো হতে পারতাম!!!!

দাদার কাছ থেকে শুনেছি তিনি দেশের বিভিন্ন বড় বড় আন্দোলনে কিভাবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে তার নাম ইতিহাসে স্থান পেয়েছে৷ এ সময় তিনি বাংলাদেশ থেকে তরুনদের সংগঠিত করে আগরতলা নিয়ে যেতেন এবং সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে সক্রিয় ভুমিকা পালন করতেন৷ বিভিন্ন সময় জেলও খেটেছেন দাদা৷ জেলখানাতে অনশন করে কয়েদিদের বিভিন্ন অধিকারও আদায় করেছেন একাধিকবার৷ তিনি স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে গনতন্ত্রের অগ্রযাত্রা শুরু করতে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও অগ্রভাগে থেকে সক্রিয় আন্দোলন ও সংগ্রাম করেছিলেন৷ দেশের যেকোন আন্দোলন, সংগ্রাম কিংবা অন্যায়-অবিচারের বিরূদ্ধে সর্বদাই জাতির বিবেক হিসেবে এই মহান নেতা সামনে থেকেই নেতর্ৃত্ব দিতেন৷ আবার কখনওবা কলম হাতে গর্জে উঠতেন নির্ভিক সৈনিকের মতো৷

আমার মনে হয় তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র রাজনীতিবিদ ছিলেন, যিনি তার দলের লোকদের রাজনীতির উপর শিক্ষা ও দীক্ষা দিতেন৷ তিনি সপ্তাহে একদিন কিভাবে রাজনীতি করতে হয়, রাজনীতিবিদদের আদর্শ কি হওয়া উচিত্‍, কিভাবে রাজনীতিবিদরা দেশের মানুষের কল্যানে কাজ করতে পারে ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিতেন৷ তিনি তার দলের কিংবা দলের বাইরের অনেককেই জাতীর বিবেক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টায় সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন৷ তার হাতে তৈরী করা অনেক ছাত্রই ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধীদল উভয় জায়গাতেই হয়েছে মন্ত্রী কিংবা এমপি৷ কিংবা অনেকে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে রাষ্ট্রীয় অথবা বেসরকারী অনেক বড় বড় পদে৷

দাদার অনেক লেখনিতে আমার তার পাশে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল৷ দাদা যখন লিখতেন তখন খুবই মনোযোগী থাকতেন৷ মনে হতো দাদা অন্য কোন জগতে চলে গেছেন৷ কিন্তু এর মাঝেও আমরা যারা পাশে বসে থাকতাম তাদের সাথেও হাসি মুখে দেশ ও দশের কথা বলতেন এবং জানতে চাইতেন আমাদের উপলব্ধি৷ দাদাকে আমরা মাঝে মাঝে জিজ্ঞাস করতাম আপনি যে এত অনাচার, অবিচার ও অন্যায়ের বিরূদ্ধে লেখেন, যার বেশীর ভাগই সরকার কিংবা প্রশাসনের বিরূদ্ধে যায় এতে আপনার ভয় করে না৷ উত্তরে তিনি বলতেন নির্মল সেন কারও ভয়ে ভীতু না, আর একজন প্রকৃত সাংবাদিক কিংবা লেখকের কলম কারও ভয়ে থিতু হয়ে থাকতে পারে না৷

এই মহান ব্যক্তিত্ব ২০০৩ সালে স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়৷ আমরা তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপতালে ভর্তি করাই এবং পরবতর্ীতে শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি না ঘটলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে৷ সেখানে চিকিত্‍সার পর কিছুটা সুস্থ হলেও শরীরের এক পাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত থেকে যায়৷ পরবতর্ীতে বাংলাদেশে সাভারের সিআরপিতে প্রায় ৮ মাস চিকিত্‍সা নেওয়া হয়৷ কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো দাদার এ চিকিত্‍সা সেবা পেতে আমাদের অনেকের কাছে হাত পাততে হয়েছে৷ বিভিন্ন যায়গায় আমরা দাদার চিকিত্‍সার খরচ মেটাতে টাকা তুলতে গিয়েছি৷ অনেক মহানুভব ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও তত্‍কালীন প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিরোধীদলীয় নের্তৃৃও কিছু কিছু সাহায্য সহযোগীতা করেছে৷ কিন্তু এ মহান ব্যক্তির সামগ্রিক চিকিত্‍সার খরচ রাষ্ট্রীয়ভাবে বহন করা হয়নি৷ এটা আমাদের জন্য যেমন তেমনি জাতীর জন্যও লজ্জাজনক৷ তাছাড়া ঐ সময় অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা দাদার চিকিত্‍সা সেবার সহযোগীতার কথা বললেও দিয়েছে নিতান্ত সামান্যই৷

এ অসুস্থ শরীর নিয়েও দাদা দীর্ঘদিন দেশ ও মানুষের কথা তার বিভিন্ন কলামে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন৷ যদিও সেটা বেঁচে থাকার জন্য কিছুটা আয় করার চেষ্টাও ছিল৷ কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে দাদা কলাম লেখার ভাষাও হারিয়ে ফেলেন এবং বন্ধ হয়ে যায় তার আয়ের উত্‍স৷ বাধ্য হয়ে সে চলে যায় তার টুঙ্গীপাড়াস্থ গ্রামের বাড়ীতে৷ কিন্তু দাদার অসুস্থের সময় অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা আশ্বাস দিয়েছিল যে, আমরা আপনার সার্বিক খরচ চালাব কিন্তু দাদার শারীরিক কারনে কলমের ভাষা হারিয়ে যাওয়ার মতো রাজনৈতিক নেতারাও একসময় হারিয়ে যায়৷ কেউ আর দাদার খবর রাখেনি৷

দাদার মহানুভবতা কিংবা দেশপ্রেমের উদাহরন দাদা নিজেই৷ তাকে অন্য কারও সাথে তুলনা করে ছোট করা ঠিক হবে না৷ তার আত্মীয়-স্বজনেরা তাকে বার বার ভারতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু পারেনি৷ তিনি তাদের বারবারই বলেছেন আমি আমার মাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না৷ এখানে মা বলতে তিনি দেশকে বুঝিয়েছেন৷ এ মহান মানব মৃতু্যর পরও তার লাশটি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দান করে গেছেন এ দেশের উদীয়মান ডাক্তাররা যাতে গবেষণা করে দেশে ও জনগনের কল্যানে কাজ করতে পারে৷

এ মহান ব্যক্তিত্বের জীবনের সর্বশেষ আশা ছিল টুঙ্গীপাড়াস্থ তার জমিতে একটি সরকারী মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা৷ এজন্য তিনি জমিও দান করে গেছেন৷ জানিনা তার এ আশা পূরন হবে কিনা৷ তবে আমরা আশাবাদি হতেই পারি, যেহেতু আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী টুঙ্গীপাড়ারই মেয়ে এবং দাদার প্রতি তার যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও ভক্তিও আছে৷ পরিশেষে বলব দাদা আপনি হয়ত চলে গেছেন, কিন্তু আমাদের যাদের রেখে গেছেন তারা আপনার আদর্শকে বুকে লালন করে রাখব এবং সত্য বলতে কখনও পিছপা হবো না৷

-মোঃ ফয়সাল আহম্মদ
জেলা সমন্বয়কারী
এসএএইচআর প্রকল্প, চট্টগ্রাম ইউনিট
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা৷